থামল মেধার বাতানুকুল ঘুঙুর
Hungry Generation poet, Malay Roy Choudhury passed away: বৃদ্ধাঙ্গুলি গুরুদক্ষিণা দিয়ে অন্ত্যজ হয়ে সরে থাকে যে একলব্য, বাংলা সাহিত্যে মলয় যেন তারই উল্টোমুদ্রা হয়ে থাকতে চেয়েছেন বরাবর। থেকেওছেন।
'জন্মমুহূর্তের তীব্রচ্ছটা সূর্যজখম মনে পড়ছে / আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই ..' - তাঁর কলম থেকে প্রতিটা শব্দ ছিটতে উঠত যেন এভাবেই। প্রথাগত যা কিছু, যা কিছু প্রতিষ্ঠানমুখী, তার গালে কষিয়ে দিতে চাইত সপাট থাপ্পড়। শব্দের জন্য শাস্তি, কারাদণ্ড শুধু এ দেশে কেন, গোটা বিশ্বেই কোনও নতুন ব্যপার নয়। হাংরি জেনারেশনের কবিদের কপালে সেই দুঃখ যেন ছিল ললাটলিখনের মতোই। সকলের সামনে কোমরে দড়ি পরিয়ে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। মিলেছে শাস্তি। তার পরেও রুখে দেওয়া যায়নি তাঁর শব্দবন্ধদের। প্রতি পংক্তিতে ছিটকে উঠেছে সমস্ত প্রথা ভেঙে দেওয়ার চিৎকার। শিল্পের জন্য শিল্পের যে পাশ্চাত্য ধারণা, তাকে ভেঙেচুরে খানখান করে দিতে চেয়েছেন বারবার। তাঁর 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' চলেছে, যা কিছু চিরাচরিত তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে দেবে বলে। অবশেষে এক কার্তিকের সকালে সেই 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' বুঝি থামল। জন্মদিনের থেকে মাত্র কয়েকদিন দূরেই চলে গেলেন বাংলার হাংরি আন্দোলনের অন্যতম কবি মলয় রায়চৌধুরী।
দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন তিনি। শেষের দিকে আক্রান্ত হন আর্থারাইটিসের সমস্যায়। সেই অসুস্থতা নিয়েই এক হাতে টাইপ করতেন, কাজ করতেন লেখালিখির। সম্প্রতি বয়সজনিত সমস্যা নিয়ে ভর্তি হন মুম্বইয়ের হাসপাতালে। সেখানেই বৃহস্পতিবার ৮৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কবি মলয় রায়চৌধুরী। তাঁকে নিয়ে বিতর্কের শেষ ছিল না কোনওকালেই। সেই শব্দের জন্য গ্রেফতার হয়েছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের নিগ্রহ শোষন করেছেন। খাটতে হয়েছে জেলও। এমনকী সহ-আন্দোলনকারীরাও একসময় সরে গিয়েছেন পাশ থেকে। আদালতে তাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছেন মলয়েরই বিপক্ষে। অশ্লীলতার দায়ে তাঁর কবিতাকে বিদ্ধ করা হয়েছে। হয়েছে জরিমানাও। তার পরেও শব্দের সেই সত্য থেকে সরে আসেননি মলয় কোনওদিনওই। সেসব নিয়েই হাংরি আন্দোলনকে এক অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন তিনি। হয়তো কম সময়ের জন্য স্থায়ী হয়েছিল সেই হাংরি যুগ, তবে বাংলা সাহিত্যে রেখে গিয়েছিল চিরস্থায়ী ছাপ। শুধু কবিতা নয়। কবিতার পাশাপাশি মলয় দক্ষতা দেখিয়েছেন তিনি উপন্যাস, গল্প এবং প্রবন্ধেও। করেছেন অজস্র অনুবাদ। আর সব জায়গাতেই সেই হাংরি আন্দোলনের ধারা বজায় রেখেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন: ‘আমি বিনয় চণ্ডাল’ : এক পংক্তির কবিতার দলিত পাঠ
