সরকারকে কাল ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিতে পারি না?

Charu Majumdar: অনন্ত সিংহ-রা জ্যোতি বসুকে অপহরণ করতে চাইতেন। চাইতেন বিধানসভা ওড়াতে। একটি বিস্ফোরক বোঝাই গাড়ি বানিয়েছিলেন তারা।

এ বিষয়টা নিয়ে আমি ভাবি। আপনারাও নিশ্চয়ই ভাবেন। গণতন্ত্রে ভোটব্যবস্থা আছে। মতদানের সুযোগ আসে। কিন্তু কারও কারও এমনও মনে হয়, হতে পারে, আর অপেক্ষা নয়, কালই বদল চাই। এই অনিয়মের তন্ত্র থেকে মুক্ত হতে চাই। চাই আর একটু স্বাধীনতা। দর্শন এদের হয়তো নৈরাজ্যবাদী বলবে।

এই কাজটা যে একেবারে অসম্ভব তা তো নয়, গত দেড় শতকে নিজের দেশে, নিজের রাজ্যে পালাবদলের ঘটনা আমরা দেখেছি। দেখেছি ব্রাজিলে, আমেরিকায়। কিন্তু, মন সবসময় নিয়মের শাসনে থাকে না। যখনই একটা স্থিতাবস্থা তৈরি হয়, সংকটে দম বন্ধ হয়ে আসে, তখনই এই প্রশ্নটা কারও কারও মনে দানা বাঁধতে শুরু করে। কালই বদল হতে পারে না? প্রশ্নটা এত অবধারিত হয়ে আসে কেন? কারণ, ভোট আমার শক্তি, আমি ভোট-ভৃত্য নই- এ কথাটা আমরা অন্তরে জানি। আমরা জানি, আমাদের কাজের জায়গায় 'পারফর্ম' করতে হয়। অন্যথা কাজ যায়। যে কাজগুলি আমরা নিজেরাও করতে পারতাম, সে কাজের ভার লাঘব করতে প্রতিনিধি বাছাই করেছি আমরা৷ তার কাজ নিজেকে প্রমাণ করা।

সদিচ্ছা আছে, এই কথায় চিঁড়ে ভিজবে না। পরিবারের প্রধান হোন, সংস্থার সিইও, মন্দিরের পুরোহিত বা রাষ্ট্রের মাথায় যিনি বসে আছেন তাকে, দায়বদ্ধতার প্রমাণ দিতেই হবে। যদি তিনি এ কাজে ব্যর্থ হন, তখন যার দৃষ্টি নির্মোহ, যে সংশয়ী সে বলবে, কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? এই লোকটাকে কি মাথায় করে রাখতেই হবে? এই লোকটাকে আমরা সরিয়ে দিতে পারি না? এই দলটার থেকে আমি পরিত্রাণ পেতে পারি না? সরিয়ে দেওয়ার যে ইচ্ছে, তা কতটা শক্তিশালী হতে পারে? অফিসের বস, ক্ষমতাসীন সরকারকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে, নাড়িয়ে দেওয়ার কথায় মানুষ কীভাবে জাগে? কীভাবে রাগে? কীভাবে তৈরি হয় নৈরাজ্যের নীল অপেরা? এই ধরনের অবিশ্বাসজাত অন্তর্ঘাত কতটা শক্তিশালী হতে পারে? ভাবতে বসে একজন মানুষের কথা মনে পড়ছে। চারু মজুমদার, যিনি সদলবলে সভা করেছিলেন। যার চিন্তার জোরে অস্ত্রের সমারোহে গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরেছিল লক্ষ লোক।

আরও পড়ুন- আমরা বনাম ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়ানো ওরা

১৯৪৭ এর এক শ্রাবণ নিশীথে যখন ভারতকে স্বাধীন ঘোষণা করা হল, তেলেঙ্গানা জ্বলছে জোতদারের হাতে চাষি খুনকে কেন্দ্র করে। কৃষকদের এই বিদ্রোহ যেভাবে দমন করা হয় তা কেউ কেউ মেনে নিতে পারেননি। এমনই একজন শীর্ণকায় ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার ব্যক্তিত্ব চারু মজুমদার। ১৯৬২-তে ভারত-চিন যুদ্ধ শুরু হল। চলল এক মাস তেইশ দিন ধরে। চিনপন্থী কমিউনিস্টদের জেলে ভরা হল। জেলেই পাঠচক্র খুলে ফেললেন চারু মজুমদার। প্রশ্ন তুললেন পার্টি চাষিদের সশস্ত্র করার ব্যাপারে কী ভাবছে। সহবন্দিদের সামনে তুলে ধরলেন মাও সে তুং-এর রুলবুক।

