কালীকে তুইতোকারি, মুক্ত মনে দেবীর সাধনা করেছিলেন রামকৃষ্ণ
শ্রীরামকৃষ্ণের সাধন-প্রকৃতির একটা আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য হলো অতৃপ্তি, যা অন্যান্য সাধকের থেকে তাঁকে স্বতন্ত্র বলে চিহ্নিত করে। একটি আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হলেই তিনি পরবর্তী উত্তরণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠতেন।
মা তুই রামপ্রসাদকে দেখা দিয়েছিস, আমায় কেন দেখা দিবি না? আমি ধন, জন সুখভোগ কিছুই চাই না। আমায় দেখা দে।
কখনও প্রার্থনা করতে করতে চোখের জলে বুক ভেসে যেত, কখনও আবার মাকে তন্ময় হয়ে গান শোনাতেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে এমনই ঘরের মেয়ে হয়ে উঠেছিলেন মা কালী। তাই তাঁকে তিনি ডাকতেন `তুই’ সম্বোধনে। পরে মা কালীর একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন বিবেকানন্দও। আজ মা কালীকে নিয়ে বিতর্কে উত্তাল দেশ। আজকের হিন্দুত্ববাদীদের চোখ খোলার জন্য কি বেশি করে প্রয়োজন রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের কালীসাধনা ফিরে দেখা?
মা কালীর মতো একটা চরিত্রকে ধূমপান করিয়েছিলেন পরিচালক লীনা মনিমেকলাই। তারপর তাঁর স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেছিলেন সাংসদ মহুয়া মৈত্র। এই নিয়ে রে রে করে উঠেছে হিন্দুত্ববাদীরা। মহুয়ার গ্রেফতারির দাবিও উঠেছে। বাংলায় কালীসাধক অগুনতি। এঁদের মধ্যে আধুনিকতম হলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। তিনি ও বিবেকানন্দ মা কালীকে নিয়ে মুক্তচিন্তার ফল্গুধারা বইয়ে দিয়েছিলেন সমাজে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কন্যাস্বরূপিনী মা কালীকে `তুই’ সম্বোধনও করতেন। তাঁদের চিন্তা, মনন কি নাড়া দিয়ে দিয়ে যাবে না আজকের রে রে করা হিন্দুত্ববাদীদের?
আরও পড়ুন: তারাপীঠে দেবীকে উৎসর্গ করা হয়…, মহুয়া-বিতর্কে ফিরে দেখা কালীসাধনার উপাচার
ভারতীয় শক্তিসাধনার দুই ধারা- কালীকুল ও শ্রীকুল। শক্তিনির্দেশে আমাদের বঙ্গভূম কালীকুলের অন্তর্গত। কালীকুলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী দক্ষিণাকালিকা। সেজন্য বাংলায় সাধকের কাছে কালীর নিরঙ্কুশ প্রাধান্য। জগদ্ধাত্রীর মতোই কালীর সঙ্গে বঙ্গীয় সম্পর্ক ও নির্ভরতা নিবিড়।
১৮৫৫ সালে কলকাতার মাহিষ্য সমাজের এক ধনী জমিদারপত্নী রানি রাসমনি দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। রামকুমার সেই মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের পদ গ্রহণ করেন। সামান্য অনুরোধে তাঁর ভাই গদাধর সেখানে চলে আসেন। রামকুমারের মৃত্যুর পর রামকৃষ্ণের ভাবতন্ময়তা বৃদ্ধি পায়। কালীকে তিনি মা ও বিশ্বজননীরূপে প্রত্যক্ষ করেন। তরুণ পুরোহিত সেদিন কিন্তু সাধক ছিলেন না। তাঁর উপাস্য দেবী দুর্জ্ঞেয় ভয়ঙ্করী না কি আলোকময়ী হিতৈষিণী- এসব তাত্ত্বিক ভাবনা সেদিন তাঁর মনে জাগেনি। কালীকে দেখে সেদিন গদাধর অন্তত লালিত নিরাবয়ব ঈশ্বরের এক মানবী রূপ খুঁজে পেয়েছিলেন। হৃদয়ের গভীর বিশ্বাস নিয়ে তিনি তাঁকে `মা’ বলে ডাকেন। অবোধ শিশুর কাছে জগতে যিনি সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, যাঁর কাছে সব খুলে বলা যায়, যা খুশি আবদার করা যায়, আনন্দ-দুঃখ প্রকাশ করা যায়, তিনিই মা। তবে মা কালীকে `মা’ সম্বোধনে ছিল না কোনও শিশুসুলভ চপলতা, বরং ঈশ্বর যে সত্যই খুব কাছের মানুষ, এই অনির্বচনীয় আপনবোধের প্রকাশ ছিল, ছিল গভীর প্রত্যয়। তাই কালী তাঁর কাছে একাধারে মা, একাধারে মেয়ে।
রামকৃষ্ণ আদৌ মা কালীর দেখা পেয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন, তবে রামকৃষ্ণ নিজে কী বলেছিলেন,
একদিন অস্থিরতার বশে তিনি সংকল্প করেন, দেবীর দর্শন না পেলে জীবন বিসর্জন দেবেন। দেওয়াল থেকে খড়্গ তুলে নিয়ে তিনি গলায় কোপ বসাবেন, এমন সময় অকস্মাৎ সমগ্র কক্ষ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর কালীদর্শনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা এইরকম,
সহসা মার অদ্ভূত দর্শন পাইলাম ও সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়য়া গেলাম! তাহার পর বাহিরে কি যে হইয়াছে, কোন দিক দিয়া সেদিন ও তৎপরদিন যে গিয়াছে, তাহার কিছুই জানিতে পারি নাই। অন্তরে কিছু একটা অননুভূত জমাট-বাঁধা আনন্দের স্রোত প্রবাহিত হইতেছিল, তাহার প্রকাশ উপলব্ধি করিলাম।...