মলয়ের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৯ অক্টোবর বিহার প্রদেশের ছাতনা শহরে। তবে বিহারে জন্ম হলেও তিনি কিন্তু বিখ্যাত সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের উত্তরপাড়া শাখার বংশধর। মলয়ের বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী ছিলেন চিত্রশিল্পী ও ফটোগ্রাফার। প্রখ্যাত চিকিৎসক রোনাল্ড রসের সহায়ক ছিলেন পানিহাটির বাসিন্দা কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরই কন্যা অমিতা ছিলেন মলয়ের মা। কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিষদের সংগ্রহশালা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মলয়ের ঠাকুরদা লক্ষ্মীনারায়ণ ছিলেন ভারতের প্রথম ফটোগ্রাফার-আর্টিস্ট। সেই পথেই হেঁটেছিলেন বাবা গৌচপ্রম। তবে তাঁর দুই ছেলে সমীর এবং মলয় - দু'জনেই বেছে নিলেন অন্য রাস্তা। বাংলা সাহিত্যে অন্য রকম ঢেউ আনার পথ।
জিওফ্রে চসারের লেখা ‘ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম’বাক্যটি থেকে হাংরি শব্দটি পেয়েছিলেন মলয়। চসার কালখণ্ডকে চিহ্নিত করেছিলেন শব্দটি দিয়ে। এরই মধ্যে মলয়ের হাতে আসে অসওয়াল্ড স্পেংলারের 'দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট' বইটি। স্পেংলার মনে করতেন যে সমাজ-সংস্কৃতি হল আদতে জৈব একটি প্রক্রিয়া। তা যখন কেবল নিজস্ব সৃজন-ক্ষমতার উপরে নির্ভর করে, তখন সেই সংস্কৃতি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করে এবং তার নিত্য-নতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে। কিন্তু তার শেষের শুরু হয় সেই সময় থেকে যখন সে নিজস্বতাটি খুইয়ে বাইরে থেকে যা পায় তা-ই আত্মসাৎ করতে শুরু করে। তার সেই ক্ষুধা তৃপ্তিহীন। অথাৎ তখন সমাজ-সংস্কৃতিটি হাংরি। দেশ-ভাগ পরবর্তী বঙ্গসমাজ সেই ভয়ঙ্কর একটা জায়গার মধ্যে পড়েছে বলেই মনে করেছিবেন মলয়। মনে রাখতে হবে, মলয় কিন্তু জন্মেছিলেন ব্রিটিশ-শাসিত দেশে। উনিশ শতকে যে নবজাগরণের মুখ দেখেছিল বাংলা, তা ষাটের দশকে এসে সম্ভব নয় বলেই মনে করতেন মলয়। স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী দেশ দেখে ফেলেছে ভয়াবহ দেশভাগ, দেখেছে দুর্ভীক্ষ, অগণিত ভিটিমাটি হারানো উদ্বাস্তুর ভিড়। সেই সময়ে যে যুগকে দিশা দেখানোর মতো মণীষী পর্যাযের বাঙালির আবির্ভাব যে সম্ভব নয়, তা বুঝেছিলেন মলয়। সেসময় দেশবিদেশের বিভিন্ন সাহিত্য-শিল্পের বাঁকবদলের আলো এসে পড়েছে মলয়ের মুখে। সেই আলোয় নতুন করে ভাবতে শিখছেন তিনি। তাছাড়া যুগের হাওয়াটাও ছিল স্রোতের উল্টোদিকের হাঁটার। স্বাধীনতা যুদ্ধের রেশ ততদিনে ফিকে। পঞ্চাশের মন্বন্তর, দেশভাগ-সবটা মিলিয়ে দেশে জাঁকিয়ে বসেছে কালোবাজারি। এরই মধ্যে ১৯৬২ সালে চিনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াল ভারত। ৪৭-৪৮ সালের প্রথম ভারত-পাক যুদ্ধের ক্ষত তখনও টাটকা, এরই মধ্যে ১৯৬৫ সালে লেগে যাবে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের আরও একটা যুদ্ধ। এমনই এক সন্ধিলগ্নে জন্ম নিয়েছিল নতুন এক সাহিত্যভাবনার। যা ইতিহাসে পরিচিত হল হাংরি আন্দোলন হিসেবে। বাংলা সংস্কৃতি কিন্তু তখনও সুন্দরের সাধনায় মেতে। চল্লিশের বামপন্থী আন্দোলনের হাওয়া ততদিনে অবশ্য বাংলা সাহিত্যে বেশ ছাপ ফেলেছে। কিন্তু আমবাঙালি মজে সেই উত্তম-সুচিত্রার রোম্যান্স আর হেমন্তকণ্ঠের রোম্যান্টিকতাতেই। এরই মধ্যে পঞ্চাশে জন্ম হয়ে গিয়েছে কৃত্তিবাসী চিন্তাধারার। কিন্তু তার থেকেও আরও বেশি কিছুর প্রত্যাশায় ছিল যাঁরা, তাঁরা সরে এলেন হাংরি আন্দোলনের দিকে।
