করমণ্ডল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা হয়ে মুম্বই মেল! কেন বারবার দুর্ঘটনার কবলে ভারতীয় রেল?
Train Accidents in India: এদিকে দুর্ঘটনার কোনও শেষ নেই দেশ জুড়ে। একের পর এক রেল দুর্ঘটনা কার্যত সামনে এনে দিয়েছে সাধারণ রেলযাত্রীদের নিয়ে দেশের সরকারের চরম গাফিলতি ও অবহেলার কথাই।
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের ভয়াবহ দুর্ঘটনার স্মৃতি এখনও টাটকা। তার রেশ কাটতে না কাটতেই পর পর ঘটে গেল আরও দুটি রেল দুর্ঘটনা। গত জুন মাসে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের সঙ্গে ধাক্কা লাগে একটি মালট্রেনের। সেই দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ছিল ৫০, জখম বহু। সেই ঘটনার তদন্তরিপোর্ট সামনে আসতে আসতেই ঘটে গিয়েছিল আরও একটি দুর্ঘটনা। জুলাইয়ের গোড়ায় উত্তরপ্রদেশের গোন্ডায় লাইনচ্যুত হয় চণ্ডীগড়-ডিব্রুগড় এক্সপ্রেস ট্রেনের বেশ কয়েকটি বগি। যে দুর্ঘটনায় চার জন নিহত এবং অন্তত ২০ জন আহত হওয়ার খবর মিলেছে। আর সেই দুর্ঘটনার ঘনঘটা থামল না সেখানেও। মঙ্গলবার ফের দুর্ঘটনার কবলে পড়ল ট্রেন। ভোর রাতে লাইনচ্যুত হল হাওড়া-মুম্বই মেলের ১৮টি বগি। চক্রধরপুরের কাছে বড় বাম্বু গ্রামে গ্রামে ঘটেছে দুর্ঘটনাটি।
কিছুদিন আগেই মোদি ৩.O সরকারের পূর্ণাঙ্গ বাজেট প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন। আগে রেলের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা বাজেট পেশ করা হত। সে দিন গিয়েছে। তার পরেও অবশ্য কেন্দ্রীয় বাজেটে বিশেষ গুরুত্ব পেত রেল ব্যাপারটি। যদিও এবারের বাজেটে রেল নিয়ে তেমন কোনও বড় ঘোষণা শোনা যায়নি নির্মলার মুখ থেকে। বন্দে ভারতের মতো বিলাসবহুল ট্রেনের কথা থাকলেও সাধারণ যাত্রীবাহী ট্রেনের সুরক্ষার ব্যাপারে একটি কথাও ছিল না কেন্দ্রীয় বাজেটে। অথচ রেল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, টাকার অভাবেই নাকি সাধারণ যাত্রীবাহী দূরপাল্লার ট্রেনগুলিকে সুরক্ষা কবচ লাগাতে পারা যাচ্ছে না। এদিকে বন্দে ভারতের মতো বিলাসবহুল ট্রেনের এক সপ্তাহের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ চোখ কপালে তোলার মতোই।
এদিকে দুর্ঘটনার কোনও শেষ নেই দেশ জুড়ে। একের পর এক রেল দুর্ঘটনা কার্যত সামনে এনে দিয়েছে সাধারণ রেলযাত্রীদের নিয়ে দেশের সরকারের চরম গাফিলতি ও অবহেলার কথাই। শুধু যে সুরক্ষা কবচ বসানো হয়নি ট্রেনে, তা-ই নয়। প্রায় প্রতিটি ধাপে ধাপে রেলমন্ত্রকের চরম আলস্যি ও গাফিলতি প্রকাশ্যে এসেছে বারংবার। কখনও দোষ দেওয়া হয়েছে চালকের ঘাড়ে, কখনও সিগন্যালিংয়ের সমস্যাকে দুষে মাথা বাঁচাতে চেয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সমস্যা আসলে গোড়াতেই। 'বন্দে ভারতে'র মতো উন্নতমানের ট্রেনকে ভারতীয় রেলের মুখ বানাতে গিয়ে সরকার অবহেলা করে গিয়েছে সাধারণ যাত্রীবাহী ট্রেনকেই, যা আসলে ভারতীয় রেলের প্রতি মানুষের ভরসাতে তলানিতে এনে ঠেকিয়েছে। শুধুমাত্র কাঞ্চনজঙ্ঘা বা চণ্ডীগড়-ডিব্রুগড় এক্সপ্রেস নয়, গত কয়েক মাসে বা বছরে এমন রেলদুর্ঘটনার সংখ্যা অজস্র। যাতে প্রাণ গিয়েছে অসংখ্য যাত্রীর। অথচ গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে তাঁরা টিকিট কেটে কিনে এনেছেন আসলে দুর্ভাগ্য। আজকের ভারতে রেলযাত্রার মতো ঝুঁকির বোধহয় আর কিছুই নয়।
আরও পড়ুন: ২ মাসে তিনবার! ত্রাসের নাম ভারতীয় রেল! এবার ১৮ টি বগি লাইনচ্যুত হাওড়া মুম্বই মেলের!
