নকল গয়না, মোটা চালের ভাত, ট্যালটেলে মুরগির ঝোলের বিয়েবাড়িই বেশি টানে

Wedding Photography: পরিবারের অন্দরের গোপন কূটকচালি, অবৈধ সম্পর্ক, লুকিয়ে থাকা মুসলিম বিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ যা দেখলাম বই পড়ে বা সিনেমা দেখে সেই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হতো না।

গোড়ার কথা

ছোট শহরের নিম্নবিত্ত পরিবারের একমাত্র ‘ছেলে’-র বেশ খানিকটা টাকার গ্ল্যামারাস আইটি কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দেওয়া পর্দার ফারহান কুরেশির মতো সিনেমাটিক হয় না। কারণটা আবার ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের আফ্রিকা অভিযান নয়, উল্টে পাড়ার বাসন্তী লজে টুম্পা ওয়েডস টুকাইয়ের বিয়ের ছবি তোলা। একেবারে ছিছিক্কার কাণ্ড!

আজ থেকে বছর বারো আগে বিয়ে ব্যাপারটা এখনকার মতো বিপ্লবের জায়গা হয়ে ওঠেনি। আমাদের সমাজব্যবস্থা যদিও শুরু থেকেই ভীষণভাবে বিয়েকেন্দ্রিক তবু তখনও অব্দি বিয়ের আলোচনা 'কনে দেখতে কেমন', 'ছেলে কীসের চাকরি করে', 'পণ দিতে হচ্ছে কিনা' আর 'মাটন সেদ্ধ হলো কিনা' এইটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল। খুব বড়লোকরাও বিয়ে উপলক্ষ্যে ডোমেস্টিক এয়ারপোর্টকে ইন্টারন্যাশনাল বানিয়ে ফেলত না। এহেন সময়ে গ্রামগঞ্জ আর ছোট শহরের ‘ক্লায়েন্ট’-দেরকে তাদের পারিবারিক পারম্পরিক পাড়ার স্বপনদার স্টুডিওর ভরসাকে প্রশ্নের মুখে আনতে পারাটাই আমাদের মতো হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসা ‘শখের’ ফটোগ্রাফারদের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।

চাকরি ছাড়ব শুনে আমার দিদি বালিশ ভিজিয়ে বলল, “এই যদি করবি তাহলে এতদিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার কী দরকার ছিল?” দিদিকে বোঝাতে পারিনি যে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এই 'ডিসিশন মেকিং'-টাই শেখানো হতো।

প্রথমবার বড় কাজ পেলাম সুদূর উত্তরাখণ্ডের একটি ছোট শহরে। আমার বাবা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাননি যে আমি ও আমার টিমকে উত্তরাখণ্ডের কোনও ক্লায়েন্ট ছবি তোলার জন্য ‘হায়ার’ করতে পারে।

ক্লায়েন্টদেরকে এটুকু বোঝানো যেত না যে খরচ কোথায় হচ্ছে। তাঁদের বক্তব্য এখন তো সব ডিজিটাল। ছবি তুলতে আর রোল কিনতে হয় না, তাহলে তো কোনও খরচাই নেই। এমতাবস্থায় বিয়েবাড়ির ছবির মধ্যে আর্ট খুঁজতে যাওয়া বাতুলতা মাত্র।

আরও পড়ুন- কনসার্ট থেকে বিয়েবাড়ি- নেই সেই আবাহন, হারিয়েই যাবে বিসমিল্লার ‘পাগলা’ সানাই?

টক ঝাল মিষ্টি

এত চ্যালেঞ্জের মাঝেও অম্লমধুর ঘটনাও কম ঘটেনি। এক ক্লায়েন্টের বাড়ি মিটিং করতে গেছি। প্রথম দিন কনের মা বললেন, “দেখুন ‘আপনি’ কিন্তু আমাদের ক্যান্ডিড ছবি তুলবেন”। আমার উপর খুব একটা ভরসা না পেয়ে তিনি তাদের পুরনো অ্যালবাম থেকে আমাকে কিছু ক্যান্ডিড ছবি দেখালেন। দ্বিতীয়বার সামনাসামনি দেখা বিয়ের দিন ভোরবেলা। আমাদের কাজ করার ধরন দেখে একটু ভরসা পেয়ে বললেন, “শোনো বাবা, ‘তোমরা’ কিন্তু নিজেরা দেখেশুনে খেয়ে নিও, দেখছ তো আমরা কত ব্যস্ত"। তৃতীয়বার দেখা রিসেপশনের দিন। প্যান্ডেলে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছি। কনের মা এসে বাড়িতে গল্প করার মতো করে বললেন, “‘দেখেছিস’, জামাই কত ভালো হয়েছে।” অনেক বছর হয়ে যাওয়ার পরেও ওই পরিবারের সঙ্গে এখনও সুসম্পর্ক বজায় আছে।

