একে ওয়েডিং ফটোগ্রাফার, তাও আবার মেয়ে!
Wedding Photography: পশ্চিমবঙ্গের বাইরে তাও ওয়েডিং ফটোগ্রাফির বাজারে মানুষের কিঞ্চিৎ সম্মান আছে। অথচ বাংলায় ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের বাইরে পেশা কেউ ভাবতেই পারে না আজও!
একে ওয়েডিং ফটোগ্রাফার, তাও আবার মেয়ে! সমাজের জোড়া সাঁড়াশি কেড়ে নিতে চায় সমস্ত স্বপ্নই। তবু, লরাই করে বাঁচার মজা আছে বলেই না পৃথিবীটা আকর্ষণীয় এখনও। বাড়ি আমার হাওড়ায়, আন্দুলে। মা, আমি আর পোষ্যকে নিয়ে ছোট্ট সংসার ছিল। আমার বাবা মারা যান ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সম্প্রতি বিয়েও করলাম। স্বামী অবশ্য ফটোগ্রাফির দুনিয়ার মানুষ নন। এই ওয়েডিং ফটোগ্রাফির বাজারে প্রায় বনবাসের মেয়াদ কাটিয়ে ফেললাম। আমার ওয়েডিং ফটোগ্রাফির সফর শুরু হয় ২০১০ সালের ১৫ অগাস্ট। বাড়িরই একটি ছোট্ট অনুষ্ঠান দিয়ে হাতেখড়ি। আমার এক জ্যেঠুর মেয়ের বিয়ে ছিল। মানে, ঘরের কাজ দিয়েই শুরু বলা যায়। আমার পরিবারে কিন্তু সকলেই প্রায় চাকরি করে। আমার বাবা-মা দু'জনেই আবার খেলাধুলোর জগতের মানুষ। মা একজন আন্তর্জাতিক জিমন্যাস্ট ছিলেন। বাবা ভারোত্তোলন, বডি বিল্ডিং করতেন। তাঁরা সবসময়ই চাইতেন আমি চাকরিটাই করি গুছিয়ে। ওয়েডিং ফটোগ্রাফার হব শুনে, তাই স্বাভাবিকভাবেই কেউই সমর্থন করেননি। চাপ ছিল যে চাকরি করতেই হবে। ফলে বাড়ির অমতে গিয়ে বড্ড লড়াই করতে হলো। ছবি তুলতে ভালো লাগত বটে, তবে এও ঠিক যে প্যাশনকেই প্রফেশন করব এমনটাও ভাবিনি কখনও।
আগে তো স্ট্রিট ফটোগ্রাফিই করতাম। এই পেশায় এত বছর কাটিয়ে বুঝেছি, ওয়েডিং ফটোগ্রাফি মানে মুহূর্তকে ধরে রাখা। মুহূর্ত ছবির মাধ্যমে তৈরি করতে হয়। আমি যদি স্ট্রিট ফটোগ্রাফি দিয়ে শুরু না করতাম তাহলে মূহূর্ত কীভাবে ধরতে হয় তা হয়তো শিখতেই পারতাম না। ইমোশন হোক বা মুহূর্ত, ক্যামেরায় তা ধরতে শিখেছি স্ট্রিট ফটোগ্রাফি করেই। ১৪ বছর কাটিয়েও ফেললাম এই পেশায়। ৫০০-র উপরে বিয়ের ছবি তুলেছি এই এক যুগেরও বেশি সময়ে।
আরও পড়ুন- বিশ্বে ৩২ টি দেশেই বৈধ, কেন সমকামী মানুষদের বিবাহের বিরুদ্ধে নরেন্দ্র মোদির সরকার?