১৯৬১ সালে পটনায় প্রকাশিত হল একটি ইস্তেহার। আর তার হাত ধরেই শুরু হয়ে গেল হাংরি আন্দোলন। যা বাংলা সাহিত্যে ছড়াতে দেরি হল না। যা কিছু প্রতিষ্ঠানমুখী, তার বিরোধিতা করাই ছিল সেই ভাবনার মূল। আর ক্রমে সেই আন্দোলনের পুরোধাপুরুষ হয়ে উঠলেন মলয়। দাদা সমীরও ছিলেন সেই একই পথের পথিক। তিনি অবশ্য গোড়ায় ছিলেন কৃত্তিবাসপন্থী। পরে যোগ দেন হাংরি গোষ্ঠীতে। শুধু তিনিই নন, শৈলেশ্বর ঘোষ, উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো অনেকেই যোগ গিয়েছিলেন সেই ধারায়।
জীবনের গতিশীলতাকে সাহিত্যে জায়গা দেওয়াই ছিল এর মূল লক্ষ্য। জীবনের ফর্মকে সাহিত্যে জায়গা করে দিতে চায় সে। তাই জীবন বা বাস্তবতার কোনও পরতকেই সাহিত্যের বাইরে রাখতে পছন্দ করেন না হাংরি-কবিরা। জীবন আর সাহিত্যে কোনও পার্থক্য রয়েছে বলে বিশ্বাস করেন না তাঁরা। জীবন যেমন যাপনের যোগ্য, সাহিত্যও ঠিক তেমনই। তাই জীবনের কোনও ঘটনা, কোনও শব্দকেই অচ্ছুৎ মনে করার জায়গা নেই। 'আর্ট ফর আর্ট'স সেক'- এই ভাবনাকেই তাই বুর্জোয়া শিল্প বা সাহিত্য বলে মনে করে হাংরি আন্দোলন। সাহিত্যে তথাকথিক পারম্পর্যের বিরুদ্ধে তাঁরা। নতুন ফর্ম, নতুন শব্দ, নতুন আঙ্গিককে খুঁজে বের করাই হাংরির বৈশিষ্ট্য। তাতে জায়গা পাবে মাইনরিটি বোধ, উদ্বাস্তুচেতনার মতো ভাবনা। হাংরি সাহিত্য তাই আক্রমণাত্মক এবং ঋজু। সাহিত্যকে প্রতিপদে বিশ্লেষণ করে করে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষেই রায় দেয় এই হাংরি ভাবনা। মোটামুটি এমনই একটি জায়গা থেকে পথচলা শুরু করেছিল হাংরি আন্দোলন। লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে কবিতা ছাপানোর রাস্তায় কোনওদিনই হাঁটেননি মলয়রা। হাংরি বুলেটিন নামে নামে একটি বুলেটিন তারা বিতরণ করতেন বিনামূল্যে। বেশি সংখ্যক মানুষের হাতে তাঁদের ভাবনাচিন্তাকে ছড়িয়ে দেওয়াই মূল লক্ষ্য। ১৯৬৩ সালে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' নামে ৯০ লাইনের একটি কবিতা লিখে ফেললেন মলয়। যা ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হল হাংরি বুলেটিনে। আর সেই কবিতাই হয়ে উঠেছিল আলোচনার মূল বস্তু।
সাহিত্যে অশ্লীলতার অভিযোগে নিষিদ্ধ করা হল কবিতাটিকে। রাষ্ট্রদ্রোহ-সহ একাধিক অভিযোগ মামলাও দায়ের হল মলয় রায়চৌধুরী-সহ মোট ১১ জন আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, সাহিত্যে অশ্লীলতা এবং তরুণদের বিপথে চালনা করার অভিযোগ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হল তাঁদের বিরুদ্ধে। কোমরে দড়ি পড়ল মলয় রায়চৌধুরীর। গ্রেফতার হলেন হাংরি গোষ্ঠীর আরও ৬ জন। ১৯৬৫ সালে গিয়ে সকলে মুক্তি পেলেও ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯২ ধারা (সাহিত্যে অশ্লীলতা)-য় চার্জশিট দায়ের করা হল মলয়ের বিরুদ্ধে। প্রায় ৩৫ মাস চলল সেই মামলা। মলয়ের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, জ্যোতির্ময় দত্ত