শরীরে রক্ত জমাট বাঁধা মানেই মৃত্যুফাঁদ! কীভাবে চিনবেন উপসর্গ
Thrombosis: রক্ত সংবহনের সময় আমাদের শরীরের যে কোনও জায়গায় হঠাৎই রক্ত জমাট বাঁধতে পারে, যা চিকিৎসা-বিজ্ঞানের ভাষায় থ্রম্বোসিস নামে পরিচিত।
ছোটবেলায় জীবনবিজ্ঞান বইতে আমরা পড়েছিলাম, মানুষের দেহে রক্ত সংবহনে সাহায্য করে শিরা এবং ধমনি। ধমনির মাধ্যমে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত বা বিশুদ্ধ রক্ত ছড়িয়ে পড়ে শরীরের প্রতিটি অঙ্গে। অন্যদিকে শিরা দূষিত রক্ত, অর্থাৎ কম অক্সিজেনযুক্ত রক্ত বহন করে। রক্ত সংবহনের সময় আমাদের শরীরের যে কোনও জায়গায় হঠাৎই রক্ত জমাট বাঁধতে পারে, যা চিকিৎসা-বিজ্ঞানের ভাষায় থ্রম্বোসিস নামে পরিচিত। থ্রম্বোসিস মৃত্যু পর্যন্ত বয়ে আনতে পারে। পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নিতে পারে মাত্র কয়েক মিনিটেই। বিশেষত হার্ট, মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধলে বড় বিপদ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিপদ-সংকেত হিসেবে শরীরে একাধিক লক্ষণ দেখা দেয়, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই তা উপেক্ষা করে যান। ফলস্বরূপ প্রতি বছর বিশ্বে বহু মানুষের মৃত্যু হয় এই কারণে। তাই সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে বলেই মনে করেন চিকিৎসকেরা।
থ্রম্বোসিস কী?
মানুষের শরীরের উপস্থিত রক্তনালিতে অস্বাভাবিক রক্ত জমাট বাঁধাকে থ্রম্বোসিস বলে। জমাট বাঁধা রক্তের দলাকে বলা হয় থ্রম্বাস। শরীরের যে-কোনও অংশে কাটাছেঁড়ার পর রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত পড়া বন্ধ হয়। এটা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু কোনও কারণে যদি অস্বাভাবিকভাবে রক্তনালির ভেতর রক্ত জমাট বাঁধে, তাহলে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। রক্ত প্রবাহিত না হওয়ার কারণে সেখানের কোশগুলির মৃত্যু হতে পারে এবং অঙ্গের কার্যক্ষমতা তা পুরোপুরি বা আংশিকভাবে নষ্ট করে দিতে পারে। মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধে ব্রেন স্ট্রোক পর্যন্ত হতে পারে। আবার হৃদযন্ত্রের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধার ফলে মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বা হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এছাড়াও শরীরের যে কোনও অংশের রক্তনালিতেই থ্রম্বাস তৈরি হতে পারে। রিপোর্ট বলছে, থ্রম্বোসিসের কারণে বিশ্বে প্রতি চার জন মানুষের মধ্যে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। কেউ কেউ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বা কেউ আবার পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন এই কারণে।
আরও পড়ুন: মাতৃগর্ভেই মৃত্যুফাঁদ! ভ্রূণেও নিরাপদ নয় শিশু, উদ্বেগ বাড়াচ্ছে সাম্প্রতিক গবেষণা
থ্রম্বোসিসের রকমফের
রক্তনালির ধরনের ওপর নির্ভর করে থ্রম্বোসিস প্রধানত দু'রকমের হয়।
১. ধমনির থ্রম্বোসিস: এক্ষেত্রে ধমনির মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। যেহেতু ধমনির মাধ্যমে আমাদের হৃদযন্ত্র এবং শরীরের অন্যান্য অংশে বিশুদ্ধ রক্ত সংবহন হয়, তাই এই ধরনের থ্রম্বোসিসের কারণে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে। হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক বিশ্বের বহু মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। ২৫ থেকে ৮৫, সকলেরই এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারণ হলো ধমনীতে গঠিত থ্রম্বোস।
২. শিরার থ্রম্বোসিস: শিরায় রক্ত জমাট বাঁধার ফলেও নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিরার মাধ্যমে আমাদের শরীরের বাকি অংশ থেকে দূষিত রক্ত হার্টে আসে। শিরায় থ্রম্বাস গঠন হলে ফুসফুসে রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়। শিরা বা ভেনাস থ্রম্বোসিস পালমোনারি এমবোলিজমের (ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধা) অন্যতম সাধারণ কারণ।
থ্রম্বাস তৈরির কারণ কী?
