অনন্ত বিরহের বর্ষায় বৃষ্টি লুকোয় যে ‘রেইনকোট’
Rituparna Ghosh: সম্পূর্ণ ছবিটিতে নিরু আর মনোজের কথোপকথনে কখনও একবারের জন্যও এসে দাঁড়ায় না তাদের ব্যক্তিগত অশ্রুবিন্দুগুলি। অথচ, আমরা বুঝতে পারি তাদের অন্তরে কান্নার বারিধারা প্রতি মুহূর্তে ঝরেই চলেছে।
২০০৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর ‘রোববার’ পত্রিকায় ঋতুপর্ণ ঘোষ লিখেছিলেন:
জীর্ণ বসন ত্যাগ করে নতুন বেশ ধারণ করে যে আত্মা সে যুগ যুগ ধরে অনুভবের অগ্নিতে দীপ্র, প্রজ্জ্বল্যমান।
সেই অবিনশ্বর আত্মাই কি প্রেম?
সমস্ত হানাহানির মধ্যেও যে অক্ষত, সমস্ত হিংসার মধ্যেও কোমল, সমস্ত দাবানলের মধ্যেও যে অদাহ্য, আলোকময়।
এই প্রেমের অগ্নি একাগ্রভাবে যাদের ভিতরে জ্বলছে, তারা সামাজিকভাবে হয়তো মুক্ত, হয়তো স্বাধীন। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই তারা প্রত্যেকে বাস করছে এক অদৃশ্য মেঘময় কারাগারের ভিতর।
কে বন্দি করে রেখেছে তাদের? সম্পর্ক। না-পাওয়া। প্রেম! তারা প্রত্যেকেই একেকজন যক্ষ!
জীবনরূপী কারাগারে মধ্যে এই এত এত যক্ষের সামনে কোনও জানালা খোলা আছে কিনা, আমাদের জানা নেই। সেইসব যক্ষদের আছে কি কোনও ভাসমান মেঘ-সংযোগ? কোনও না কোনওভাবে যুক্ত হবার উপায়? সেটুকুও যদি না হয়, তখন, সেই নিরুপায়ভূমিতে বসে থাকে কেবল দু-জন। আমাদের অস্তিত্ব। আর, না-পাওয়া!
‘বৈষ্ণব পদাবলী’-র ক্লাসে মাস্টারমশাই আব্দুল কাফি একদা বলেছিলেন, ‘পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, আক্ষেপানুরাগ--- এই সমস্ত পর্যায় পেরিয়ে এসেই যে মাথুরে পৌঁছতে হবে, তা কারও জীবনে না-ও হতে পারে। কারও-কারও জীবনে পূর্বরাগের পরেই আসতে পারে মাথুর।’ অর্থাৎ প্রেম আসামাত্রই, আনন্দের পরিবর্তে সেই প্রেমজনিত বিরহকেও অনুভব করতে পারি আমরা। এমনও হতে পারে, এক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে বা অপমানের মধ্যে দিয়ে প্রথম দরজায় এসে দাঁড়াল প্রেম। এবং সেই প্রেমের পরিণতি আমি সারাজীবনব্যাপী বহন করতে থাকলাম।
আরও পড়ুন: প্রতিশোধের উত্তাপে সমতার ভূমি খুঁজে চলে ঋতুপর্ণের ‘চোখের বালি’
এখানে প্রশ্ন জাগে, কেন বহন করি আমরা? কেন ভুলতে পারি না? প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত-র বিখ্যাত সেই কবিতার লাইন, ‘দুঃখ আরও বড় হলে তাকে নিয়ে ঘর করা যায়’। বিরহের জন্মমুহূর্ত ঠিক কোথায় এবং তার অন্তিম পরিণতি বা কতদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে— এ-প্রশ্নের উত্তর-অন্বেষণের থেকেও সেই বিরহকে আপ্রাণ ভোগ করাটাই বোধহয় আমাদের প্রাপ্তির আকাশস্বরূপ! সারাজীবন দুঃখের সঙ্গে ঘর করার সমার্থক!
২০০৪ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষ তৈরি করেছিলেন ‘রেইনকোট’। এক বৃষ্টি-দুপুরের কাহিনি। বিরহ দু-হাতে ধরে রয়েছে ছবিটির প্রাণকলস।
‘রেইনকোট’ সম্পর্কে কয়েকটি কথা আরেকবার মনে করে নেওয়া যাক। এক বৃষ্টির দুপুর। নিরু এবং মনোজ। নিরুর বিয়ের আগে, তাদের গ্রামে একসঙ্গে থাকাকালীন দু-জনে প্রেম-সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল। মনোজ তখন বেকার, নিরুর বাড়ির লোক নিরুকে কলকাতায় বিয়ে দিয়ে দেয়। বহু বছর পর, নিজের নতুন ব্যবসা শুরু করার জন্য বন্ধুদের কাছে কিছু অর্থ সাহায্য চাইতে মনোজ কলকাতায় আসে। নিরুর ঠিকানা ওর কাছে ছিল। খুঁজে-খুঁজে ওর বাড়িতে যায়। নিরু দরজা খোলে। আসবাবে পূর্ণ ঘরে এনে মনোজকে বসায়।
ঘর অন্ধকার। জানলা বন্ধ। লোডশেডিং। বাইরে বৃষ্টি। মোমবাতি জ্বালানোর জন্য দেশলাই খুঁজতে থাকে নিরু। সিনেমার এই অংশের সংলাপমালাটি এমন:
মনোজ।। এক লাইট তো জ্বালা দো নিরু! তুমহারি শকল ঠিক সে নেহি দেখ পা রাহা হু! অর ইয়ে ক্যায়া? পুরানে ফার্নিচার কি গোডাউন বানা রাখা হ্যায়! পা তক রাখ্নে কি জাগা নেহি!