এবং সত্রাজিত দত্ত। তবে বিপক্ষে সাক্ষ্য দিলেন হাংরি গোষ্ঠীর সহ-আন্দোলনকারীদের অনেকেই। যার মধ্যে ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, পবিত্র বল্লভ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এবং উৎপলকুমার বসুও। নিম্ন আদালতে মলয় রায়চৌধুরীর ২০০ টাকা জরিমানা হল, অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড। এদিকে চাকরি থেকে বরখাস্ত হলেন উৎপলকুমার বসু, প্রদীপ চৌধুরী ও সমীর রায়চৌধুরীরা। অন্যদিকে ঔপন্যাসিক সুবিমল বসাক এবং কবি দেবী রায়কে কলকাতা থেকে বদলি করে দেওয়া হল মফসসলে। ১৯৬৭ সালের জুলাই মাসে উচ্চআদালতে শেষপর্যন্ত ওই মামলা থেকে রেহাই পেলেন মলয়। খারিজ করা হল মামলা, নিষিদ্ধ ট্যাগ থেকে মুক্তি দেওয়া হল কবিতাটিকেও।
তবে ততদিন ইউরোপ-সহ একাধিক পাশ্চাত্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছে কবিতাটি। বিভিন্ন ভাষায় অনুদিতও হয়েছে তা। আসলে 'আর্ট ফর আর্টস সেক'-এর যে পাশ্চাত্য ধারণা, তার সমূলে গিয়ে আঘাত করতে চেয়েছিলেন মলয় ও তাঁর অনুসারীরা। বাংলা সাহিত্যের যা কিছু সনাতন, তা ভাঙার চেষ্টা করে গিয়েছে হাংরি আন্দোলন। সে জন্য ভেঙে ফেলা হয়েছে ছন্দ ও অলঙ্কারের চেনা ছকে বাঁধা অনুশাসন। খেলা করা হয়েছে বানান নিয়ে। তৈরি করেছেন নিজস্ব একটি ভাষা। যা কথা বলে চলমান গদ্যের বিরুদ্ধে। সেই গদ্য়ভঙ্গিতে নিজেকেই ভেঙেছেন, ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত করেছেন মলয় প্রতিনিয়ত।
"আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই
এখন আমার হিংস্র হৃৎপিণ্ড অসম্ভব মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে
মাটি ফুঁড়ে জলের ঘূর্ণি আমার গলা ওব্দি উঠে আসছে
আমি মরে যাব
ওঃ এ সমস্ত কী ঘটছে আমার মধ্যে
আমি আমার হাত হাতের চেটো খুঁজে পাচ্ছি না"
প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার / মলয় রায়চৌধুরী
তাঁর কবিতায় যৌনতা হেঁটে বেরিয়েছে উদগ্র শার্দুলের মতো। কোনও ছুঁৎমার্গ নেই পদচারণে। মলয় মনে করতেন, সনাতন ভারতবর্ষের ধারণায় কিন্তু যৌনতা নিয়ে এই ছুঁৎমার্গ ছিল না কোনওকালেই। শিল্পে যৌনতাকে অশ্লীলতা মনে করা হত না কখনওই। বরং তার আদি-শৃঙ্গাররসই ছিল প্রধান বিষয়। খাজুরাহের মন্দির থেকে শুরু করে প্রাচীন সাহিত্যের বহু নিদর্শনই তার প্রমাণ। ভারতের যে শ্লীল-অশ্লীলের এই অনুশাসন তা আসলে প্রথম আসে আরবি-তুর্কি-আফগানি মূল্যবোধের হাত ধরে। তার পর ভিক্টোরিয় খ্রিস্টধর্মীদের হাত ধরে কফিনে পড়ল শেষ পেরেকটিও। ' তারাই ব্রিটেন থেকে অবসিনিটির আইন' আমদানি করে শ্লীল-অশ্লীলের খ্রিস্টিও-ফতোয়া জারি করল এ দেশে। আর ওদের আনা মানদণ্ডের দাস হয়ে দাঁড়াল ভারতীয় সংস্কৃতি। আর সেই জায়গাটাকেই ভাঙতে চেষ্টা করে গিয়েছেন হাংরি গোষ্ঠীর কবিরা। বানানের ক্ষেত্রেও নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন, কোথাও যুক্তাক্ষরকে ভেঙে চুরমার করেছেন, কোথাও বা সরল শব্দের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছেন যুক্তাক্ষরের বোঝা।
মা, তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন ?
