মানুষের ভাষা ভাঙছে সোশ্যাল মিডিয়া, তলিয়ে যাচ্ছে মুখোমুখি আলাপের আবেগ?
Social Media Language: প্রোফাইল ছবি বদলালে যে ধরনের মন্তব্য করার অভ্যেস হয়েছে, সামনাসামনি দেখা হলে মনে হচ্ছে আসলে নতুন ছবি পোস্ট হয়েছে।
যে ভাষায় ভালবাসি, সেই ভাষায় যুদ্ধ হয়। ভাষার জোরে বিপ্লব সম্ভব, শাসকের পতন সম্ভব, আবার সেই ভাষার দোষে জেলযাত্রা, সবই সম্ভব। জীবজগতে এক অবাক রহস্য মানুষের ভাষা যা কেবল মৌখিক শব্দধ্বনিবদ্ধ নয়, হাবভাব চালচলন, একে অপরকে বোঝার ক্ষমতার মতো নানা সূক্ষ্ম মনস্তত্বের ধারক। এমন তার ব্যাপ্তি, অসীম জটিলতা, বিচিত্র বহুমুখী ভাবগতিক অন্যান্য প্রাণীপ্রজাতির মধ্যে আজ অবধি দেখা যায়নি। বলা হয়, মুখোমুখি বসার অবসরেই মানুষের ভাষার বিবর্তন। অন্যকে সাহায্য করে দলগত সহযোগিতা সহমর্মিতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন ছিল এমন এক যোগাযোগ মাধ্যমের যার ফলে সংখ্যায় অনেকে হওয়া সত্ত্বেও প্রতিকূল পরিস্থিততে বেঁচে থাকা সহজ হবে, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সাম্রাজ্য বিস্তার সুবিধাজনক হবে৷ উল্টোদিকে, ভাষা ব্যবহারে এই সহযোগী প্রবণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় প্রাগৈতিহাসিক মানুষের মধ্যে। ডিম আগে না মুরগি আগে তা তর্ক সাপেক্ষ তবে এটুকু মেনে নিতে বাধা নেই যে মানুষের সংঘবদ্ধ প্রাচীন সামাজিক প্রবৃত্তি ভাষার আদানপ্রদানে লালিত। দু'তরফের জটিলতা একে অপরের পরিপূরক।
কেবল শব্দ বাক্য ব্যকরণ নয়, ভাষাকে যোগাযোগ মাধ্যম করে তুলতে প্রয়োজন শক্তপোক্ত এক কাঠামোর যার সমস্ত শর্ত না মানলে সবটাই বিফল। প্রাথমিক শর্ত, অন্তত দু'জন মানুষ মুখোমুখি আলাপ করবে যাদের মধ্যে হয় আগাম পরিচয় থাকবে নইলে সংক্ষিপ্ত পরিচয়পর্ব দিয়ে শুরু হবে আলাপচারিতা। একে অন্যের মানসিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা থাকবে; আলাপ চলাকালীন অপরের শরীরিভাষা, মুখভঙ্গি, টুকটাক হুঁ-হাঁ-ও!-তারপর? ইত্যাদি অব্যয় ব্যবহার থেকে ফিডব্যাক নিয়ে বক্তা তাঁর বক্তব্য হয় চালিয়ে যাবেন নয় সময়মতো থামবেন, নয়তো গিয়ার বদলাবেন। কথোপকথনের মূল উদ্দেশ্য তাকে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া। ইকোনমিক্সের গেম থিওরি দিয়ে একে বিশ্লেষণ করা যায়। আবার নিউরোবায়োলজিসটরা দেখেছেন, সুচারুভাবে এগিয়ে চলা কথোপকথনে বক্তা এবং শ্রোতার মস্তিষ্কে কোষগুলি একই তরঙ্গে জ্বলে নেভে, অতএব দু'জনে সহযোগিতাপূর্বক আলাপচারিতায় জড়িয়ে পড়ে।
