"বারবার ব্যর্থ হয়েছি" : কোন ম্যাজিকে UPSC উত্তীর্ণ হলেন বাংলার ঋষভ সিং?
UPSC Tips By Rishabh Singh: একেবারে প্রথম দিকে যাঁদের অবস্থান, তাঁরা আইএএস হন। এরপর আইপিএস, তারপর আইআরএস; এভাবেই চলে পদ্ধতি।
ইউপিএসসি পরীক্ষা। অনেকেই বলেন, মারাত্মক কঠিন! যদিও এই কঠিন পরীক্ষাতেও সফল হন কেউ কেউ। বাদ যান না এই রাজ্যের মেধাবীরাও। এবারও UPSC পরীক্ষার চূড়ান্ত পর্যায়ে (২০২২) প্রায় ৭ জন সফল হয়েছেন বাংলা থেকে। যার মধ্যে অন্যতম রাজারহাট-নিউটাউনের বাসিন্দা ঋষভ সিং। তাঁর সাফল্যের নেপথ্য জানাতে এবার ইনস্ক্রিপ্টের জন্য কলম ধরলেন ঋষভ। কীভাবে হয়ে উঠবেন দেশের সর্বোচ্চ আধিকারিক? সাফল্যের সহজপাঠ লিখলেন ঋষভ।
সফল হয়েছি। কিন্তু কীভাবে? একাধিক বাধা নিয়েও এগিয়ে যাওয়ার চাবিকাঠি জানাব। কীভাবে পড়বেন? কী কী করবেন? কী করবেন না? কেন করবেন? কঠিনপথ অতিক্রমের হালহকিকত, পরিকল্পনা থেকে শুরু করে ইউপিএসসি সংক্রান্ত সব তথ্যই তুলে ধরার চেষ্টা করব। তার আগে এই পর্বের প্রাককথনে আসা যাক, আমার ব্যক্তিগত জীবন প্রসঙ্গে।
আমরা দু'ভাই। আমি ছোট। প্রথম থেকেই একটি লক্ষ্য ছিল আমাদের! দাদা চেষ্টা শুরু করেছিলেন। আমিও চেষ্টা শুরু করি ওঁকে দেখেই। আমার দাদা সুশান্ত সিং ২০১৯-এর মহারাষ্ট্র ক্যাডারের একজন আইপিএস আধিকারিক। তাঁর স্ত্রী রশ্মিতা সিং একই ক্যাডারের আইপিএস। আমি, বাবা-মায়ের সঙ্গে কলকাতায় থাকি। বাবা অশোক সিং আইএফএস। ২০০২ সালের ব্যাচ।
ব্যক্তিগত জীবনে বিলাসিতা থাকলেও কোনও বাধা পাইনি, একথা বলা ঠিক হবে না! কোনও কিছুই সহজ ছিল না আমার জীবনেও। আর্থিক সমস্যা অনুভব করতে হয়নি ঠিকই। অন্য চাকরি করার তাগিদ ছিল না, কষ্ট আলাদা করে করিনি! তবুও ছিল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিশাল চাপ।
বছর ছয়েক আগে শুরু করি প্রস্তুতি। ২১-২২ বছর বয়স থেকেই স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে নামি। ২০১৮ সালে ধানবাদের একটি কলেজ থেকে বি.টেক পাশ। যখন আমি চতুর্থ শ্রেণিতে, তখন থেকে এরাজ্যে। মালদহের একটি স্কুল থেকে মাধ্যমিক। উত্তরপ্রদেশের হলেও আদ্যোপান্ত বাঙালি হয়ে উঠি ছোট থেকে। আইআইটি-তে ভর্তি হওয়ার তাগিদে তখন বাড়িতে বসে একাদশ-দ্বাদশ শেষ করি।
আরও পড়ুন- “খরচ জোটাতে টোটোও চালিয়েছি” : কথাবার্তায় উচ্চমাধ্যমিকে দ্বিতীয় আবু সামা
ইউপিএসসির প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি সবেমাত্র। তখনই ২০১৯ নাগাদ আমার দাদা ওই পরীক্ষায় পাশ করে আইপিএস-এ যোগ দেন। এরপর শুরু আরও প্রস্তুতি। তবে পারছিলাম না! বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলাম। করোনা এল, অনিয়মিত হলো পরীক্ষা। চিন্তা বাড়ল, তবুও হারিনি। ১, ২, ৩ বার ব্যর্থ হয়েছি। চতুর্থবার সফল!
