এক চিলতে জমি থেকেই আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন, যে দাগ রেখে যাচ্ছে ছোট প্রকাশনা

International Kolkata Book Fair : 'মান্দাস', 'বৈভাষিক', 'ধানসিড়ি', 'তবুও প্রয়াস' সহ শতাধিক তথাকথিত ছোট ছোট প্রকাশন সংস্থাগুলিই এবছর কলকাতা বইমেলার মূল আকর্ষণ...

সংখ্যাটা প্রায় ৩০০ ছুঁইছুঁই। কলকাতা বইমেলার এবারের মূল আকর্ষণ নামী, বেনামী অজস্র ছোট প্রকাশন সংস্থা। নামজাদাদের ভিড়ে একফালি টুকরো জমি জুটেছে যাদের, যারা ছোট পরিসরে কাজ শুরু করেও প্রতিনিয়ত স্বপ্ন বুনছে, সেই তথাকথিত কম নাম করা প্রকাশন সংস্থাগুলোই এবারের কলকাতা বইমেলার মূল আকর্ষণ। বইমেলার মস্ত বড় ম্যাপে আলাদা করে নাম রয়েছে তাদেরও।

কলকাতা বইমেলা, বইপ্রেমী বাঙালির চতুর্দশ পার্বণ। সারা বছর বই নিয়ে চলা একটা যাপনের সামগ্রিক উদযাপন। বই পাড়ায় যাদের মস্ত দোকান, অথবা যাদের এক চিলতে ঘর ভাড়া দেওয়ারও পয়সা জোটে না, কিংবা যাদের ঘর নেই, সেই সবাই মিলেমিশে যায় করুণাময়ীর প্রাঙ্গণে। বছরে এই বারোটা দিন যেন লাগামছাড়া। পুরনো বন্ধুকে ফিরে পায় কেউ, কেউ আবার একাই ঘুরতে ঘুরতে নতুন কোনও বন্ধু খুঁজে পায় মেলা প্রাঙ্গণে। বইয়ের ভিড়ে কখনও উঁকি দেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, কখনও আবার তাদের ঠিক পাশেই জায়গা জুটে যায় নদিয়া অথবা বাঁকুড়ার কোনও অনামী লেখকেরও। মিলাবে... মিলিবে, এই আমাদের কলকাতা বইমেলা।

কোনওটার আনুষ্ঠানিক বয়স সাত বছর, কোনওটার আবার মাত্র সাত মাস, তবে ভাবনায় প্রত্যেকেই যৌবন পেরিয়েছে বলা চলে। স্কুলের ডেস্কে, কলেজ ক্যান্টিনের আড্ডায়, মিছিলের বন্ধুত্বে অথবা কাজের পরিসরে একটু একটু করে লালন করা ভাবনাগুলোই অতঃপর জন্ম দিয়েছে একটা প্রকাশনা সংস্থার। যে কোনও কাজই যখন শুরু হয় তখন তাকে আপাতভাবে মনে হয় ছোট। আজ যে সমস্ত প্রকাশনা খুব নাম করেছে, যেমন ধরা যাক, ‘দে’জ’ অথবা ‘আনন্দ’-এর মতো কিছু নাম, তাদেরও শুরুর দিনটাই এমন ভরপুর ছিল না। অনেক চড়াই উৎরাই, ভাঙা গড়ার সফর শেষে তবেই নতুন সূর্যের হদিশ মেলে। ঠিক যেমনটা মিলবেই ‘বৈভাষিক’, ‘মান্দাস’, ‘ধানসিড়ি’ অথবা ‘তবুও প্রয়াস’-এর মতো প্রকাশনীতেও।

আরও পড়ুন - প্রকাশনা নিয়ে স্বপ্ন দেখবে তরুণ-তরুণীরা? বইমেলা যে পথ দেখাল

‘বৈভাষিক’-এর অদ্বয় চৌধুরীর সঙ্গে এই বিষয়ে কথা হতেই তিনি জানালেন, “বড়ো হোক বা ছোটো, প্রতিটি সংস্থার একেবারে নিজস্ব ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনা আছে। সবাই নিজের নিজের জায়গায় সফল হবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই একেবারেই। কিন্তু তাও স্বাতন্ত্র্য অবশ্যই আছে। হ্যাঁ, ছোটো সংস্থা অবশ্যই বড়ো সংস্থাকে দেখে শেখে। অগ্রজদের ফলো করার সুবিধে এই যে অনেক সময়েই তা ব্যর্থতার স্বাদ গ্রহণ করা থেকে আটকায় নিজেদের। মানে, ঠেকে এবং ঠকে শেখার হাত থেকে রক্ষা করে। কিন্তু তারপরেও স্বাতন্ত্র্য বাই ডিফল্ট থেকেই যায়।”