ছাড়া পেয়ে চারুবাবু ভোটে দাঁড়ান। মাত্র তিন হাজার ভোট পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, তার মানে সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে তিনহাজার জনগণ রয়েছে। মুখের কথায় কাজ হয় না। পাঁচ দফা দলিলে কর্মপন্থা লিখছেন তিনি। টিট ফর ট্যাট নীতি শেখাচ্ছেন বিদ্রোহীদের। নকশালবাড়ি, চটেরহাট অঞ্চলে শ্রীমজুমদারের এই দলিল ছড়িয়ে পড়ে। আরও একবার জেলে যেতে হয় চারুবাবুকে। কিন্তু চিন্তক বন্দি থাকলেও চিন্তা বন্দি থাকে না।

জোতদারদের ঘেরাও করে বন্দুক কেড়ে নেওয়া শুরু হল। কলেজভ্যালি চা বাগানের মহিলা শ্রমিকরা পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিল। এক চা শ্রমিক বীরে প্রধান মারা যান পুলিশের আক্রমণে। এই শাহাদাতে ক্রুদ্ধ ২৫০০০ শ্রমিক তীর, ধনুক, টাঙি, বল্লম নিয়ে শহিদ দিবস পালনে জড়ো হল। গণজাগরণে ভীত পুলিশ তীর ধনুক বহন, একসাথে পাঁচজনের চলাচল নিষিদ্ধ করল। জোতদারের পক্ষ নিতেও দেখা গেল পুলিশকে। ফলে গেরিলাযুদ্ধ সুদেমূলে বাড়তে থাকল। আসাম রাইফেলস-এর পুলিশের আচমকা আক্রমণে ৭ জন মহিলা ২ জন শিশু সহ মোট ১১ জন মারা গেলেন। নকশালবাড়ির আগুন দাবানল হয়ে ছড়াল গ্রামে বন্দরে নগরে প্রান্তরে। দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হলো- তোমার বাড়ি আমার বাড়ি / নকশালবাড়ি নকশালবাড়ি। ক্রমে চারুবাবুদের দল তৈরি হল।
উদ্ধুদ্ধ ছাত্ররা গ্রামে চলে গেল। সেরা বিপ্লবী গ্রামে যাও শ্লোগানে শহর ছেয়ে গেল।

শুরু হল অত্যাচার। বেলেঘাটা। ডায়মন্ডহারবার। কোন্নগর। বরানগর। ময়লার গাড়ি দেহ নিয়ে গেলে ভিস্তিওয়ালা রাস্তা ধুইয়ে দিত।

চারুবাবু নিশ্চয়ই জানতেন তাঁকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে তৈরি হওয়া নৈরাজ্যের দাম তাঁকে দিতেই হবে। অশক্ত শরীর, শ্বাসকষ্ট, ঘনঘন অক্সিজেন নিতে হয়। এই অবস্থায় ১৭০ মিডল রোড থেকে মধ্যরাত্রে গ্রেফতার হন চারু মজুমদার। ধরিয়ে দিয়েছিল দলের লোকই। অল্প কয়েকদিনেই মারা যান চারু মজুমদার। সামান্য ইনফরমারকে ধরলে যারা নখ উপড়ে নিত, বরফে শুইয়ে রাখত, তারা নিশ্চয়ই চারুবাবুকে পুষ্পস্তবকে বরণ করে নেননি। সব জেনেশুনেও কেন এ পথে গেলেন চারুবাবু? কারণ ওই, রাতারাতি ব্যবস্থাকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলার জেদ। দলের লোকই একসময়ে তাঁর মতাদর্শকে ধিক্কার জানিয়েছে। কিন্তু এ কথাও ঠিক, কৃশকায় মানুষটার চিন্তার ফলিত প্রয়োগে কয়েক লক্ষ বর্গমাইল জেগে উঠেছিল। সেই যে জেগেছে, আজও জেগে আছে তার ছায়া, রাষ্ট্রের মনে। ভোটের আগে তাই নকশাল খুনের খবরে উৎসব হয়। রাষ্ট্র যাকে পছন্দ করে না তাকেই বলে: তুই নকশাল।