সহজ ছিল না পথ। অনেকেই বলবেন, আমার উচ্চবিত্ত পরিবার, চাপ কীসের! ছিল, মানসিক চাপ। বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতাম। প্রত্যেক মুহূর্তে ভাবতাম, সফল হব তো? হারিয়ে যাইনি! বাবা, পরিবারের সমর্থনে এগিয়েছি। বহু বন্ধু, সহপাঠীকে দেখেছি একাধিকবার সফল না হয়ে হারিয়ে গিয়েছেন! মাঝে মাঝেই শুনি, ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যার পথও বেছে নেন বহু! কেউ আর্থিক অনটনে পারেন না এগোতে! বাধা আসে। কিন্তু এগিয়ে যেতে হয় নিরন্তর। খারাপের পর ভালো আসবেই!
লড়াইয়ের নেপথ্যে আসলে কী ছিল? প্রথমে ছিল ইচ্ছা! তাগিদ! চেষ্টা! বারবার ব্যর্থতা এলেও এগিয়ে যাওয়ার আকাঙ্খা। আমি লড়াই চালিয়েছি। পড়াশোনা করেছি নির্দিষ্ট রুটিনে।
কীভাবে পড়েছি? ধরা যাক, পরীক্ষা এগিয়ে এসেছে। মাত্র দু'মাস বাকি। তখন পড়ার সময় বাড়াতে হবে। ভোরে উঠেছি রোজ। ৪টেয় উঠে টানা ৪ ঘণ্টা পড়েছি। এরপর বিশ্রাম। কিছু খেয়েই ফের পড়া। তারপর ঘুম, খাওয়া, স্নান। আবার দুপুর ২টো থেকে বিকেল পর্যন্ত পড়া। ফের বিশ্রাম। তারপর সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পড়া, এর সঙ্গেই প্র্যাকটিস। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তাম। একদিনে দুপুর-রাত মিলিয়ে গড়ে ৭ ঘণ্টা ঘুমিয়েছি। টিভি দেখেছি, সিনেমা কম দেখেছি। মোবাইল ফোন পড়ার প্রয়োজনের বাইরে দেখিনি। যুদ্ধ করেছি জীবনের সঙ্গেও।
আর্থিক অসুবিধা থাকলে পড়ার পিছনে এক নাগাড়ে সময় কীভাবে দেব? একথা ঠিকই! অর্থের প্রয়োজনও বড় ফ্যাক্টর! তবুও বলব, জীবনের দুটো বছর এর পিছনে দিন। যদি ইউপিএসসি উত্তীর্ণ হওয়ার ইচ্ছা হয়, তাহলে ওই বছরগুলোতে সবকিছু ত্যাগ করা উচিত। তাতেও যদি অসুবিধা হয় তবে, কোনও একটি কাজ করা উচিত, যা টাকাও দেবে খানিকটা, আবার সময় লাগবে না বেশি।
বাংলা থেকে এই পরীক্ষায় সাফল্যের হার অত্যন্ত কম। এক্ষেত্রেও প্রশ্ন ওঠে, কেন এমন? আমার ধারণা, সচেতনতার অভাব এর বড় কারণ। এই পরীক্ষা খুব কঠিন- এই ধারণা এবং প্রচারের বশে অনেকে এগোন না। আবার বেসরকারি চাকরিতে বেশি টাকা মাইনে, কম সময়ে আয়ের ইচ্ছা; সব মিলিয়ে এই পরীক্ষায় বসার ক্ষেত্রে বাধা থাকে। তবুও আমি বলব, চেষ্টা করতে। কঠিন কিছু নয়! লড়াইটা করতে হবে।
স্নাতকস্তরে পড়ার সময় থেকেই প্রস্তুতি শুরু। প্রথম পর্বে সিদ্ধান্ত নিই, কী কী করতে হবে সফল হতে গেলে! কী কী রয়েছে ইউপিএসসি সিলেবাসে? এই বিষয়টি নিয়ে ধারণা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। ঐচ্ছিক বিষয় নির্বাচন করা উচিত প্রথমেই। কোন বিষয় নির্বাচন করব, এই সিদ্ধান্ত প্রথমেই নিতে হবে! তারপর শুরু হবে ধারণা স্পষ্ট করা। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির জন্য ধার্য এনসিইআরটি (NCERT) নির্ধারিত পাঠ্যবই, যেমন ইতিহাস, ভূগোল-সহ একাধিক বই, যা সিলেবাসে আছে- সেই বইগুলো ভালো করে পড়তে হবে। কী করব, কী আসে পরীক্ষায়, এগুলো যখন বুঝে গেলাম ঠিক তারপরেই ওই পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই চর্চার দিকে নজর দিতে হবে। এখন অন্যান্য সময়ের চেয়ে বিষয়টি অনেক সহজ। অল্প টাকা দিয়ে অথবা বিনামূল্যেও ইউটিউব, গুগল খুললেই মকটেস্ট, প্র্যাকটিস সেট, পড়ার জন্য একাধিক নোটসও পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন- রূপান্তরকামী হিসেবে মোক্ষম জবাব সমাজকে, আলাপচারিতায় উচ্চমাধ্যমিকে সপ্তম স্মরণ্যা ঘোষ
প্রশ্ন ওঠে খরচ নিয়ে। কিন্তু অল্প টাকাতেই ভালো প্রশিক্ষণ নেওয়া সম্ভব। ডিজিটাল মাধ্যমে প্রচুর ক্লাস হয়। সামান্য ইন্টারনেট খরচ বহন করে ইউটিউব চ্যানেল মারফৎ জ্ঞান সংগ্রহ করা সম্ভব!
পরিকল্পনা করে পড়াশোনা দরকার। কোন দিন, কোন সময়ে, কী কী করব? এই বিষয়টি আগে ঠিক করা প্রয়োজন। আজকের কাজ কাল করব, এটা ভাবলে খুব একটা সহজ হবে না এই পথ। অর্থাৎ বই, অনুশীলন এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করে নিজেকে সার্বিকভাবে আপডেট করতে হবে। কারণ, বড় একটি পরীক্ষা দিচ্ছেন, যার ওজন অনেক বেশি। তাই অন্য সব পরীক্ষার সঙ্গে এর পার্থক্য বুঝতে হবে সবার আগে। পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে, কেন ব্যর্থ হলাম; এর সুলুকসন্ধান এবং তার নিরসন করা প্রয়োজন। ঘুরতে খুব ভালোবাসি। কিন্তু এর খপ্পরে পড়ে জীবনের একাধিক বছর কাটিয়ে দিয়েছি আলাদা কিছু না করেই। শুধু পড়েছি। অবসাদ এসেছে। বিরক্ত হয়েছি। তবুও পড়া চালিয়ে গেছি।
এখানে একটি বিষয় উঠে আসে, অবসাদ। মানসিক স্বাস্থ্য! যোগব্যায়াম, গান শোনা, শরীরচর্চা এক্ষেত্রে কাজের। নিজের লক্ষ্য ঠিক রেখে এগিয়ে যাওয়াটাই আসল। সব ছেড়েছি আবার জুড়েওছি। প্রেম করিনি। এখনও বিশেষ কোনও বন্ধু জোগাড় করতে পারিনি। পরিশ্রম যা আমাকে দিয়েছে, তা আরও ভালো করেছে আমার মন।
যাঁরা ভাবছেন এই পরীক্ষা দেবেন, তাঁরা কী করবেন? ইউপিএসসি দিতে চান যদি, তাহলে কলেজস্তর থেকেই প্রস্তুতি শুরু করুন। যাঁর সামর্থ্য আছে আলাদা করে কোচিং নিন। যাঁর নেই, ইন্টারনেটের শরণাপন্ন হন। চেষ্টা করুন। নির্দিষ্ট পথে, ভুলত্রুটি সংশোধন করে, প্রয়োজনের বাইরের সব ত্যাগ করে দিন। কারণটা বুঝতে হবে, এই পরীক্ষা চরম। এর শীর্ষে পৌঁছতে গেলে কঠিন পথ অতিক্রম করতেই হবে।
২৯৪তম স্থান নিয়ে আমি আপাতত ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিস জয়েন করব। আবার পরীক্ষাও দেব, আগামীতে আরও ভালো ফল করার জন্য। কিন্তু অনেকেই বলেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে সমাজ, দেশের জন্য কী করব? আমার পদের উপর ভিত্তি করে, কী কী আমার কর্তব্য সেইদিক বিবেচনা করে যা যা প্রয়োজন তাই করব! যদি আমি বিশেষ কিছু করার ক্ষমতা পাই, তাহলে দারিদ্র্য এবং শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে চাই। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা আর আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষের জন্য কিছু করা। বিশেষ করে, যাঁদের স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে, কষ্ট করতে ইচ্ছা হয় কিন্তু বাধা দেয় অর্থ। তাঁদের জন্যও সুযোগ এলে কাজ করতে চাই।
দরজা বন্ধ করে পড়েছি। খেটেছি। ব্যর্থ হয়ে হাউহাউ করে কেঁদেছি। কিন্তু হাল ছেড়ে দিইনি। মৃত্যুর কথা ভাবিনি। এই মনের খারাপ থাকা প্রসঙ্গে একটা কথা এখন বলা প্রয়োজন। রোজ দেখি রাজ্যে শিক্ষা, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি প্রশ্ন তুলছে! ইউপিএসসি বলুন বা বা অন্য, সবক্ষেত্রে শিক্ষার ভূমিকা অগ্রগণ্য! শিক্ষকরা জাতির মেরুদণ্ড। তাঁরা সমাজ তৈরি করেন। এক্ষেত্রে এমন অভিযোগ না ওঠাই ভালো ছিল।
আরও পড়ুন- বাংলা মাধ্যমে পড়েই ইউপিএসসি পরীক্ষায় বাজিমাত! কোন মন্ত্রে লুকিয়ে বাপ্পা সাহার সাফল্যের রহস্য
কথা প্রসঙ্গে মনে পড়ল, একজন আমলা হিসেবে নিজেদের মতামত প্রকাশ হয়তো সম্ভব নয়! কিন্তু শীর্ষ আদালতে সমলিঙ্গের বিয়ে নিয়ে একটা বিতর্ক চলছে। একজন প্রশাসনিক আধিকারিক হিসেবে যদি ক্ষমতা থাকত, বলতাম; আমি কাকে বিয়ে করব, কার সঙ্গে সম্পর্কে যাব, এটার অধিকার নিজের উপর থাকা উচিত!
আমার লক্ষ্যপূরণের জন্য রাজ্যের সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সিভিল সার্ভিস প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের তরফে সাহায্য আমি পেয়েছি। মেইন পরীক্ষা পাশের পরে, মক সাক্ষাৎকারের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানের সাহায্য ভীষণ কাজে লেগেছে।
যদিও বলা প্রয়োজন যে, এখানে তিনটি ধাপ রয়েছে। প্রথমে প্রিলিমিনারি। তারপর মেইন। তারপর সাক্ষাৎকার পর্ব। প্রথম ধাপে প্রায় সব বিষয়ের উপরে প্রশ্ন থাকে। পাশ করলে, ডাক পড়ে মেইন পরীক্ষার জন্য। প্রায় ১৭৫০ নম্বরের একাধিক বিষয়ে একটি দীর্ঘ পরীক্ষা এটি। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলে। এবার এই ধাপে সফল হলে আসে সাক্ষাৎকার পর্ব। প্রায় ৩০ মিনিট ধরে চলে সাক্ষাৎকার। দিল্লিতে হয় এই ধাপ। ইন্টারভিউ বোর্ডে থাকেন পাঁচজন। যাঁরা অধিকাংশই আইএএস, আইপিএস পদমর্যাদার। নিজের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য, পড়াশোনা সব মিলিয়ে আলাপচারিতা হয়। এবার তিনটি ধাপের প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হয়। সেই তালিকায় স্থান পাওয়া প্রায় ৯৫০ জন, তাঁদের ক্রমিক সংখ্যা অনুযায়ী বিভিন্ন পদে যোগ দেন। যেমন একেবারে প্রথম দিকে যাঁদের অবস্থান, তাঁরা আইএএস হন। এরপর আইপিএস, তারপর আইআরএস; এভাবেই চলে পদ্ধতি। গোটা দেশে মাত্র ১০-১২ হাজার পরীক্ষার্থী মেইন পরীক্ষায় বসেন, এর চেয়ে কমও হতে পারে! মেইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন কমবেশি ২৫০০! সেখান থেকে সাক্ষাৎকার পর্ব কাটিয়ে চূড়ান্ত সফল হন মাত্র ৯৫০ জন! শেষে বলব, কষ্ট করতে হবে। চেষ্টায় ব্রতী হতেই হবে। একাধিক বাধা আসবে। তবে পিছিয়ে গেলে হবে না। লড়াই করে অসাধ্যসাধন করাই একমাত্র পথ।