নিরু।। উঁচে ঘারানে কি বহু হো নে কি ইয়েহি তো প্রবলেম হে মান্নু! তুম নেহি সামঝো গে। দুনিয়া ভর কা পুরানা ফার্নিচার, ক্যাহেতে হ্যায় সব হি অ্যান্টিক হ্যায়! এক ভি হাটায়া নেহি যা সকতা।
মনোজ।। ঘুটান সি হো রেহি হ্যায়। অর চ্যাহেরে সে বাল তো হাটাও!
নিরু।। তুম ভি পাতা নেহি ক্যায়সে হো গ্যায়ে হো মান্নু!
মনোজ।। ম্যায়?
নিরু।। দেখো তো, কিতনে দুবলে হো গ্যায়ে হো, কালে হো গ্যায়ে হো। গাল অন্দর গ্যায়ে হে। বাল ভি…। শার্ট উতার দো।
মনোজ।। নেহি র্যাহেনে দো।
নিরু।। ভিগ জো গ্যায়ে হো। ঠান্ড লাগ জায়েগি।
এই দৃশ্যের পরই নিরু মোমবাতি জ্বালিয়ে এনে টেবিলে রাখে।
নিরু।। কাহা রাখু ইসে [মোমবাতি]?
মনোজ।। ইহা রাখ দো।
নিরু।। ফির তো মুঝে ইহা ব্যাঠ না পারে গা, নেহি তো তুম দেখ নেহি পাওগে মুঝে।
মনোজ।। তুম ওহা ব্যাঠ যাও। ইসে ইহা র্যাহেনে দো। ধীরে-ধীরে শার্ট শুখ্ যায়েগি।
নিরু।। [মোমবাতির আলোয়, মনোজের কাছে নিজের মুখটা নিয়ে এসে বলে] দেখো, চ্যাহেরে পার কোই খ্যারোচ নেহি, কোই দাগ নেহি। অ্যাসিড সে ভি নেহি জ্বালায়া। মেরা পতি মুঝে সাচমুচ ব’হুত চাহতা হ্যায় মান্নু।
অথচ ছবির শেষে পৌঁছে আমরা দেখব, নিরুর দাম্পত্য অখুশির, দারিদ্রে ভরা। তার স্বামী ঋণগ্রস্থ, মাতাল। এবং নিরু এখনও মনোজকেই ভালোবাসে। ‘দেখো, চ্যাহেরে পার কোই খ্যারোচ নেহি, কোই দাগ নেহি। অ্যাসিড সে ভি নেহি জ্বালায়া। মেরা পতি মুঝে সাচমুচ ব’হুত চা তা হ্যায় মান্নু’— তাহলে এই অসত্য কথা বলছে কেন নিরু?
কারণ, বিরহ নিরুর একার। সে ভালো নেই, এই তথ্যটুকও সে মনোজকে জানাতে চায় না। মনোজকে ছেড়ে সে যে অন্য পুরুষের কাছে এসেছিল, সেই পুরুষ আসলে নিরুর যথার্থ নয়, এই তথ্যর মধ্যে কোথাও একটা সম্পর্কের অসমতা রয়েছে। রয়েছে, মনোজকে প্রাধান্য দেওয়া। যখন যন্ত্রণা ভোগ করা ও মনোজের সঙ্গে না-থাকতে পারাটাকে ভবিতব্যরূপে মেনেই নিয়েছি নিরু, তখন অকারণে কেন সে মনোজকে নিজের অবস্থান জানাবে?
পাঠককে, অনুরোধ করব, এই দৃশ্যটিতে ঐশ্বর্য রাইয়ের মুখভঙ্গিটি লক্ষ্য করার জন্য। যেন মনোজ চাইছিল, নিরুর মুখে গৃহ-অশান্তির দাগগুলি সে দেখতে পাক— কিন্তু নিরু মনোজকে সেই তৃপ্তিতথ্যগুলি কিছুতেই দেবে না! এই সূক্ষ্মতাই ঋতুপর্ণ ঘোষের ক্ষমতা!