একাধিক কারণে শরীরে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। তবে রক্তনালিতে থ্রম্বোস তৈরির কিছু সাধারণ কারণ হলো:
১. এথেরোস্কলেরোসিসের মতো অবস্থা, যেখানে ধমনিতে কোলেস্টেরল বা প্লাক জমা হওয়ার কারণে প্রায়শই রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে। এক্ষেত্রে সংকীর্ণ পথ দিয়ে রক্ত সঞ্চালনের সময় প্লাকের কোনও অংশ ফেটে বা ভেঙে যাওয়ায় রক্তনালিতে থ্রম্বাস তৈরি হয়। প্রায়ই এই কারণে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় মানুষ। এছাড়া হার্টের ভালভের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, হৃৎপিন্ডর চেম্বারে সঠিকভাবে রক্ত পাম্প না হওয়ার কারণেও রক্ত জমাট বাঁধতে পারে।
২. এছাড়া অস্ত্রোপচারের পর যাঁরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, ক্যানসারে আক্রান্ত, দীর্ঘদিন চলাফেরা করতে পারেন না বা যাঁদের থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হওয়ার পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে, তাঁদের এই সমস্যা তৈরি হতে পারে।
৩. আবার দীর্ঘদিন ধরে ইস্ট্রোজেনযুক্ত ওষুধ ব্যবহার, অন্তঃস্বত্তা মহিলা বা সদ্যোজাতদের ক্ষেত্রেও হঠাৎ রক্ত জমাট বাঁধতে পারে।
থ্রম্বোসিসের লক্ষণ ও উপসর্গ
থ্রম্বাসের আকার এবং স্থানের ওপর নির্ভর করে নানারকম লক্ষণ দেখা দিতে পারে শরীরে। পায়ের পিছনে অবস্থিত রক্তনালির মধ্যে থ্রম্বাস তৈরি হলে পায়ের ডিমে বা থাই-এ ব্যথা হতে পারে। পায়ের পাতা ফুলে উঠে বর্ণহীন হয়ে যেতে পারে। রক্তপ্রবাহের অভাব হওয়ার কারণে অনেক সময় পা ঠান্ডা বা অসার মনে হয়। হৃদযন্ত্রের বা ফুসফুসের রক্তনালিতে থ্রম্বাস গঠন হলে শ্বাস গ্রহণের সমস্যা, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, বুকে ব্যথা অনুভব হয়; গভীর শ্বাস নেওয়ার সময় অবস্থা আরও গুরুতর হতে পারে। হার্টবিট বেড়ে যেতে পারে, মাথা হালকা অনুভব হয় এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। গুরুতর ক্ষেত্রে ত্বকে ফোসকা, ঘা বা ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে। নেক্রোসিস অর্থাৎ ত্বকের কোশের মৃত্যু হয়ে ওই স্থান কালো হয়ে যেতে পারে।
প্রতিরোধের উপায়
তবে থ্রম্বোসিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিশেষত বর্তমানে যে উন্নতমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তাতে এই ধরনের রোগ প্রতিরোধযোগ্য।
ডায়াবেটিস এবং হাইপারটেনশন রোগীদের আজই সাবধান হওয়া প্রয়োজন। স্মোকিং থেকে দূরে থাকতে হবে। সঠিক ডায়েট পালনের মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় অবশ্যই ভুষি আটা, পালিশ না করা ডাল, পরিশ্রুত জলে ধোয়া শাকসবজি, ফলমূল এবং সঠিক পরিমাণে ভিটামিনযুক্ত খাবার খাওয়া দরকার। এক্ষেত্রে প্রয়োজনমতো কোনও ডায়েটেশিয়ান দেখিয়ে ডায়েট চার্ট তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে।
এছাড়া অবশ্যই শরীরের ফিটনেস বজায় রাখতে হবে। নিজেকে কর্মক্ষম রাখতে হবে। এরোবিক্স বা যোগার মাধ্যমে শরীর সুস্থ রাখা যেতে পারে। তবে শরীর সুস্থ রাখার সবথেকে ভালো উপায় হলো প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটার অভ্যাস গড়ে তোলা। বর্তমান জীবনে প্রতিটি মানুষ স্ট্রেস এবং টেনশনে ভোগেন। স্ট্রেস ও টেনশন থেকে বাঁচতে মেডিটেশন এবং প্রাণায়াম করা যেতে পারে। এছাড়াও জীবনযাত্রা ঠিক রাখতে হবে। অল্পতেই রেগে গেলেও অনেক সময় থ্রম্বোসিস দেখা দিতে পারে। তাছাড়াও থ্রম্বোসিসের কোনও লক্ষণ প্রকাশ পেলে ফেলে না রেখে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তবেই সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারবেন।