রামপাঁঠা, রাম ছাগল বোকারাম, হাঁদারাম বললে কি রামের অপমান হয়?

Ram in Bengali Language : রামকে নিয়ে ঠাট্টা সবাই সইতে পারে না। অথচ বাংলা ভাষায় রামকে নিয়ে সহজ ঠাট্টা চোখে পড়ে।

বোর্ডে লিখলাম: রাম ছাগল, রাম বোকা, বোকারাম, রামদা, রাম হাঁদা।

আজ বাড়িতে গৈরিক বস্ত্রধারী এক নিরামিষসেবী বাঙালির আবির্ভাব হয়েছে। তিনি বোর্ডে আমার এই রাম নাম দেখে শিউরে উঠলেন।

আমি বললাম, ‘কী হয়েছে?’

তিনি বললেন, ‘রাম রাম এ-সব কী?’

মনে মনে স্থির করেছি তাঁকে ‘গৈবনি’ অর্থাৎ গৈরিক বস্ত্রধারী নিরামিষসেবী বলে সম্বোধন করব। বললাম, ‘কী আবার!’

গৈবনি: রামের আগে পরে ছাগল, বোকা, হাঁদা এসব লেখা অনুচিত।

আমি: কেন? এ তো বাংলা ভাষায় সুপ্রচলিত। রাম শব্দটি এখানে গুণবাচক – পরিমাণগত বা বস্তুগত দিক দিয়ে বড় রকমের কিছু বোঝাচ্ছে। রাম যখন বোকা বা হাঁদার আগে বসে তখন ধরতে হবে মস্ত হাঁদা, মস্ত বোকা। এর মধ্যে তিরস্কার আর কৌতুকের সুর স্পষ্ট। রাম ছাগল বললেই আমাদের চোখের সামনে দাড়িওয়ালা মস্ত একটা ছাগলের ছবি ভেসে ওঠে। ছাগল তত প্রবৃদ্ধ নয় কিন্তু রাম ছাগল প্রবৃদ্ধ ও সুবৃহৎ। আমাদের বাংলা ভাষার লেখকদের মধ্যে পরশুরামের জবাব নেই। তিনি হাসির-কুঠার হাতে সামাজিক অসংগতির মূলে আঘাত করেছিলেন। এক রায়বাহাদুরের রামছাগল পালনের সে বিচিত্র গল্প। ছাগলের নাম লম্বকর্ণ। সে সব কিছু চিবিয়ে খায়। রায়বাহাদুর তাঁকে বেলেঘাটায় খালের ধারে বেওয়ারিশ দশায় পেয়েছিলেন। পেয়ে ভেবেছিলেন পালন করবেন। শেষে তার খাওয়ার বহর দেখে বিদায় করার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিদায় করার কথা ভাবলেও করতে পারেননি। রাম ছাগল গেল না। বাড়িতে ফিরে এল। রয়েও গেল। পরশুরাম লিখেছিলেন, ‘লম্বকর্ণ বাড়িতেই রহিয়া গেল, এবং দিন দিন শশিকলার ন্যায় বাড়িতে লাগিল। ক্রমে তাহার আধ হাত দাড়ি গজাইল। রায়বাহাদুর আর বড় একটা খোঁজ খবর করেন না, তিনি এখন ইলেকশন লইয়া ব্যস্ত। মানিনী লম্বকর্ণের শিং কেমিক্যাল সোনা দিয়া বাঁধাইয়া দিয়াছেন। তাহার জন্য সাবান ও ফিনাইল ব্যবস্থা হইয়াছে, কিন্তু বিশেষ ফল হয় নাই। লোকে দূর হইতে তাহাকে বিদ্রূপ করে। লম্বকর্ণ গম্ভীরভাবে সমস্ত শুনিয়া যায়, নিতান্ত বাড়াবাড়ি করিলে বলে—ব—ব—ব—অর্থাৎ যত ইচ্ছা হয় বকিয়া যাও, আমি ও—সব গ্রাহ্য করি না। সুতরাং বাঙালিকে যাই বলুন না কেন ছাগলের বড়ত্ব ও দাড়িত্বকে তারা রাম দিয়েই সেলিব্রেট করবে।