যে বক্তা অন্যজনের ফিডব্যাক নিতে অক্ষম তার শ্রোতাকে সে হারাবে সহজেই। শ্রোতাকে আলাপচারিতায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ করে দেওয়াও সুস্থ কথাবার্তার মাপকাঠি। যার ফলে পৃথিবীর সমস্ত ভাষায়, এমনকী ভাষা শেখার আগে শিশুরাও নিজের ভাবনা ব্যক্ত করার পর কয়েক সেকেন্ড বিরতি নেয়। অন্যকে কিছু বলার সুযোগ করে দেওয়ার নাম টার্ন-টেকিং। কথা বলা এবং কথা বোঝার জন্য স্নায়ুস্তরে এই সময়টুকু প্রয়োজন, নয়তো বিষয়বস্তুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে উত্তর দেওয়া যায়না। কথার খেই হারায়। ধৈর্য্য চ্যুত হয়ে দু’জনেই রণে ভঙ্গ দেয়। সবশেষে যা একান্ত জরুরি, কখন কথা শেষ করতে হবে সেই পরিমিতি ও বিবেচনাবোধ। আলাপের মধ্যবর্তী নীরবতা না থাকলে আলাপ আর বিলাপের সীমারেখা মুছে যায়। ভাষা প্রবল শক্তিশালী এক অস্ত্র আর নীরবতা তার শক্তিসঞ্চয়ের সময়, অস্ত্রে ধার মজুত রাখার একমাত্র উপায়। না হলে বহুব্যবহারে যে কোনও অস্ত্রের মতোই তার ধার ক্ষণস্থায়ী। অর্থাৎ ভাব ও ভাষা বিনিময় এক লম্বা যাত্রা, যার শুরু আছে শেষ আছে এবং মাঝখানে আছে মন বোঝাবুঝির খেলা, বিরতির পর ভবিষ্যতে যা তৈরি করবে নতুন কথা শুরুর পথ।
আরও পড়ুন- বড় ভাষার দাদাগিরিতে আজ যে ছোট ভাষাগুলির নাভিশ্বাস
এসব তত্ত্ব বইতে পড়েছি। ভাষার বৈশিষ্ট্যগুলির বিবর্তনের ইতিহাস খুঁড়ে বের করাই আমার রুজিরুটি। কিন্তু ব্যক্তিগতস্তরে আশেপাশে দেখি ভাষা বিনিময়ের মৌলিক পরিকাঠামো ভগ্নপ্রায়। বিপজ্জনক এই ধ্বংসস্তুপের নেপথ্যে বিদ্রূপের হাসি হাসছে সামাজিক-মাধ্যম।
সামাজিক-মাধ্যমে সামনে রক্তমাংসের কেউ উপস্থিত নেই, সেখানে পরিচয়পর্বের পাঠ চুকেছে। এখন রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে অনেকেই হঠাৎ এগিয়ে এসে মতামত পেশ করেন কারণ টাইমলাইনে ভেসে ওঠা পোস্টে বক্তব্য পেশ করতে না দিতে হয় নিজের পরিচয় না জানতে হয় অন্যেরটা। পরিচয় জানতে চাইলে বলি, আমি আপনার প্রোফাইল দেখে ‘চিনেছি’, আপনিও আমার প্রোফাইল দেখে নেবেন। ঘনিষ্ঠ, পরিচিত, স্বল্প-পরিচিত, অপরিচিত- সম্পর্কের এই স্তরগুলি এবং তাদের ভিতর ব্যবধান ঘোলাটে, যার ফলে কোন সম্পর্কে কী ধরনের কথাবার্তা যথাযথ তার বিচারবোধ নেই। সকলের সঙ্গেই তুইতোকারি করতে পারি, ইয়ারদোস্তির ভাষায় কথা বলি, গালিগালাজ বা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি, অযাচিত অধিকারবোধ দেখাই। অতএব, পরিকাঠামোর প্রথম ধাপেই ভাঙন। সামনে যে নেই তার সঙ্গে 'কথা' চালাচালির জন্য ফিডব্যাকের গুরুত্বও আর তেমন নেই। যখন ইচ্ছা যার তার দেওয়ালে গিয়ে লিখে আসতে পারি, সে যখন ইচ্ছা দেখবে, প্রতিক্রিয়া দেবে, আমার সময় হলে দেখব। অর্থাৎ, লাগাতার ফিডব্যাকের মাধ্যমে সহজাতভাবে গড়ে উঠছেনা কথাবার্তা। মানসিকভাবে সবটাই বিক্ষিপ্ত, অথচ নিউজফিডে নথিভুক্ত হচ্ছে টানা কথোপকথন। বাস্তবের সঙ্গে পরাবাস্তবের এই ব্যবধান ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে সহজাত যোগাযোগের ক্ষমতা।