এই যে স্বাতন্ত্র্য-এর কথা উঠল, তার প্রমাণ অবশ্য মেলে এই সব সংস্থাগুলোর কাজেই। কথায় কথায় ‘তবুও প্রয়াসের’ সেলিম মন্ডল বলছিলেন, “নামী লোকেদের কথা তো অনেকেই বলেন। তবে নতুনদের কাজের সুযোগ দেওয়ার লক্ষ্যেই কাজ শুরু করেছিলাম আমরা। এই ধরুন গ্রাম মফস্বলের যে ছেলেটার কাজ কেবল সুযোগের অভাবে জনসমক্ষে আসতে পারেনি কোনও দিন, সেই কাজগুলোকে খুঁজে বের করাই আমাদের কাজ।”

kolkata book fair

বইমেলায় 'তবুও প্রয়াস'-এর স্টল

কোনও কাজ কে করছে সেটা বড় কথা নয়, বরং কাজটা কী? সেই কাজ থেকে মানুষ কী কী পেতে পারেন সেটাই হল ভালো কাজের স্বতন্ত্র হয়ে ওঠার মূল লক্ষ্য। ঠিক তাই ‘মান্দাস’ প্রকাশন সংস্থার প্রকাশিত বইয়ের তাকে জীবনানন্দের ঠিক পাশেই জায়গা পেয়ে যায় তরুণ লেখক অর্ক দেবের গবেষণামূলক বই ‘দিয়েগো থেকে মারাদোনা' অথবা রঙ্গন নিয়োগীর ‘বাঙাল বাড়ির রান্না’। শুধু যে জায়গা পেয়ে যায় এমন নয়, তার সঙ্গে বই বাজারের মনস্তত্ত্বের হদিশও খুঁজে নেয় তারা নিমেষেই। ব্যবসার হালচাল বুঝেই পাস বাড়ায় পাঠকের দিকে। তাই কর্ণধার সুকল্প চট্টোপাধ্যায়ের মুখে খুব সহজেই যথার্থ বলে মনে হয় ‘ভালো কাজই নির্বাচনের একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে যে কোনও প্রকাশন সংস্থার’- এই কথাটি।

আরও পড়ুন - কখনও শেখ হাসিনা, কখনও জাক দেরিদা || বইমেলাই আন্তর্জাতিক করেছে বাঙালিকে

ছোট সংস্থার আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, এদের ম্যান পাওয়ার কম, আর্থিক দিক থেকেও খানিক পিছিয়ে। তাই সিদ্ধান্ত ধার করার জন্য লোকও নেই আলাদা করে। নিজেদের ভাবনায় শান দিতে দিতেই এগিয়ে চলতে হয় তাদের। টোটাল জার্নিটাই একটা ট্রেনিং পিরিয়ড বলা চলে। দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও নতুন করে শেখা। ধাক্কা খেতে খেতেই লক্ষ্যে পৌঁছনো। মুদ্রণশিল্প থেকে শুরু করে মার্কেটিং, ম্যান ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে বইয়ের যাবতীয় বিষয়গত পরিকল্পনা অথবা বিপণি সামলানো, এই সব কিছুতেই প্রতিনিয়ত নিজেরাই যেন নিজেদের শিক্ষক হয়ে ওঠে ছোট ছোট প্রকাশন সংস্থাগুলি। তারপর একটা, দুটো করে কবেই যেন তাক ভরে যায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যায়।

বইমেলার আসল আকর্ষণ বিবিধের মাঝে থেকেই মিলনের আত্মস্থল খুঁজে নেওয়া। প্রথম প্রথম তো স্টল ভাড়া নেওয়ার পয়সা জোটে না। হাতে হাতে ঘুরতে থাকে কত কত বই, যার কোনও একটাতেই হয়তো মিলে যায় অসাধারণত্ব-এর খোঁজ। হয়তো কারোর জন্য জোটে লিটিল ম্যাগাজিনের টেবিল। আর কেউ কেউ এক চিলতে একটা স্টল পেয়ে যায় ভাগ্যক্রমে। অতঃপর ‘দে’জ’, ‘আনন্দ’ অথবা ‘পত্রভারতীর’ বিরাট স্টলের দিকে তাকিয়ে আবার নতুন স্বপ্ন বুনতে শুরু করে ‘মান্দাস’, ‘বৈভাষিক’ অথবা ‘ধানসিড়ি’রা।

kolkata book fair

ঐতিহ্যের সঙ্গে তারুণ্যের মেলবন্ধনে বিশ্বাস করে 'মান্দাস'

