নিজেকে ভালোবাসো তুমি এবার, এ কথাটাই কী ভাবে শেখাবেন সন্তানকে!

স্যোশাল মিডিয়া, সেলফির যুগে আট থেকে আশি আমরা সকলেই নিজের 'লুক' সম্পর্কে খুব সচেতন। কিশোর- কিশোরী বা মাঝবয়সিদের অনেককেই বন্ধুদের বলতে শোনা যায় যেখানে তাঁকে ভালো লাগছে তেমন ছবি যেন ফেসবুকে পোস্ট করে। সব সময়েই নিজেকে পারফেক্ট হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা চোখে পড়ে। তবে গবেষণা বলছে মানুষের শারীরিক উপস্থিতি পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দেয় নিজের সম্পর্কে তিনি কী ভাবছেন। অনেকেই আছেন যাঁরা মনে করেন যদি সুযোগ থাকত নাকটা আর একটু টিকালো করার, কিংবা চোখগুলো আর একটু বড় হলে বা ছিপছিপে চেহারা থাকলে এই পেট নিয়ে সমস্যায় ভুগতে হতো না, দেখতেও সুন্দর দেখাতো অনেক। আপনার এই চিন্তা অজান্তেই  আপনার শরীর-মনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এসব ভাবনা ছেড়ে নিজেকে মন থেকে মেনে নিলেই ইতিবাচক ছবি ফুটে উঠবে আপনার চরিত্রে। নিজের সম্পর্কে ইতিবাচক ভাবনা আপনাকে সুস্থ জীবনযাপনে সাহায্য করবে। যার ফলে আপনার ব্যক্তিত্বে ইতিবাচক শক্তি এবং আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।

কিশোর বয়সে অনেকেই স্কুলের বন্ধুদের দ্বারা বা পরিবারের নিকটাত্মীয়ের কাছের শারীরিক গঠনের কারণে ঠাট্টার বিষয় হয়ে ওঠে। দীর্ঘকাল এমন ঘটনার সম্মুখীন হতে থাকলে নিজের শরীরকে ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করে তাঁরা। এই ঘটনার ফলে মানসিক এমনকী শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। দৃঢ় মানসিকতার অভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় কিশোর কিশোরী এবং মাঝবয়সীদের মধ্যেই এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। উদ্বেগ, হীনমন্যতা, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার এমনকি কারো কারো খাদ্যাভ্যাসও বদলে যেতে পারে একারণে। ঘন ঘন মেজাজ হারিয়ে চিৎকার করে ওঠে তাঁরা। আবার কেউ কেউ নিজেকে একঘরে করে ফেলে বাঁচার চেষ্টা করে কটূক্তির থেকে।অনেকের মধ্যে নিজেকে শেষ করে দেবার প্রবণতাও তৈরি হয়। অথচ কত সহজেই তাঁকে আমরা একটা সুস্থ জীবন দিতে পারতাম।নিজেকে ভালোবেসে বাঁচার সুযোগ করে দিতে পারতাম।তবে এই সমস্যা গোঁড়া থেকেই সারিয়ে তুলতে পারেন অভিভাবকরা। কী উপায়ে? আসুন বুঝে নেওয়া যাক- 

১. সরাসরি খোলামেলা আলোচনা করুন

কিশোর বয়সে অনেকেরই মনে হয় মা-বাবা ঠিকমতো বুঝতেই পারেন না তাঁদের। সবসময় শুধুই নির্দেশে দিয়ে চলেছেন। ফলে দুই প্রজন্মের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে।যে মূহুর্তে তাঁরা বুঝে যায় তাঁদের কথার গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না বা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে, ছেলেমেয়েরা নিজেদেরকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের উচিত তাঁদের গুরুত্ব দিয়ে শোনা। তাঁরা কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কথা বলছে, কি চাইছে সে ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা করা তাঁদের সাথে।

আরও পড়ুন-টিটেনাসের কারণ কি সত্যিই মরচে পড়া লোহা? যে তথ্য সামনে আসছে

২. নির্দিষ্ট কোনোদিকে মনোনিবেশ করা ঠিক নয়

কোনো একটি বিষয় নিয়ে বারবার কথা বলতে থাকলে তা অনেকক্ষেত্রেই বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে তাঁদের মনে বিরূপ মনোভাবের জন্ম দেয়। যেমন ধরুন অনেক কিশোর কিশোরী আজকাল ব্র্যান্ডেড জামাকাপড় পড়তে পছন্দ করে।অথচ আপনি বুঝতে পারছেন তাঁকে সেই পোশাকে মানাচ্ছে না কিন্তু এর আগে আপনি বলেও কাজ হয়নি। সেক্ষেত্রে অন্যভাবে ছেলে মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করুন যে স্বাচ্ছন্দ্যই পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিচার্য বিষয়, বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়।