গত বছর জুন মাসেই একই রকম একটি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল করমণ্ডল এক্সপ্রেস। ২ জুন সন্ধে সাতটা নাগাদ ওড়িশার বালেশ্বরের বাহানগায় মালগাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষে লাইনচ্যুত হয় করমণ্ডল এক্সপ্রেস। ২৯৬ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন ওই দুর্ঘটনায়। আহত হয়েছিলেন প্রায় ১২০০ জন। সেই দুর্ঘটনাতেও সিগন্যালিংয়ের ত্রুটির কথা উঠে আসে রিপোর্টে। সিগন্যাল বিপত্তির জেরেই করমণ্ডল এক্সপ্রেস লুপ লাইনে চলে গিয়েছিল। আর তারপরই বাহানাগা বাজার স্টেশনে সেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মালগাড়িতে গিয়ে সজোরে ধাক্কা মারে এই এক্সপ্রেস ট্রেন। মালগাড়ির উপর উঠে যায় করমণ্ডলের ইঞ্জিন। ৮ জুন। দুপুর ৩টে নাগাদ উটি থেকে মেট্টুপালায়ামগামী নীলগিরি মাউন্টেন রেলের একটি কামরা কুন্নুরের কাছে লাইনচ্যুত হয়। এর এক দিন পরেই লাইনচ্যুত হয় বিজয়ওয়াড়া-চেন্নাই সেন্ট্রাল জনশতাব্দী এক্সপ্রেসের একটি কামরা। চেন্নাই সেন্ট্রাল থেকে কারশেডের দিকে যাচ্ছিল ওই ট্রেন। এর দু’দিন পর আবার চেন্নাই সেন্ট্রাল থেকে তিরুভাল্লুর যাওয়ার পথে লোকাল ট্রেনের একটি কোচ বেসিন ব্রিজ স্টেশনের কাছে লাইনচ্যুত হয়। ২২ জুন চেন্নাই থেকে মুম্বইগামী লোকমান্য তিলক এক্সপ্রেসের একটি কামরায় আগুন ধরে যায়। ২৫ জুন নাগাদ বাঁকুড়ার ওন্দাগ্রাম স্টেশনের কাছে লুপ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মালগাড়িকে পিছন দিক থেকে সজোরে ধাক্কা মারে অন্য একটি মালগাড়ি। ঘটনায় চলন্ত মালগাড়ির ইঞ্জিন-সহ বেশ কয়েকটি বগি বেলাইন হয়ে ছিটকে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় দু’টি মালগাড়ির মোট ১৩টি বগি। রেল সূত্রে খবর, এই দুর্ঘটনার জেরে রেলের ১০০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছিল।
ওই বছরের অগস্ট মাসে মাদুরাই স্টেশনের কাছে লখনউ-রামেশ্বরম ভারত গৌরব ট্রেনের একটি কামরায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনায় ৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আহতের সংখ্যা ছিল ২০ জনেরও বেশি। রেলের তরফে জানানো হয়েছিল, এক্সপ্রেস ট্রেনের ওই কামরাটি ব্যক্তিগত ভাবে ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। ওই কামরার যাত্রীরা আসছিলেন লখনউ থেকে। কামরায় একটি গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। সেখান থেকেই বিপত্তি। ২০২৩ সালের ১১ অক্টোবর তারিখ বিহারে ট্রেনদুর্ঘটনাটি ঘটে। তারপরেই ২৯ অক্টোবর রাত ৯টার একটু পরে অন্ধ্রের কোট্টভালাসা স্টেশনের কাছে বিশাখাপত্তনম-রায়গাদা এবং বিশাখাপত্তনম-পালাসা প্যাসেঞ্জার ট্রেনের সংঘর্ষে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন প্রায় ৫০ জন। এর দু’দিন পরে গাজিপুর থেকে দিল্লির আনন্দ বিহারগামী সুহেলদেও সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজের কাছে লাইনচ্যুত হয়। এর পরের মাসে উত্তরপ্রদেশের ইটাওয়ার কাছে দিল্লি-দ্বারভাঙা সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসে আগুন ধরে যায়। এই দুই ঘটনাতেই কেউ মারা যাননি। তবে বেশ কয়েক জন যাত্রী আহত হন। নতুন বছরের শুরু থেকেই তাড়া করেছে দুর্ঘটনার স্মৃতি। ২৮ ফেব্রুয়ারি নাগাদ ঝাড়খণ্ডের জামতাড়ায় একটি দুর্ঘটনা ঘটে পূর্ব রেলের আসানসোল ডিভিশনের বিদ্যাসাগর ও কাশিটার স্টেশনের মাঝে। লোকাল ট্রেনের ধাক্কায় দু’জন যাত্রীর মৃত্যু হয়। ডাউন অঙ্গ এক্সপ্রেসে আগুন লেগেছে বলে ভুয়ো খবর যাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এর পর যাত্রীরা চেন টেনে অঙ্গ এক্সপ্রেস থামিয়ে দেন বলে খবর। ট্রেন থেকে নেমে রেললাইন ধরে হাঁটার সময় আসানসোল-ঝাঝা লোকাল ট্রেনের ধাক্কায় দু’জনের মৃত্যু হয়। আহতও হন অনেকে।