তাহলে আমি দুকোটি আলোকবর্ষ ঈশ্বরের পোঁদে চুমু খেতুম
কিন্তু কিছুই ভালো লাগে না আমার কিছুই ভালো লাগছে না
একাধিক চুমো খেলে আমার গা গুলোয়
ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন
কবিতার আদিত্যবর্ণা মুত্রাশয়ে
এসব কী হচ্ছে জানি না তবু বুকের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে অহরহ
সব ভেঙে চুরমার করে দেব শালা
ছিন্নভিন্ন করে দেব তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উৎসব
শুভাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাব আমার ক্ষুধায়...
প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার / মলয় রায়চৌধুরী
সারা জীবনে প্রায় দু'শোরও বেশি বই লিখেছেন মলয়। তার মধ্যে রয়েছে দশটিরও বেশি কাব্যগ্রন্থ, দশটি উপন্যাস, দু'টি ডিটেকটিভ উপন্যাস, একটি ইরোটিক নোভেলা, বারোটি সমালোচনা গ্রন্থ, চারটি জীবনী ও অসংখ্য অনুবাদ। 'শয়তানের মুখ', 'জখম', 'আমার অমীমাংসিত শুভা', 'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর', 'হাততালি', 'চিৎকার সমগ্র', 'মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো'-র মতো অজস্র কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। রয়েছে 'কৌনপের লুচিমাংস'-সহ একাধিক কবিতা সংকলন। শুধু কবিতা নয়, উপন্যাসেও তিনি ছিলেন উজ্জ্বল। 'অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা', 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস', 'এই অধম ওই অধম', 'নেক্রোপুরুষ', 'নামগন্ধ', 'রাহুকেতু', 'হৃদপিণ্ডের সমুদ্রযাত্রা'-র মতো একাধিক উপন্যাসে তিনি নিজস্ব ভাবনা চিন্তার ছাপ রেখেছেন। অ্যালেন গিন্সবার্গের হাউল ও ক্যাডিশ কাব্যগ্রন্থের অনুবাদ করেন তিনি। অনুবাদ করেছেন বিট-কবিদের অসংখ্য লেখা, জাঁ আর্তুর র্যাঁবো'র 'নরকে এক ঋতু' এবং 'ইল্যুমুনেশান্স'-এরও অনুবাদ করেন তিনি। ২০০৩ সাল নাগাদ অনুবাদ সাহিত্যের জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয় তাঁকে, তবে সেই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন মলয়। পরবর্তীকালে বহু লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কারও ফিরিয়ে দেন কবি। প্রথাগত প্রতিষ্ঠানমুখী যা কিছু, সেসবের উদ্দেশ্যেও বারবার প্রত্যাখ্যান শানিয়েছেন তিনি। সগর্বে ঘোষণা করেছেন:
একবস্ত্রে বহুবার রাকস্যাক পিঠে রেখে সভ্যতা ছেড়েছি
ক্লিওপেট্রার মসীলিপ্ত যোনি টানতে পারেনি
বারংবার চমকেছে গা ঘেঁষে বিদ্যুতলতা
চাবুকের দাগ দেখা যাবে বলে পোশাক খুলি না
মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর / মলয় রায়চৌধুরী
