১ মিনিটের ভূমিকম্পেই তছনছ হতে পারে কলকাতা, কতটা বিপদ ঘনিয়ে রয়েছে শহরে?
ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে, কলকাতাকে যদি অদূর ভবিষ্যতে ভূমিকম্পের গ্রাস থেকে বাঁচাতে হয়, তাহলে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনামাফিক নগরায়ন, নইলে ভূমিকম্পে ধ্বংস হতে পারে গোটা কলকাতাই।
কিছুদিন আগেই ভয়াল ভূমিকম্পে তছনছ হয়েছে আফগানিস্তানের মাটি। প্রতি বছরই বিভিন্ন কারণে সারা পৃথিবীতে ভূমিকম্পের প্রবণতা বেড়ে চলেছে। সুরক্ষিত নয় আমাদের শহর কলকাতাও। মাটি ধসতে শুরু করলে যে কলকাতার অধিকাংশ এলাকা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে, তার আভাস মিলেছে বউবাজার কাণ্ডের পরই। ভূমিকম্প হলে কলকাতার পরিণতি কী হতে পারে, তাই নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই গবেষণা করছিলেন খড়গপুর আইআইটি-র অধ্যাপক শঙ্করকুমার নাথের নেতৃত্বে একদল গবেষক। এই গবেষণার বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত ছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, শিবপুর আইআইএসটি এবং রাজ্যের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি পর্ষদ।
কলকাতা কতটা ভূমিকম্পপ্রবণ?
দেশের কোথাও ভূমিকম্প হলে তার ঠিক কতখানি প্রভাব পড়বে, তা নির্ধারণ করা হতো ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস-এর একটি মানচিত্র অনুসরণ করে। সেই মানচিত্র অনুসারে দেশের বিভিন্ন এলাকাকে ‘জোন টু’ ( অতি মৃদু মাত্রার ভুমিকম্পের আশঙ্কা যেখানে) থেকে শুরু করে ‘জোন ফাইভ’ (অতি প্রবল ভূকম্পপ্রবণ অঞ্চল) অবধি মোট চারটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ কয়েক দশকে নগরায়নের বিপুল চাপে চরিত্র বদল হয়েছে প্রায় সব শহরের।ব্যতিক্রম হয়নি কলকাতাও। শেষ কয়েক বছরে ব্যাপক বদলেছে কলকাতার ভূপ্রাকৃতিক চরিত্র। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উন্নয়ন ও দূষণের চাপ। বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনও শহরে ভূমিকম্পের বিপদ ঠিক কতটা, তা আন্দাজ করতে গেলে শহরটিকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে সমীক্ষা করতে হবে। কলকাতার গঠনশৈলী অনুযায়ী কলকাতাকে ও ভূমিকম্পের প্রবণতা অনুযায়ী কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়।
কলকাতার ক্ষেত্রে সল্টলেক, রাজারহাট, নিউটাউন অঞ্চলগুলিতে ভূমিকম্প হলে মারাত্মক বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। আবার প্রায় একইরকমভাবে ধসে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে উত্তর কলকাতার পাইকপাড়া, বরানগর, শ্যামবাজার অঞ্চলের। মাঝারি মানের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে দমদম, কালীঘাট, যাদবপুরের মোট এলাকায়। হাওড়া জেলার বালি, বেলুড়েও পড়তে পারে ভূমিকম্পের প্রভাব।
আরও পড়ুন: মেট্রোর কাজেই খাল কেটে কুমির আনা? বউবাজারের আতঙ্কের নেপথ্যে এক হারিয়ে যাওয়া নদী
কলকাতায় ভূমিকম্পের কারণ কী?