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট হাতে এলে রেল কর্তৃপক্ষের একগুচ্ছ গাফিলতির কথা সামনে আসে। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস সংক্রান্ত সাম্প্রতিক এই তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থায় ট্রেন চলাচল পরিচালনা করার মতো উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব ছিল ট্রেনচালক, ট্রেন ম্যানেজার এবং স্টেশন মাস্টারের। মালগাড়ির চালক নির্দিষ্ট গতিতে গাড়ি ছুটিয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে আগেই প্রশ্ন উঠেছিল। রিপোর্টও বলছে, মালগাড়ির চালককে দেওয়া কাগুজে অনুমতিপত্রে (মেমো) নির্দিষ্ট গতির কথা উল্লেখই করা হয়নি। এমনকি, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা খারাপ থাকলে যে পদ্ধতিতে ট্রেন চলানো উচিত, তা মানা হয়নি। এই ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট যে ফর্মে ট্রেন চালানোর অনুমতি দেওয়া হয় চালক এবং ট্রেন ম্যানেজার (গার্ড)-দের, রাঙাপানির স্টেশন মাস্টার তা দেননি বলেই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। সঠিক নিয়ম না-জানার কারণেই এমনটা হয়েছে বলে সুরক্ষা কমিশনার তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন। দুর্ঘটনার পরে পরেই জানা যায়, রাঙাপানি এবং চটেরহাট স্টেশনের মধ্যবর্তী অংশে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বন্ধ থাকায় ‘কাগুজে সিগন্যাল’ দিয়ে চালানো হচ্ছিল ট্রেন। সুরক্ষা কমিশনারের সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাঙাপানি স্টেশনের স্টেশনমাস্টার দু’টি ট্রেনের চালক এবং গার্ডকে কাগুজে সিগন্যাল হিসাবে ‘টি৩৬৯ (৩বি) এবং ‘টিএ-৯১২’ ফর্ম দিয়েছিলেন। সেখানে চালকদের লাল সিগন্যালকে ‘অন’ হিসাবে মান্যতা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলেও ট্রেনের সর্বোচ্চ গতিবেগ কত রাখতে হবে, তা ঠিকমতো উল্লেখ করা হয়নি। এখানেই শেষ নয়। রিপোর্টে এ-ও জানানো হয়েছে, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে সামনে দেখে আপৎকালীন ব্রেক কষেছিলেন মালগাড়িটির চালক। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মালগাড়ির গতিবেগ নামিয়ে এনেছিলেন ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটারে। তার পরেও দুর্ঘটনা এড়ানো যায়নি। কারণ, দু’টি ট্রেনের মধ্যে ব্যবধানিক দূরত্ব ছিল একেবারেই কম। উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য সুরক্ষা কমিশনার তাঁর রিপোর্টে জানিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে ‘টিএ-৯১২’ ফর্ম নয়, নিয়ম অনুযায়ী ‘টিডি-৯১২’ ফর্ম দেওয়া উচিত ছিল। স্টেশন মাস্টারের ভূমিকা নিয়েও রিপোর্টে ওঠে প্রশ্ন।
আরও পড়ুন: লাইনচ্যুত কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস, মৃত ৫! কীভাবে ঘটল ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা?
কাঞ্চনজঙ্ঘা কাণ্ডের পরেই চণ্ডীগড়-ডিব্রুগড় এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা এবং মঙ্গলবার ভোর রাতে হাওড়া-মুম্বই মেল। কী ভাবে দুর্ঘটনা ঘটল, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে রেলের এক পদস্থ কর্তা জানিয়েছেন, যে জায়গায় মুম্বইগামী ট্রেনটি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে, তার কাছেই একটি মালগাড়িও বেলাইন হয়েছে। তবে এই দু’টি দুর্ঘটনার মধ্যে কোনও যোগ রয়েছে কি না, তা এখনও জানা যায়নি। প্রশ্ন উঠেছে, এ ভাবে আর কত? কেন এত দুর্ঘটনা সত্ত্বেও কোনও মতেই টনক নড়ছে না সরকারের? কেন রেলের যাত্রীসুরক্ষা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না মন্ত্রক? আর কত দুর্ঘটনার পরে যাত্রীদের নিরাপত্তা কথা ভাববে রেল? উত্তর বোধহয় নেই।