চারুবাবুর উল্টোমেরুতে দাঁড়িয়েছিলে অনন্ত সিংহ। মাস্টারদা সূর্য সেনের শিষ্য। সেলুলার জেল ফেরত স্বাধীনতা সংগ্রামী। চারুবাবুর মতোই তাঁর উপলব্ধি। স্বাধীনতার স্বপ্ন ব্যর্থ হয়েছে। চাই সমাজবিপ্লব। কোন পথে আসবে বিপ্লব? অনন্ত চাইছিল, সদর দফতরে কামান দাগো-এই হবে নীতি। তৈরি হলো আরসিসিআই। একদিকে দল চালানোর টাকা জোগাড়, অন্যদিকে ক্রমে নগরদখল, ব্লুপ্রিন্ট বলতে এই। টাকা জোগাড় করতে অনন্ত সিংহ ধর্মতলায় বাসের ব্যবসা করেছেন। সিনেমা প্রযোজনা করেছেন। সদলবলে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করেছেন। অনন্ত সিংহের নেতৃত্বে কলকাতা শহরে যে চারটি মূল রাজনৈতিক ডাকাতি হয়েছে তার কাছাকাছি ডাকাতি আজ অবধি গোটা দেশে হয়নি।

অনন্ত সিংহ-রা জ্যোতি বসুকে অপহরণ করতে চাইতেন। চাইতেন বিধানসভা ওড়াতে। একটি বিস্ফোরক বোঝাই গাড়ি বানিয়েছিলেন তারা। গাড়িটি শহরে পুলিশের চোখ এড়িয়ে টহল দিত। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে হঠাৎ বিস্ফোরণে গাড়িটি উড়ে যায়।

১৯৬৯ সালের ১৭ জুলাই ইউসিস লাইব্রেরি এবং মার্কিন কনস্যুলেটে বোম মারা হয়। ওই বছর অগাস্ট মাসের ৮ তারিখ বোম বিস্ফোরণ হয়। ১২ আগস্ট বোম বিস্ফোরণ হয় লাইট হাউজে। এই সমস্ত অপরাধের পিছনে ছিল আরসিসিআই। দুর্গাপুরে একটা ব্যাঙ্কে এক কোটি টাকা ডাকাতি করতে গিয়ে তারা ধরা পড়ে। এই ডাকাতির আগে, একটি তেলের গাড়ি কলকাতা দুর্গাপুর রোজ যাতায়াত করত। অনন্ত সিংহদের পরিকল্পনা ছিল গাড়ির উপরের অংশে তেল থাকবে, নীচে থাকবে লুঠের টাকা। আরসিসিআই-এর একটা বড় অংশকে ধরা হয় জাদুগোড়ার গোপন ডেরা থেকে।

আরও পড়ুন- পথে যে বিবস্ত্র, সে আমার কেউ না

কেউ এখানে বলতে পারেন, অনন্ত সিংহ-রা এ টাকায় নিশ্চয়ই ফুর্তি করে থাকবেন। আমি অনন্ত সিংহর চ্যালা ব্রজ রায়কে দীর্ঘদিন দেখেছি। একটা দোতলা বাড়ির ছাদের ঘরে থাকতেন। মৃত্যুতে দেহটাও দিয়ে গিয়েছেন। নির্লোভ, বিশ্বাসে অটল মানুষ ছিলেন। শেষবার অসুস্থ হওয়ার আগেও আমায় বলেছেন, বিপ্লবের কাজ চলছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে ডাকাতি আর নৈরাজ্যের যোগ আমাদের ইতিহাসে ছিলই। ওরা চেয়েছিল সরাসরি রাইটার্সের দখল নিতে। ডাকাতির টাকায় নতুন সুব্যবস্থা চালু করতে। পুলিশ, সাধারণ মানুষকে ফাঁকি দিতে ওরা রাস্তায় টাকা ছড়াতে ছড়াতে যেত। হরির লুঠের মতো বিলানো টাকা কুড়োতে যখন সবাই ব্যস্ত, ততক্ষণে ওরা চলে যেত ধরাছোঁয়ার বাইরে।

১৯৭৭ সালে রাজ্যে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে ফোর্থ ট্রাইবুনালের বন্দিরা মুক্তি পান। যতদিন জেলে ছিলেন, আদালতে অনন্ত সিংহ নিজের হয়ে নিজেই সওয়াল করেছেন। জ্যোতি বসু অবশ্য নকশালদের ছাড়লেও অনন্ত সিংহকে ছাড়তে রাজি ছিলেন না। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশানাল, ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার এবং প্রমোদ দাশগুপ্তের উদ্যোগে অনন্ত সিংহ ছাড়া পান।

ঠিক যেমন চারু মজুমদার, তেমন অনন্ত সিংহও ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু একটু ভাবলে দেখা যাবে, সাফল্য-ব্যর্থতা এগুলি আপেক্ষিক। সরকারটাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে পারি কি না, এই প্রশ্নটা আমাকে কতটা রাগিয়ে তুলছে, সেটাই আসল।

More Articles