বউয়ের সিঙ্গল ছবি তোলা মানেই ভয়াবহ ঝামেলা

Wedding Photography: ভয়াবহ সমস্যা হচ্ছে হবু বউয়ের সিঙ্গেল ছবি তোলা। বিয়ের দিন হবু বউ বা বরের বাড়িতে এক-দুইখান পিসে, মেসো, কাকারা থাকবেনই যাদের বক্তব্য, অত ছবি না তুললেও হবে!

বিয়েবাড়ির ফটোগ্রাফার না কি ক্যামেরাম্যান? এই দু'টি নামের দ্বন্দ্ব চলছে গত প্রায় ১৫ বছর ধরে যখন থেকে এই ইন্ডাস্ট্রি বদলাতে শুরু করে ট্র্যাডিশনাল ফটোগ্রাফি থেকে সিনেমাটিক প্যাকেজের দিকে। নামের মানে প্রায় এক হলেও দামের পার্থক্য আছে বিশাল। সঙ্গে রয়েছে মর্যাদার ব্যবধান। আমি গত ১২ বছর ধরে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। নিজের চোখে দেখা কিছু ঘটনা না বললে, চিত্রটা পরিষ্কার হবে না।

বয়স তখন ২০, বাবার দেওয়া ক্যামেরা নিয়ে স্ট্রিট ফটোগ্রাফি শুরু করি। তবে এই ক্যামেরা কিনে দেওয়ার পেছনে সমর্থন ছিল আমার গৃহশিক্ষকের। বেসিক লেন্স দিয়ে ছবি তুলতে শুরু করে চাহিদা বাড়ল প্রাইম লেন্স কেনার। সেই সূত্রেই রোজগার করতে শুরু করি বিয়েবাড়ির ক্যামেরাম্যান হিসেবে। যদিও এই প্রফেশনে কেনাকাটার তো শেষ নেই। সেই প্রথম লেন্স থেকে এখনও ক্যামেরা বডি আর লেন্স কেনা চলছেই। এবার বলি, বিয়েবাড়িতে দু'ধরনের ক্যামেরাম্যান থাকেন। প্রথমত, যারা ফ্রিল্যান্সার অর্থাৎ যারা প্রত্যেকদিন টাকার বিনিময়ে কাজ করেন, আর দ্বিতীয়ত মালিকপক্ষ অর্থাৎ যারা বিয়েবাড়ির পুরো প্যাকেজ ধরেন, যাদের নামে কোম্পানি থাকে।

কেরিয়ারের প্রথম কয়েকবছর ফ্রিল্যান্সার হিসেবেই কাজ করেছি। তাতে শুধুই পেয়েছি টাকা না পাওয়ার অভিজ্ঞতা। কাজ শেখা হয়েছে বিস্তর, অভিজ্ঞতাও অনেকে উপার্জন করেছি। প্রাপ্য টাকা জোটেনি। এই এত বছর পরেও বহু মালিকপক্ষই ক্যামেরাম্যানের টাকা ঝেড়ে দেওয়ার রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ায়নি। এই অভিজ্ঞতার দৌলতে ২০১৭ সালে আমি আমার নিজের কোম্পানি শুরু করি, Momento Frezers। প্রথমে অবশ্য নতুন কোম্পানি বলে কেউ কাজ দিতে চায়নি, চেনাজানা সূত্রে খুব অল্প টাকায় কাজ করে নমুনা তৈরি করি। তারপর ধীরে ধীরে কাজ করতে করতে এখনও অবধি ১৫০-এর বেশি বিয়েতে কাজ করে ফেললাম।

আরও পড়ুন- বিয়েতে খরচ ৫০০ কোটি! ভারতের সবচেয়ে দামি বিয়ের উপহার শুনলে চোখ উঠবে কপালে!

গত ১২ বছরে ভালো-মন্দ মিলিয়ে বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। ক্লায়েন্ট এবং ফটোগ্রাফারদের প্রচুর ভুলত্রুটিও দেখেছি। এক এক করে সেই গল্পও বলা যাক। এই পেশাতে 'কলটাইম'-এর বিষয়টি ফটোগ্রাফারদের মাথায় রাখতেই হয়। দেখা গেল, ক্লায়েন্ট ভোর ৫টায় আসতে বলেছে। তাই সেই অনুযায়ীই দলবল নিয়ে হাজির হতাম। বেশিরভাগ জায়গাতেই দেখা যেত, ঠাকুরমশাই আসতে আসতে ৮টা বেজে গেল। অনেক জায়গায় কাজ শুরু হলো ১১টা থেকে! অর্থাৎ ৬ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে অন্যের বাড়ির ছাদে বসে কাটাতে হয়েছে, সঙ্গে মশার কামড় বিনামূল্যে।