এরই মধ্যে বারবার সুদিন আসে। এই সমস্ত প্রকাশন সংস্থার হাত ধরেই পাঠকের কাছে পৌঁছে যায়, ‘জীবনানন্দের অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ’ অথবা ‘বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর সেরা কাব্যগ্রন্থ’ -এর মতো কিছু অমূল্য সম্পদ। একই সঙ্গে এই ঐতিহ্যের হাত এসে ধরে তারুণ্য। উঠতি লেখকদের অসাধারণ কিছু কাজ নজর কেড়ে নেয়। হিসেবের খাতা খুলে মাঝে মাঝে খুব আনন্দ হয়, আবার কোনও সময় মনখারাপ গেঁড়ে বসে। কিন্তু কাজ থামে না। ‘চরৈবতি’ মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে আবার কলম তুলে নেন লেখকেরা। আর নতুন লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে আবারও বড় নামজাদা প্রকাশন সংস্থাগুলির সঙ্গে পথে নামেন অজস্র ছোট প্রকাশন সংস্থাগুলিও।

আরও পড়ুন - ব্রিটিশ শাসিত কলকাতাতেই প্রথম বইমেলা! পুরোভাগে ছিলেন রবি ঠাকুর, নীলরতন সরকাররা

বাধা নানারকম আসে। যা কিছু করা উচিত, তা অনেক সময়েই করে উঠতে পারে না সংস্থাগুলি। আবার, অনেক কিছু করার পরেও যা কিছু পাওয়া উচিত, তা হয়তো পায় না। এলেম অনুযায়ী সাফল্য আসে না সবসময়। তবে ‘বৈভাষিক' অদ্বয় চৌধুরী একটা দারুণ কথা বলেন এই ক্ষেত্রে, “ছোট প্রকাশনা সংস্থার কাছে মানসিক প্রশান্তিটাই বোধহয় বেশি প্রার্থনীয়, তাই ছোট ছোট টার্গেট সামনে রেখে এগিয়ে চলতে হয়। তাতে ওই মানসিক প্রশান্তিটা সহজে আসে, আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে না, বরং বাড়ে।”

সুতরাং, বই বাজারে কে ছোট আর কেই বা বড়! মেলায় ঢুকে একটা মস্ত ম্যাপ হাতে নিয়েও তো হিমসিম খেতে হয়। বই, শুধুই বই, আরও আরও বই। এই এত এত মানুষ গোটা বছরটা বই নিয়ে, লেখালিখি নিয়ে থাকেন? ভাবতে অবাক লাগে ভীষণ! এদের মধ্যে অনেকেই হয়তো দশটা পাঁচটার চাকরি করেন, তবুও দিন শেষে ঘরে ফিরে নতুন কাজের তরজমা করেন। প্রকাশক বন্ধুকে ফোন করে নতুন লেখার খসড়া শোনান। কখনও পুরনো লেখায় নতুন করে কলম চালান। আর বছর শেষে অপেক্ষা করেন এই একটা মেলার জন্যই। এই বারোটা দিনের মধ্যে বার কয়েক হয়তো অফিস কেটেই চলে যান বইমেলার প্রাঙ্গণে। যেখানে নতুন বইয়ের গন্ধে একটা অদ্ভুত নেশা আছে, একটা মায়া আছে। আর জাপটে ধরা একটা ঘোরতর আবেগ আছে। যে আবেগের বশেই কেবল ভালো কিছু কাজ এবং আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন সঙ্গী করে ‘মান্দাস’, ‘ধানসিড়ি’, ‘তবুও প্রয়াস’ অথবা ‘বৈভাষিক’রা পাড়ি দেয় নতুন দিগন্তের পথে। হাতে মশালের বদলে থাকে ‘বই’, আর কলমের মুখে শব্দ নিয়ে মিছিলের নেতৃত্ব দেন অসংখ্য নতুন এবং পুরনো লেখকেরা।

More Articles