শ্রীকৃষ্ণ, মথুরা ছেড়ে গোকুলে যাচ্ছেন কেন? রাধার সঙ্গে দেখা করতে? ছবির একটি গানের এই অমোঘ প্রশ্নটি মিলিয়ে দেয় মনোজের নিরুর বাড়িতে আসার বিরহসূত্রকে। কিন্তু তার পাশাপাশি ‘রাধা’ কথাটিকে নতুনভাবে ভাবতে ইচ্ছে করে আমাদের। ‘রাধা’ তো একটি ভাব! নিরুর বিয়ে হয়ে চলে আসার পর মনোজের বেদনার্তি, এতদিন পর কলকাতায় এসে নিরুকে একবার চোখের দেখা দেখতে চাওয়া— এও কি এক পুরুষের মধ্যে অবস্থিত চিরন্তন রাধাবিরহ নয়? এই প্রশ্নগুলি নিরন্তর জাগিয়ে দেয় ‘রেইনকোট’।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক চিদানন্দ দাশগুপ্ত বলতেন, ‘একটি ভালো ছবিকে সমগ্রভাবে বুঝতে গেলে তাকে আজীবন বারংবার ফিরে-ফিরে দেখতে হয়।’ ঋতুপর্ণ ঘোষের অনেক ছবির ক্ষেত্রেই বোধহয় এ-কথা বলতে পারি আমরা। ‘রেইনকোট’-এর ক্ষেত্রে তো পারিই! কারণ সম্পূর্ণ ছবিটি দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে যদি আবারও ছবিটি দেখতে যাই তাহলে ‘রেইনকোট’-এর প্রায় শেষের দিকের একটি দৃশ্যের সংকেত-প্রাচুর্যকে ধরতে পারব।
নিরুর বাড়ির মালিকের কাছ থেকে মনোজ জেনে গেছে নিরুদের দারিদ্র-অবস্থার কথা, অন্যদিকে মনোজের রেইনকোটের মধ্যে থাকা একটি চিঠি যা মনোজ লিখেছিল তার বন্ধুদের প্রতি, সেখান থেকে মনোজের আর্থিক অনটনের বিষয়টি নিরুর কাছেও আর অজানা নয়। দু'জনেই তখন একে-অপরের সত্য-অবস্থান সম্পর্কে অবগত। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে তখনও দু'জনে এক মিথ্যে, বানানো, ধনী-বিলাসময় জীবনের কথা একে-অপরকে বলে যাচ্ছে। ছবির প্রথমের সঙ্গে এখানে পার্থক্য শুধু এই যে, মনোজ জানে নিরু মিথ্যে বলছে, সে ধনী নয়। আবার নিরুও জানে, মনোজের সমস্তটাই বানিয়ে তোলা।
কিন্তু এই তথ্য জেনেও তাদের কথা বলার মধ্যে, চোখ-মুখের ভঙ্গিতে কোনও তাচ্ছিল্য বা সন্দেহের বদলে এক অপরিসীম বিশ্বাস দেখতে পাই আমরা। দু'জনেই ভাবছে, অপরজনের মিথ্যে কথাগুলি যদি সত্যি হত! তাহলে নিশ্চয়ই ভালো থাকত সে। সেই ভালো-থাকার শান্তিটুকু অন্তত দু'জনে দু'জনকে দিক!
আরও পড়ুন: অপ্রাপ্তির ভিতর দিয়ে বন্ধুত্বের সেতু গড়ে দেয় যে কবিতারা
সম্পূর্ণ ছবিটিতে নিরু আর মনোজের কথোপকথনে কখনও একবারের জন্যও এসে দাঁড়ায় না তাদের ব্যক্তিগত অশ্রুবিন্দুগুলি। অথচ, আমরা বুঝতে পারি তাদের অন্তরে কান্নার বারিধারা প্রতি মুহূর্তে ঝরেই চলেছে। কিন্তু ব্যবহারে, ভদ্রতায়, হাসির উত্তরে— ভিতরের সেই বৃষ্টির স্রোতকে দু'জনেই আড়াল দিয়ে চলে! অর্থাৎ সর্বক্ষণ একটি ‘রেইনকোট’ পরে থাকে দু'জনেই। ঠিক এখানেই, মুহূর্তেই যেন জাগ্রত হয়ে ওঠে আমাদের সামনে ছবিটির নামকরণের অর্থ!
আমরাও তো আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে এমন কত কত রেইনকোট পরে রয়েছি। কী ভাববে আমাকে? বুঝতে পারবে কি আদৌ?— এসব ভাবনায় সেই নির্দিষ্ট একজনকে কিছুতেই জানতে দিচ্ছি না আমাদের জ্বালাযন্ত্রণাগুলি!
বিরহ, অনন্ত। একবার এই রেইনকোটটা নিজেদের আত্মা থেকে খুলে দেখুন, সামনের জনও হয়তো অনেকদিনই খুলে রেখেছে নিজের বর্ষাতি, সে-ও এই বৃষ্টির হাওয়া, কালো করে আসা মেঘের ভেতর কিছু বলতে চায়!
সকলকে, শুভ বর্ষাকাল!