৩. নিজের নিরাপত্তাহীনতার আঁচ পড়তে দেবেন না

আপনি যদি এমন পরিবেশে বড় হন যেখানে মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্যকেই তাঁকে বিচারের মাপকাঠি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, তবে নিজের অজান্তেই আপনার সন্তানের মধ্যেও সেই ধারণা প্রকট হয়ে উঠতে পারে। ফর্সা ত্বক কিংবা ছিপছিপে চেহারা দিয়ে কখনই মানুষের সৌন্দর্য বিচার করা সম্ভব নয়। বরং সুস্থ জীবন আপনাকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলবে সকলের কাছে।এগুলি এমন বিষয় যা নিয়ে প্রাপ্ত বয়স্করা খুব বেশি ভাবেন না তবে কিশোর বয়সে ছেলেমেয়েদের কাছে আপনার এই মতামত মনখারাপের কারণ হতেই পারে।

৪. স্বাস্থ্য- ব্যায়ামের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা

আজকাল ছেলেমেয়েদের অনেকের হাতেই স্মার্টফোন থাকায় তাঁরা গেম খেলা বা সিনেমা দেখার মতো কাজ করতেই বেশি পছন্দ করে। ফলে অল্পবয়সীদের অনেকের ওজনই বাড়তে থাকে। তাই তাঁদের  উৎসাহ দিন প্রতিদিন ব্যায়াম করায়। সাঁতার, ক্যারাটে বা তাঁদের পছন্দ মত কোনো খেলার প্রশিক্ষণও নেওয়াতে পারেন। এতে তাঁদের শরীর এবং মন দুইই সুস্থ থাকবে। 

৫. শরীর নিয়ে ছুঁৎমার্গ

এক্ষেত্রে ব্যক্তি তাঁর শারীরিক গঠন সম্পর্কে মাত্রাতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। প্রায়ই দেখা যায়, মানুষটি তাঁর শরীরের কোনও একটি অংশ বা কোনো ক্ষতচিহ্ন সম্পর্কে অতিরিক্ত সচেতন হয়ে আছেন। সবসময় এই সম্পর্কেই ভাবতে থাকে তাঁরা। অনেকসময় এই চিন্তাভাবনা এতটাই তীব্র হয়ে দাঁড়ায় যে অন্য আর কোনো কিছু ভাবতেই পারে না। জীবনের সমস্ত পরিসরেই এমন চিন্তার প্রভাব পড়ে ফলে তাঁর কর্মদক্ষতা কমতে থাকে। কিশোর কিশোরী এবং মাঝবয়সীদের ক্ষেত্রেই এ লক্ষণ বেশি দেখা যায়।
 
৬. শব্দের প্রয়োগ সম্পর্কে সচেতন হোন

ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলার সময় কী ধরনের শব্দ প্রয়োগ করছেন সে বিষয়ে অতিরিক্ত সচেতন থাকুন।অনেকই সন্তানদের মোটা বা অতিরিক্ত ওজনের কারণেই বিয়ে হচ্ছে না এমন মন্তব্য করে থাকেন। সাথে রয়েছে অন্যদের সাথে তুলনা টেনে কথা শোনানো। এধরনের মন্তব্য শরীর সম্পর্কে নিজের মনে সন্দেহ এনে দেয়।

৭. কঠোর ডায়েটের থেকে স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের পরামর্শ দিন

অভিভাবক হিসেবে সন্তানকে সরাসরি প্রশ্ন করুন ডায়েটের মূল লক্ষ্য কী? সুস্থ জীবনযাপন করা নাকি কিছু পোশাকে নিজেকে ফিট করা। সেক্ষেত্রে তাঁকে পরামর্শ দিন যেন ফাস্টফুডের বদলে স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করে প্রতিদিন। কিশোর কিশোরীদের অনেকেই উপবাসে থেকে বা  খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে ওজন কমানোর কথা ভাবে। কিন্তু এর ফলে শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের অভাব দেখা দেয়।তাই খাবার খাওয়া অত্যন্ত জরুরী একথা সন্তানকে বোঝান। 

৮. নিজেকে ভালোবাসতে শেখান

নিজেকে গ্রহণ করতে পারলেই ভালোবাসা সম্ভব। এক্ষেত্রে অভিভাবকদেরও সন্তানদের খুঁত ভুলে গ্রহণ করতে হবে। তাই তাঁদের নিজেকে ভালোবাসতে উৎসাহ দিন। বলুন তাঁর শারীরিক গঠন কখনই তাঁর প্রতি আপনার ভালোবাসা কমিয়ে দেবে না। বাইরের লোক কটুক্তি করলেও ছেলেমেয়ের পাশে দাঁড়ান। সমাজ তাঁকে তাঁর বাহ্যিক গঠন দিয়ে বিচার করলেও বাড়িতে নিজের সন্তানের জন্য সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করুন। সন্তানকে বলুন তোমার খারাপটা নিয়েই তোমাকে ভালোবাসি।তোমার খারাপ দিকটাকে সঙ্গে নিয়েই সবসময় ভালোবাসবো ভবিষ্যতে।

তবে এসবের পরেও অনেকের সমস্যা কমতে চায় না। সেক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের  পরামর্শ নিয়ে সাইকোথেরাপি এবং কাউন্সেলিং-এর সাহায্য নিতে পারেন। এতে সন্তানের চরিত্রে আত্মবিশ্বাস বাড়বে এবং নিজের সম্পর্কে তিক্ততা কমবে। 

More Articles