আরও পড়ুন- দোহাই! বইমেলায় গাছে গাছে ভুল বানান টাঙাবেন না

গৈবনি: এ অন্যায়, এ অনাচার। ঘোর কলি।

আমি: আপনি বরং একটু রবীন্দ্রনাথ শ্রবণ করুন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বাংলাভাষা-পরিচয়’ নামের বইতে বাংলা ভাষার নিজস্ব মর্জি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। লিখেছিলেন, ‘হাঁদারাম ভোঁদারাম বোকারাম ভ্যাবাগঙ্গারাম শব্দগুলোর ব্যবহার চূড়ান্ত মূঢ়তা প্রকাশের জন্যে। কিন্তু ‘সুবুদ্ধিরাম’ ‘সুপটুরাম’ বলবার প্রয়োজনমাত্র ভাষা অনুভব করে না। সবচেয়ে অদ্ভুত এই যে ‘রাম’ শব্দের সঙ্গেই যত বোকা বিশেষণের যোগ, ‘বোকা লক্ষ্মণ’ বলতে কারও রুচিই হয় না।’ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছিলেন তা অবশ্য নাই মানতে পারেন। আপনি বরং নতুন জনমত তৈরি করুন। সুবুদ্ধিরাম বলতে হবে বলে ফতোয়া জারি করুন। তবে বাঙালি রসিকতার ধার তাতে কমবে না। তারা হয়তো সুবুদ্ধিরামকে সুবুদ্ধুরাম বলে ডাকাডাকি করবে।

গৈবনি আর সইতে পারলে না। রেগে-মেগে ঘর থেকে শুধু নয় আমার বাড়ি থেকে বিদায় নিল। যাওয়ার আগে বলে গেল দলবল নিয়ে ফিরে আসছে। গৈবনির প্রস্থান, সঙ্গে সঙ্গে রূপচাঁদের প্রবেশ। রূপচাঁদ বলল, ‘কী কাণ্ড! একটা সাধুমার্কা লোক দেখলাম রাম-রাম করতে করতে পালাচ্ছে।’

আমি বললাম, ‘পালাবেই তো। রামকে নিয়ে ঠাট্টা সবাই সইতে পারে না। অথচ বাংলা ভাষায় রামকে নিয়ে সহজ ঠাট্টা চোখে পড়ে। এতে রামের প্রতি অশ্রদ্ধা নয় অনেক সময় ভালোবাসাও প্রকাশ পায়।’

রূপচাঁদ বলল, ‘ছেলেবেলায় অনেকেই বোকারাম বলে ঠাট্টার পাত্র, পরে কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথের পদ্য মনে নেই!’

আমি: আছে। তারপর শুনিয়ে দিলাম,

ওকালতি ব্যবসায়ে ক্রমশই তার
জমেছিল একদিন মস্ত পসার।
ভাগ্যটা ঘাটে ঘাটে কী করিয়া শেষে
একদা জজের পদে ঠেকেছিল এসে।
সদাই বাড়িতে তার মহা ধূমধাম,
মুখে মুখে চারি দিকে রটে গেছে নাম।
আজ সে তো কালীনাথ, আগে ছিল কেলে—
কাউকে ফাঁসিতে দেয় কাউকে বা জেলে।
ক্লাসে ছিল একদিন একেবারে নিচু,
মাস্টার বলতেন হবে নাকো কিছু।
সব চেয়ে বোকারাম, সব চেয়ে হাঁদা—
দুষ্টুমি বুদ্ধিটা ছিল তার সাধা!

আরও পড়ুন- টানাপড়েন বানান নিয়ে এত টানাপোড়েন কেন?

রূপচাঁদ: বোকারাম বলে মাস্টার যাকে ডাকত সেই পরে বিখ্যাত উকিল, তুমি এই পদ্যটাকে কি গভীর অর্থে প্রয়োগ করতে চাইলে?

আমি: দিনকাল খারাপ। তার চাইতে রাম দিয়ে কয়েকটা বাক্য লিখে শেষ করা যাক আজকের ‘রামায়ণ’।

রূপচাঁদ: মরা মরা বলতে বলতে রত্নাকর রাম বলেছিলেন। রাম রাম বললে ভূত পালায়। বোকারাম শব্দটি স্নেহ প্রকাশকও হতে পারে। বিশেষ করে মা যখন বোকারাম বলে চুলে বিলি কেটে দেন তখন বোকারাম শব্দে সরল বালকের ছবি চোখে ভাসে। সুতরাং বোঝা গেল মায়েরা, বাঙালি মায়েরা এ-ভাষায় সস্নেহে সরল ছেলের কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজকে বোকারামের কাজ বলেন। অর্থাৎ রাম শব্দের অর্থ প্রয়োগের ক্ষেত্র বিশেষে বদলাতে পারে।

 

More Articles