ভূতত্ত্ববিদদের মতে কলকাতার মাটির ঠিক সাড়ে চার কিলোমিটার নীচ দিয়ে একটি চ্যুতি বা ফল্ট রয়েছে। নাম ময়মনসিংহ-কলকাতা হিঞ্জ বা ইওসিন হিঞ্জ। এই চ্যুতিরেখা বরাবর যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত রয়েছে, তা নির্গত হলে কলকাতায় রিখটার স্কেলে ৬.৫ মাত্রার ভূকম্পন হতে পারে। কিন্তু ভূমিকম্প কবে হবে এর পূর্বাভাস দেওয়ার মতো কোনও বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি নেই।
হুগলি নদীর অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ার কারণে কলকাতা এবং সংলগ্ন অঞ্চল গড়ে উঠেছে পলি মাটি দিয়ে। এই পলিমাটিই আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে কলকাতায় ভূকম্পের প্রবণতা, এমনটাই মনে করছেন ভূ-বিজ্ঞানীরা। যখনই ভূগর্ভে কম্পন অনুভূত হবে, সেই কম্পন পলিমাটির মধ্য দিয়ে পাক খেতে খেতে ওপরে উঠে আসবে। যত বেশি পাক খাবে, তত বাড়বে কম্পনের মাত্রা।
দীর্ঘদিন ধরে নগরায়নের ফলে কলকাতা শহরে গাছ কেটে তৈরি হয়েছে বড় বড় বিল্ডিং, মেট্রোরেল, ব্রিজ যার ফলে ভূপৃষ্ঠের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়েছে। কলকাতার নিচে যে পলিমাটির স্তর রয়েছে তার সবচেয়ে উপরের স্তরের নাম কালীঘাট পলিরাশি। এর নিচে যদি দীর্ঘদিন ধরে কম্পন চলে, তাহলে নিচের স্তরে থাকা নুড়ি, কাঁকড়া, বালির স্তরে শূন্যতা তৈরি হবে। এই স্তর প্রায় ৯৬ মিটার পর্যন্ত গভীর। কলকাতা শহর এখন কংক্রিটের জঙ্গল। তাপের ফলে মাটি শুকিয়ে গেলেই পার্শ্ববর্তী যেখান থেকে জল শোষণ করে মাটি, সেখানে জলস্তরের সঙ্গে পলি বেরিয়ে আসে।ফলে ফাঁপা হয়ে যায় মাটির তলা। তাই ১ মিনিটও যদি কলকাতা শহরে ভূকম্পন স্থায়ী হয়, ধসে পড়তে পারে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ঘরবাড়ি।
বউবাজার কাণ্ডের নেপথ্যেও সেই ভূমিকম্প
১৭৩৭ সালের ভূমিকম্প বদলে দিয়েছিল শহর কলকাতার মানচিত্র। বউবাজারে মেট্রোর জন্য যে অংশে খননকার্য চলছে, তার তলা দিয়েই ছিল গঙ্গার একটি খাঁড়ি। চাঁদপাল ঘাট থেকে হেস্টিংস স্ট্রিট হয়ে ওয়াটারলু স্ট্রিট, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট হয়ে ধর্মতলার উত্তর দিকে ক্রিক রো হয়ে সল্টলেকের দিলে ছিল সেই খালের প্রবাহ। পরে ১৭৩৭-এর ভূমিকম্পে ভূ-প্রাকৃতিক অদলবদলের ফলে সেই খালের বড় অংশ বুজে যায়। ভূতাত্ত্বিকদের আশঙ্কা, মেট্রোর খননকার্য চলাকালীন সেই সুপ্ত নদীখাত বরাবরই মেট্রোর সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছে। সেইখান থেকেই দুর্গা পিতুরি লেনের একাধিক বাড়িতে ফাটল এবং মেট্রোর কাজে বিপত্তি।
ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে, কলকাতাকে যদি অদূর ভবিষ্যতে ভূমিকম্পের গ্রাস থেকে বাঁচাতে হয়, তাহলে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনামাফিক নগরায়ন, নইলে ভূমিকম্পে ধ্বংস হতে পারে গোটা কলকাতাই।