আসলে অন্য অনেক কাজের মতোই, মেয়ে হিসেবে এই কাজে আসায় অনেক সমস্যা থাকে। বহু বাড়িতেই মেয়েদের এই পেশায় আসাকে আজও সমর্থন করা হয় না। আমি একটু ডাকাবুকো ঠিকই। সবটাইকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিল চিরকাল। এমনকী বিয়েটাও করেছি সেইভাবেই। আমি প্রথমেই বলে দিয়েছিলাম, আমি ওয়েডিং ফটোগ্রাফার। সেইটাকে মান্যতা দিয়েই যদি তাঁরা এগোতে চান, তবেই বিয়ে করব। অনেকক্ষেত্রেই তো দেখেছি মেয়ে চাকরি করলে ঠিক আছে কিন্তু ওয়েডিং ফটোগ্রাফার মেয়ে চলবে না। আবার ছেলেরা যাঁরা এই প্রফেশনে আছেন, তাঁদের সঙ্গীরা তাঁদের ছেড়ে চলে গেছেন কারণ পাত্রের নির্দিষ্ট চাকরি নেই, উপার্জনের নিশ্চয়তা নেই। কত দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ভেঙে যেতে দেখেছি। সবাই বলে যে, কোনও কাজই ছোট না, অথচ নিজের জীবনে তা মানতে পারে না।
বাবা যখন মারা যান, প্রবল ঋণের বোঝা মাথায় এসে পড়েছিল। অবস্থা এমন যে ঋণ না মেটালে বাড়ি ব্যাঙ্ক দখল করে নেবে। সেই সময় আমার প্রিয় সব ক্যামেরা আমাকে বিক্রি করে দিতে হয়েছিল। কোনওরকমভাবে বাড়িটা বাঁচাই আগে। তারপর প্রবল পরিশ্রমে একে একে কাজ করে করেই এগিয়েছি জীবনে। ওই কঠিন সময়ে আমার ওয়েডিং ফটোগ্রাফিই আমাকে বাঁচিয়েছিল। তাই সুসময়ে কীভাবে এই পেশাকে ছেড়ে বাঁচি! হ্যাঁ, সমাজে 'বিয়েবাড়ির ছবি তোলা' বিষয়টা এখনও ততটা পাতে দেওয়ার যোগ্য ভাবে না অনেকেই। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে তাও ওয়েডিং ফটোগ্রাফির বাজারে মানুষের কিঞ্চিৎ সম্মান আছে। অথচ বাংলায় ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের বাইরে পেশা কেউ ভাবতেই পারে না আজও! অথচ পশ্চিমবাংলার চাকরির পরিস্থিতিতে কি মানায় এটা?
আরও পড়ুন- বর্ধমানের রানি বসন্তকুমারীর পরকীয়া ও প্রথম বিধবাবিবাহ ।। ফিরে দেখা নাটকীয় আখ্যান
আমি যে সময় কাজ শুরু করি, প্রায় ১৪ বছর আগে, তখন প্রায় কোনও মহিলাই ছিলেন না এই পেশায়। আমি অন্তত দেখিনি কলকাতায় কাউকে। এখন অনেক অনেক মেয়েরা এগিয়ে এসেছেন। অর্থাৎ ধীরে ধীরে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। মেয়েরা পরিবার থেকে সমর্থনও পাচ্ছেন। এটা অবশ্যই একটা বড় বদল। তবে এই পেশায় মেয়েদের অসুবিধার দিকগুলিকে এখনও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। পিরিয়ডসের সময় ওয়েডিং ফটোগ্রাফির পেশায় থাকা মেয়েদের খুবই সমস্যা হয়। কাজ করতে করতে বাইরে বেরিয়ে নিজেকে সামলানোর সময়ও পাওয়া যায় না। নানা জায়গা এত অস্বাস্থ্যকর হয় যে ইনফেকশনের আশঙ্কা ভয়াবহ থাকে। টানা কাজের ফলে শৌচালয় যাওয়ার সময়ও পাওয়া যায় না। ক্লায়েন্ট ও সহকর্মীদের থেকে একটু সংবেদনশীলতা তাই অবশ্যই কাম্য।
ছবির ধরন রাতারাতি বদলে যাচ্ছে এই পেশায়। আগে বিয়েবাড়ির ছবি নিয়ে মানুষের যেমন ধারণা ছিল, তা অনেকটাই বদলে গেছে। আগে যখন ক্লায়েন্টদের জিজ্ঞেস করতাম কী কী চান, তাঁদের পরিবার বারবার বলতেন, খাবার জায়গার ছবি চাই। বিয়ে মানে শুধু বর-কনের ছবি তোলা না। সমস্ত মুহূর্তগুলো ধরাই তো আসল কাজ। ঝাঁ চকচকে ভেন্যুতে তোলা জমকালো ছবি নয়, অনেকসময় সেরা ছবি উঠে আসে একেবারে গ্রামের, পুরনো ধাঁচের বিয়েবাড়িতেও! আজকাল আর সব মুহূর্ত কেউ চান না তেমন। শুধু বরকনের লক্ষ লক্ষ ছবি! ওয়েডিং ফটোগ্রাফি স্মৃতি ধরে রাখার চাবিকাঠি। তাতে সমস্ত উদযাপনটাই ধরা উচিত। জীবনভর, সুখস্মৃতিই তো উল্টেপাল্টে দেখতে চায় মানুষ।