এর ছায়া পড়ছে সরাসরি কথায়। অপরের মুখভঙ্গি, অঙ্গভঙ্গির দিকে মনোযোগ থাকছেনা কথা বলার সময়ে কারণ আমার মন ভাবছে আমি টাইপ করছি। যতক্ষণ ইচ্ছা করব, যতটা বলার বলব। তা যদি আমার সামনের জনকে অস্বস্তিতে ফেলে ফেলুক, তার ট্রেন মিস হয় হোক, তার বিরক্তি উদ্রেক হলে আমার কী? মোট কথা আমার শ্রোতার আবেগ ও তার পরিবর্তনের প্রতি আমি সমব্যথী নই৷ আমার কোনও এম্প্যাথি নেই, নার্সিসিজম আছে। কাকে কী বলছি তা মুখ্য নয়, আমার মূল লক্ষ্য শব্দউদগারণ। নিজের যুক্তিকে চূড়ান্ত মনে করে অভেদ্য বন্দিদশায় নির্বাসন নিয়েছি যেখানে অন্যের যুক্তিবোধের প্রবেশ নিষেধ। যার ফলে ভুলকে ঠিক ভেবে আমি অন্ধকারে একলা রাজা।
শব্দ বিনিময় হচ্ছে তবু আবেগ বিনিময় হচ্ছে না, এর অভিঘাত সাংঘাতিক! কারণ শব্দের মধ্যে দিয়ে আবেগ বিনিময় করাই ভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য মনে করা হয়। উলটোদিকের মানুষকে হাসখুশি প্রোফাইল ছবি ভেবে স্ট্যাটিক ভাবছি, রোজ সকালে সুপ্রভাত-মিম পাঠাচ্ছি, ওদিকে সে হয়তো প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ হাতে বসে। তার অতি-ডাইনামিক পরিবর্তনশীল মন আমার কাছে স্থিরচিত্র। এক হাসিমুখ থেকে আরেক হাসিমুখ, এইটুকুই তার বিস্তৃতি। তার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হলেও তাকে বিচার করছি ঝলমলে পোস্ট মনে রেখে, তার সেইসময়ের মনের অবস্থার বিচারে নয়। আজকাল দেখা হলে কেউ কুশল বিনিময় করিনা, জামাকাপড়, শাড়িগয়না, লিপস্টিকের রঙ রোগামোটা দিয়ে কথা শুরু করি। প্রোফাইল ছবি বদলালে যে ধরনের মন্তব্য করার অভ্যেস হয়েছে, সামনাসামনি দেখা হলে মনে হচ্ছে আসলে নতুন ছবি পোস্ট হয়েছে। রক্তমাংসের মানুষদের গুটিয়ে আনছি টাইমলাইনের ওঠাপড়ায়, সুখ বিতরণ করা ছাড়া যার অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকতে নেই।
আরও পড়ুন- আমার বোনেরও বর্ণমালায় ২১ শে ফেব্রুয়ারি! ভাষা আন্দোলনে অনুচ্চারিত মেয়েদের কথা
এ সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে নীরবতার। ক্রমাগত টাইপ করতে যেহেতু বাধা নেই, সামনাসামনিও আমরা কথা থামাতে ভুলে যাচ্ছি। টার্ন-টেকিংয়ের সময় দিয়ে অন্যকে সুযোগ করে দিচ্ছিনা সুস্থ কথাবার্তার। আমি লগ-ইন করেছি, যে ক’টা প্রোফাইল চোখে পড়বে সবখানে টাইপ করব বক্তব্য। আমার কথা বলার দরকার থাক বা না থাক বলতেই থাকব। এটা একটা সাইড সমস্যা- সবসময়ে মনে হচ্ছে কমেন্ট-বাক্স আছে, কিছু বলতেই