কবিতা যে প্রতিবাদের অস্ত্র, রাষ্ট্রের চোখরাঙানির ঊর্ধ্বে উঠে মাথা তুলে তাকানোর হাতিয়ার, তা বিশ্বাস করেছিলেন মলয়রা। তবে সেই পরিসর আজকের দিনে ক্রমশ কমছে বলেই আক্ষেপ ছিল মলয়ের। কবিতা লেখার শুরুর দিন থেকেই কিন্তু তিনি মনে করেছেন, কবিতার অন্যতম প্রধান কাজ, বর্তমান যে ঘটনাপ্রবাহ, তার দোষত্রুটি খুঁজে বের করা। শাসক বা রাষ্ট্রযন্ত্রের ভুলের মুখে কথা বলতে পারা। আর তা বলতে পিছপা হননি মলয়। মার্কসবাদ সম্পর্কে গভীর পড়াশোনা তাঁর জীবনভাবনায় ছাপ ফেললেও সরাসরি বামপন্থার পথে হাঁটার কথা ভাবেননি কখনওই। তবে তার লেখার রাজনৈতিক চেতনা যে তৎকালীন রাষ্ট্রযন্ত্রের যথেষ্টা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা তো আর নতুন করে বলে দিতে হয় না। না কোনও প্রথাগত সাহিত্যগোষ্ঠীর হাত ধরেছেন মলয়, না কোনও বিশেষ রাজনৈতিক চেতনার। ধর্মবিশ্বাস নিয়েও ছিলেন নিষ্পৃহ। এমনকী কবিতায় নিজেদের পূর্বপুরুষ সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের লম্পট বলতেও পিছপা হননি মলয়। এমনই ছিলেন তিনি- সপাট, সরব।
আরও পড়ুন: পারাপারহীন ভালোবাসা আর কান্নাকে যেভাবে কবিতায় এনে বসিয়েছেন হিন্দোল ভট্টাচার্য…
যেখানে জন্মেছেন মলয়, সেই পটনায় তিনি মিশেছেন অন্ত্যজ শ্রেণির বহু মানুষের সঙ্গেই। সেই অভিজ্ঞতা তাঁর সাহিত্যকে পুষ্ট করেছে। সাবর্ণভূমি থেকে চ্যুত একদল মানুষ কীভাবে পাটলিপুত্রে আশ্রয় নিয়ে রচনা করেছিল এক অবারিত প্রান্তিকতার, তার আখ্যান তিনি রচেন 'ছোটলোকের ছোটবেলা' বইতে। হাংরি আন্দোলনে তাঁর অন্যতম সহচর যিনি, সেই দেবী রায়ের আসল নাম ছিল হারাধন ধাড়া। তাঁর দেবী রায় নামটি কিন্তু দিয়েছিলেন মলয় নিজেই। সেই নামের মধ্যেও লুকিয়েছিল সেই জাতপাতের সীমানা ভেঙে এক অন্যরকম পৃথিবীর স্বপ্ন। যা আদতে চেয়েছিলেন মলয়ের মতো একজন আদ্যপান্ত হাংরি-কবি। বৃদ্ধাঙ্গুলি গুরুদক্ষিণা দিয়ে অন্ত্যজ হয়ে সরে থাকে যে একলব্য, বাংলা সাহিত্যে মলয় যেন তারই উল্টোমুদ্রা হয়ে থাকতে চেয়েছেন বরাবর। থেকেওছেন।
তোদেরই অঙ্গুলিহেলনে কেটে তর্জনীও দিয়েছি শৈশবে
দাঁড়াচ্ছি পা-ফাঁক করে দন্তস্ফূট হয়ে যাবে জয়ধ্বনি তোর
সিঁড়িতে শেকলবাঁধা মহাপ্রস্হানের কুত্তা লেলিয়েও দ্যাখ
ন্যাটা হাতে যুঝে যাব জমিন ছাড়ব না
লুমপেন বলে তোরা ঘিরে ধরবি
আরেকবার ছিটকে পড়ব ফুটপাতে মুখে গ্যাঁজলা নিয়ে
ছুটন্ত খচ্চরবাচ্চা পিঠের ওপরে ক্ষুর দেগে যাবে
নাভিতে ব্লেডের কুচি দিয়ে তোরা খোঁচা দিবি
পায়ুমুখে জ্বলন্ত সিগারেট
পাঁজরে আছড়ে পড়বে কম্বলে মোড়া সোঁটা
দেখে নিস তোরা
মাটিতে গোড়ালি ঠুকে পৃথিবীর চারিধারে জ্যোতির্বলয় গড়ে যাব ।
মেসোমশায় পর্ব / মলয় রায়চৌধুরী
মলয় না থাকলেও বাংলা সাহিত্যের চারধারে সেই জ্যোতির্বলয় রেখেই গেল তাঁর কবিতা, তাঁর উপন্যাস, তাঁর অযুত-নিযুত শব্দবন্ধরা।