আরেকবার একটি প্রিওয়েডিং শুটিং করতে উত্তর ২৪ পরগনার ধান্যকুড়িয়া গ্রামে গেছিলাম। মেয়ের দেশের বাড়ির গ্রাম। রুখা শুখা বাঁকুড়ার ছেলে জীবনে প্রথমবার চুই ঝাল বস্তুটির স্বাদ পেয়েছিলাম।

কখনও নীরব দর্শক হয়ে, কখনও বা বাড়ির প্রায় কাছের কেউ হয়ে বিভিন্ন পরিবারের অন্দরের গোপন কূটকচালি, অবৈধ সম্পর্ক, লুকিয়ে থাকা মুসলিম বিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ ইত্যাদি যা দেখলাম এই গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বই পড়ে বা সিনেমা দেখে সেই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হতো না।

দিল্লি বহু দূর

এক ছবি তুলিয়ে দাদা বারবার প্রশ্ন করত, "তুই নিজে অরিজিনাল কী করলি?" সত্যিই তো আমি নিজে অরিজিনাল কিছু করতে পারলাম কই! এই প্রশ্ন বারবার আমাকে তাড়া করে বেরিয়েছে। এখনও করে। অনেক টাকার চাকরি ছেড়ে ছবি তুলতে আসা শুধুমাত্র তো কয়েকটা পয়সার জন্য নয়, তাহলে ছবির মধ্যে সেই ভালোবাসা যদি ফুটে না ওঠে তাহলে করলাম কী?

ছোট শহরের তথাকথিত লোয়ার কাস্ট, লোয়ার ক্লাস পরিবারে জন্ম হওয়ার ফলে আমার বন্ধুবৃত্তও বরাবর আমারই মতো ছিল। বাণিজ্যিকভাবে কাজ করার শুরুর দিকে বিয়েবাড়ির কাজ আসত মূলত বন্ধুবৃত্ত ও তাদের পরিচিতদের থেকেই। কাজেই সেই সব কাজের তথাকথিত স্ট্যান্ডার্ডও আমারই মতো। সেই সময় সোশ্যাল মিডিয়ার এত রমরমা হয়নি। দেখে শেখার মতো ভালো জায়গা ছিল বেটার ফটোগ্রাফি ম্যাগাজিনটি কিন্তু সেখানে যেসব বিয়েবাড়ির ছবি দেখতাম সেগুলি মূলত উত্তর ভারতীয় এবং অত্যন্ত উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের। ফলত আমি ও আমার ক্লায়েন্ট উভয়েই পাড়ার বাসন্তী লজে, সাউথ দিল্লির ফার্ম হাউস বানানোর চেষ্টা করে যেতাম। বেশ কয়েক বছর বৃথা চেষ্টার পর বুঝতে পারলাম যে এই কাপের চা আমার নয়।

গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি সেলিব্রিটি বিয়ে এখনকার হবু দম্পতিদের মধ্যে এমন অদ্ভুত ধারণা গেঁথে দিয়েছে যে, শুধু মেট্রো শহর নয় গ্রাম-মফসসল-শহরতলি সব জায়গায় গিয়ে বরকনে, মণ্ডপসজ্জা সমস্ত কিছুই একই মনে হয়। শুধু মুখটা বদলে যায়। ভারতীয় জনগণ বহুযুগ ধরে বলিউডের নকল করে আসছে কিন্তু গত কয়েক বছরে সেই নকলনবিশি অন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে।

মূলত এই কারণেই ফাইভ-স্টার রিসর্টে এর কোনও বিয়েবাড়ির থেকে সুদূর গ্রামের টিমটিম করে আলো জ্বলা, নকল গয়না পরা, মোটা চালের ভাত আর ট্যালটেলে মুরগির ঝোল পরিবেশন করা বিয়েবাড়ি আমাকে অনেক বেশি টানে।

আরও পড়ুন- 4B Movement: বিয়ে-সন্তান-যৌনতাকে ‘না’! কেন এত জনপ্রিয় হচ্ছে এই আন্দোলন?

তার মানে কি যারা অনেক পয়সা খরচ করে, দারুণ লোকেশন বুক করে বিয়ে করছেন তারা ভুল করছেন? নিশ্চয়ই না। সবার পছন্দ আলাদা। কিন্তু এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখতে পাই হাজার হাজার বিয়ের ছবি যার মধ্যে আলাদা করার কিছু নেই। এর দায় তো ফটোগ্রাফারদেরই নিতে হবে। নতুন ধরনের কাজ যদি আমরা না করি তাহলে হবু দম্পতিরা জানবেন কীভাবে যে নতুন কিছুও হতে পারে কিনা।

এরকমই একটি অন্য ধরনের কাজ করতে পেরেছিলাম আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে। ভিক্টোরিয়া, মল্লিকঘাটে হাত ধরে ঘোরাঘুরি আর ব্যাকগ্রাউন্ডে অরিজিৎ সিংয়ের গানের ফরম্যাট ভেঙে প্রথমবার প্রি ওয়েডিং ভিডিও করেছিলাম কমেডির মতো করে।

 

অবশেষে সেই দাদাকে দেখাতে পেরেছিলাম, 'অরিজিনাল' কী করলাম।

More Articles