শ্রীরামকৃষ্ণের সাধন-প্রকৃতির একটা আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য হলো অতৃপ্তি, যা অন্যান্য সাধকের থেকে তাঁকে স্বতন্ত্র বলে চিহ্নিত করে। একটি আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হলেই তিনি পরবর্তী উত্তরণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠতেন। কালীর নিত্য সান্নিধ্যের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় দিনে মন্দিরে এবং রাতে পঞ্চবটিতে আকুল হয়ে প্রার্থনা করতেন। নানাভাবে কেঁদে কেঁদে মাকে ডাকতেন। ভালবাসা প্রকাশ করতেন, কখনও বা ধৈর্য হারিয়ে মুখ করতেন, যেন মাকে পাকড়ে আনছেন। যেন জাল ফেলে মাছ হড়হড় করে টেনে আনছেন। ভাবখানা যেন- 'এবার কালী তোমায় খাব।'
জগন্মাতাও নানাভাবে তাঁকে দর্শন দিতে লাগলেন। কখনও বালিকারূপে, কখনও বারাঙ্গনাবেশে, কখনও আলোকরূপে, তো কখনও চৈতন্যরূপে। রূপের সংকীর্ণতা তাঁর মন থেকে বিলীন হয়ে গেল। অর্থাৎ, তন্ত্রমন্ত্র নয়, তিনি অনুভব করলেন, মা শুধু মূর্তিতে নন, তিনি সবকিছুর মধ্যেই আছেন, তিনিই সবকিছু।
রামকৃষ্ণের হাত ধরে মা কালীর একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দও। তন্ত্রমন্ত্রকে তিনিও আশ্রয় করেননি। মা কালীর আরাধনায় পেয়েছেন হৃদয়ের সাড়া। আর সেই চিন্তাই ছড়িয়ে দিয়েছেন সমাজে।
দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দের প্রার্থনা তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৮৮৪ সালে রামকৃষ্ণ পরমহংস নরেন্দ্রনাথ দত্তকে দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়িতে আর্থিক উন্নতির জন্য প্রার্থনা করতে পাঠিয়েছিলেন। গবেষকরা এই ঘটনা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে এটিকে বিবেকানন্দর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলেন। কারণ, বিবেকানন্দ প্রথমদিকে প্রতিমা পূজার বিরোধী হলেও এই ঘটনার পর থেকে তিনি কালী মূর্তি পূজা মেনে নেন। এবং কালী মূর্তির কাছে প্রার্থনা করেন। পরবর্তী জীবনে কালীর একনিষ্ঠ ভক্তে পরিণত হয়ে বিবেকানন্দ বলেছিলেন,
কালী হলেন ব্রহ্মাণ্ডের দিব্য জননী।
বিবেকানন্দ যখন পাশ্চাত্যে বেদান্ত প্রচারে গিয়েছিলেন, তখন তিনি ভগিনী নিবেদিতাকে একটি চিঠিতে লেখেন, মা কালী তাঁকে রক্ষা করেছেন এবং হৃদয়ের সমর্থন জোগাচ্ছেন।
তবে আরও আগে শ্মশানবাসিনী কালী হয়ে উঠেছিলেন ঘরের মেয়ে। কীভাবে?
কথিত আছে, বঙ্গদেশে কালীপুজোর সূচনা করেছিলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। আনুমানিক ১৫০০-১৬০০ শতক মতান্তরে ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে মা কালীর আরাধনা শুরু করেছিলেন তিনি। একটা সময় বাড়িতে নয়, শ্মশানে, নদীর তীরে কিংবা গভীর অরণ্যে পুজো হতো। কৃষ্ণানন্দর আরাধনায় শ্মশানকালী হয়ে উঠলেন ঘরের মেয়ে। যে কালীপুজো এক সময় বাড়িতে নিষিদ্ধ ছিল, কৃষ্ণানন্দর হাত ধরে সেই দেবী প্রবেশ করলেন গৃহস্থের ঠাকুরঘরে।
পরবর্তীকালে রামপ্রসাদ ও বামাক্ষপ্যার মতো সাধকরা এসেছেন ঠিকই। কিন্তু রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দর চিন্তা, চেতনায় কালী অনেক আপন, তাই তাঁদের মুক্তচিন্তার ফগ্লুধারা আজও বয়ে চলেছে এইভাবে,
শ্যামা মা কি আমার কালো রে
লোকে বলে কালী কালো
আমার মন তো বলে না কালো রে...।