আবার এই অভিজ্ঞতা থেকেই যখন অন্য কারও বাড়িতে ৩০ মিনিট দেরিতে পৌঁছলাম, সেখানে ক্লায়েন্টের কথাও শুনতে হয়। ঠাকুরমশাই দেরি করলে কিন্তু কেউ কিছু বলবেন না। যত দোষ ফটোগ্রাফারদেরই। আসলে সমাজে জাতপাত নিয়ে বৈষম্য তো আর গেল না! তাই বাধ্য হয়ে আমাদের একটা টাইম দিতে হয়, ধরা যাক সকাল ৯টা। তার আগে পৌঁছতে পারব না। আগে যেতে হলে 'এক্সট্রা পেমেন্ট'। এসবের পরে অবশ্য অনেকটা কাজই সময়মতো হয় এখন।

এক ভয়াবহ সমস্যা হচ্ছে হবু বউয়ের সিঙ্গেল ছবি তোলা। বুকিংয়ের সময় তিনি প্রতিশ্রুতি দেবেন যে, অনেক সময় দেবেন ছবি তোলার জন্য। বিয়ের দিন হবু বউ বা বরের বাড়িতে এক-দুইখান পিসে, মেসো, কাকারা থাকবেনই যাদের বক্তব্য, অত ছবি না তুললেও হবে! তাদের কথা শুনে ছবি বা ভিডিও না করা হলে টাকা পয়সা নিয়ে ঝামেলা।সেই ঝামেলা থেকে বাঁচতে কাকা-মামাদের সঙ্গেও বোঝাপড়া সারতেই হয়।

রইল এবার মেকআপ আর্টিস্ট! হয়তো একদিনেই দু'জনকে সাজাবেন, তাই দুপুর ১২টা থেকেই মেকআপে বসার জন্য তাড়া দেবেন। মেকআপের ছবি তুলতে দেওয়ার সময়টুকুও দেবেন না! ফলে ফেঁসে গেল কারা? আবারও সেই ফটোগ্রাফাররাই।

যুগ বদলেছে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে। হাতের মুঠোয় ভালো ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল ফোন। এখন আইফোনেও বিয়েবাড়ি শ্যুট হয়। যদিও আনকোরা মানুষ সেটা করতে পারেন না। আমরা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত, তারা এই কাজটা শিখেই পেশাতে এসেছি। কোন সময় কোন লেন্সের ব্যবহার, ডেপথ অফ ফিল্ড কী, কোন আলোর ব্যবহার হবে- এসব মাথায় রেখে কাজ করতে হয়। কিছুদিন আগেই একজন ক্লায়েন্ট আমাকে বললেন, "আমার বান্ধবীরা মোবাইলে এর থেকে ভালো ছবি তুলেছে। পেছনের দেওয়াল ঝাপসা করে দিয়েছে। আপনার ক্যামেরায় হয় না কেন?" এর উত্তর দেওয়া মানে সময় অপচয় মাত্র।

আরও পড়ুন- সমপ্রেমে সমস্যা নেই, সমকামের বিয়েতে কেন ‘না’ সুপ্রিম আদালতের?

তবে সবটাই কি ক্লায়েন্টের দোষ? আগাম টাকা নিয়েও কাজে না আসা, মূল বিয়ের দিন ফটোগ্রাফারের ঠাকুমা মারা যাওয়া, বিবাহবার্ষিকী চলে এলেও অ্যালবাম না দেওয়া, ফুটেজ উড়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি একদিন ৪টে কাজ নিয়ে যাকে-তাকে ক্যামেরা হাতে দিয়ে কাজে পাঠিয়ে দেওয়াও তো চলে!

তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা আমার মনে হয় বাজেট। আমরা বাঙালি বিয়েবাড়ি শ্যুট করি। বাজেট মাঝারি রাখার চেষ্টা করি। তাতে অনেকে আবার বলেন, এমন মাঝারি বাজেটের ফটোগ্রাফারদের জন্যই নাকি 'মার্কেট মাছের বাজার হয়ে গেছে'। সব মানুষের ১-১.৫ লাখ টাকা বাজেট থাকে না বিয়েতে ক্যামেরার পিছিনে খরচ করার। কেউ যদি কম পারিশ্রমিকে কারও স্বপ্নপূরণে এগিয়ে আসে, তাতে ক্ষতি কোথায়? যারা কাজ জানে, যাদের কাজের মান ভালো, তাদের ব্যবসার অভাব হবে না।

বিয়েবাড়িতে কাজ মানেই নিছক খারাপ অভিজ্ঞতা না। অনেক ক্লায়েন্টের সঙ্গে কাজের পরেও যোগাযোগ থেকে যায়। দাদা, ভাই, দিদি, বোন বা বন্ধুর মতো সুসম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। বিয়েবাড়ি থেকে এমন অনেক কাজ শেখ যায় যা অন্য ক্যামেরার কাজেও কাজে আসে। অদ্ভুত অদ্ভুত পরিস্থিতিতে কাজ সামলানোর দক্ষতা আসে। তবে মুহূর্তে পাল্টে যাচ্ছে প্রযুক্তি, তাই দক্ষতা বাড়ানো সবসময়ই দরকার। যারা লেখাটা পড়লেন তাদের সঙ্গে নিশ্চই কোনও না কোনও বিয়েবাড়িতে দেখা হবে ঠিকই! সেখানে আমাকে ক্যামেরাম্যান বলে ডাকলে কিন্তু রাগ করব না।

More Articles