হবে। হামেশাই দেখা যাচ্ছে বন্ধুদের আড্ডায় সবাই কথা বলছে, কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছেনা। সবাই সব বিষয়ে কথা বলছে, কেউ শুনছেনা। সবাই বলছে, কিন্তু কেউ প্রাসঙ্গিক কিছু বলছেনা। সবাই আসলে সবার টাইমলাইনে কমেন্ট করছে, যেহেতু লগ-ইন করেছে। উপরন্তু মনে হচ্ছে, আমাদের ক্রমাগত কথা বলে যাওয়া উচিত। নইলে ভয়, অবান্তর হয়ে গেলাম? গুরুত্ব কমে গেল? বাস্তবে সামনে বসে থাকা মানুষটির ইচ্ছা, অনিচ্ছা, সুবিধা, অসুবিধার তোয়াক্কা না করে আমরা ভাবছি ওর টাইমলাইনের সঙ্গে দেখা, তাই ক্রমাগত কথা বলি, উত্তর আশা করি। উত্তর না পেলে হীনমন্য, হিংসাত্মক হই। তাকে খোঁচাতে থাকি, কী হল, কিছু বল। রিঅ্যাকশন দাও! যেমন পোস্ট করে বারবার দেখতে যাই কে কতরকমভাবে প্রতিক্রিয়া দিল। কিছু না দিলে নিজেই নিজের পোস্ট লাইক করি, কমেন্টবাক্সে কিছু একটা লিখে দিয়ে দৃশ্যমান হই। ফ্রেন্ড রিক্যুয়েস্ট পাঠিয়ে উত্তর না পেলে ইনবক্সে আক্রমণ করি। হোয়াটসঅ্যাপ-এ ব্লু টিক হওয়ার পরেও উত্তর না পেয়ে বিরক্ত করি। আর মনে মনে উদ্বিগ্ন হই, মনোকষ্টে ভুগি, ইগো সন্তুষ্ট হচ্ছেনা। আমাকে উপেক্ষা করছে? এত বড় সাহস? জানে, আমি অমুক-তমুক-কত বড় কেউকেটা! পরোক্ষে বা সরাসরি আক্রমণ করি সামনাসামনি দেখা হলে। প্রশ্ন করি, কী ব্যাপার, মেসেজের উত্তর দিলেনা? পোস্ট/কমেন্টে লাইক করোনি? কারণ আমরা বাক্যব্যয় করি, যোগাযোগ করিনা। ফিডব্যাক নেব না। উত্তরের অনুপস্থতিও যে অনেক ধরনের বার্তা বহন করতে পারে যা বিচার করে আমার পরবর্তী আচরণ নির্ধারণ করা উচিত তা মানছিনা, মানবনা৷ জোর করে বৈধতা আদায় করে আমিসর্বস্ব মাদকতায় পারফর্ম করতে শিখিয়েছে সামাজিক-মাধ্যম। সামাজিকভাবে ভাষা আদানপ্রদান করে যোগাযোগের প্রাচীনতা যার থেকে অনেক দূরে। দর্শকের নাড়ি স্পর্শ করে এগোতে শেখায়নি। চুপ করে ভাবতে শেখায়নি।
এ কথা মানতেই হবে যে সামাজিক-মাধ্যমের দৌলতে আজ যোগাযোগ ব্যাবস্থার অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে সহজে পৌঁছে যাচ্ছে খবর এবং সুযোগ। এও এক ধরনের কমিউনিকেশন যার জন্য প্রচার প্রয়োজন। ব্রডকাস্ট মাধ্যম হিসেবে সামাজিক-মাধ্যমের জুড়ি নেই। কিন্তু ব্যক্তিগত পরিসরে মানুষে মানুষে যে সামাজিক বন্ধন তা অন্য ধরনের কমিউনিকেশন। তার জন্য প্রচার নয়, খানিক আড়াল প্রয়োজন। সময় প্রয়োজন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়, অন্যের মন বুঝে সংবেদনশীল পদক্ষেপ প্রয়োজন। এই দুইয়ের তফাত না বুঝে এগোচ্ছি পচাগলা এমন ভবিষ্যতের দিকে যেখানে আমাকে ঘিরে থাকছে কোটি কোটি শব্দ, যেখানে মানবেতিহাসের সবচেয়ে বিস্ময়কর ক্ষমতা ভাষাকে হত্যা করা হচ্ছে।