অন্যের যুদ্ধের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তোমার নিজের লড়াই
RG Kar Protest: বইয়ে কিন্তু সবটা থাকে না। আমরা সকলেই জানি, আমরা যাকে গণতন্ত্র বলি সেই পরিসরই তো আবার ঠিক করে দেয় আমার কী খাব, কী পরব, কী শিখব, কী মাখব ইত্যাদি।
আরজি করের নৃশংস খুন ও ধর্ষণের ঘটনা শুধু আমাদের নয়, আমাদের মেয়েদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। তারা এতটাই আলোড়িত হয়েছিল যে তারা চিঠি লিখতে শুরু করে আমাদের। ৪৫০ জন মেয়ে আমাদের লিখিত ভাবে তাদের ক্ষোভ ও দুঃখের কথা জানিয়েছিল। ওদের এই টুকরোটুকরো লেখাগুলিই আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, ওরা অন্য কিছু ভাবছে। তখন একজন শিক্ষক হিসেবে আমার মনে হয়েছিল ওদের মধ্যে যে প্রদীপটা সবে জ্বলছে তা উস্কে দেওয়ার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের সকলের। সেই কারণেই আমি ওদের বলেছিলাম যে, তুমি যদি তোমার নিজের অধিকার খুঁজে পেতে চাও, তাহলে তোমাকে অন্যায়ের শিকার হয়েছেন এমন যে কোনো মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ অন্যের অধিকারের লড়াইতেই তো আমাদের নিজেদের লড়াইটা থাকে। আমি বিষয়টা এভাবেই দেখি।
আমি আমার মেয়েদের এই শিক্ষাই দিই যে, তুমি ভাববে না তুমি তোমার একার লড়াই লড়ছ। তুমি যাদের পাশে পাওনি তুমি কিন্তু তাঁর লড়াইটাও লড়ছ। যেমন আমি যদি প্রশ্ন করি , কেন আমি বাবার সম্পত্তি অধিকার পাব না? কন্যা সন্তান বলে? এই লড়াইটা কিন্তু সেই সমস্ত মেয়েদের হয়েই প্রশ্ন করা যারা এই অধিকার থেকে বঞ্চিত। এই বোধটা ছাত্রদের মধ্যে সঞ্চারিত করা আমাদের কাজ। কেউ বলতে পারেন, কেন? কেউ বলতে পারেন এ তো বাড়তি দায়িত্ব!
আরও পড়ুন: সকলে নন, কেউ কেউ ‘আদর্শ’ শিক্ষক
মাস্টারমশাইরা সমাজ গড়ার কারিগর, কথাটা আমরা প্রায়শই বলি। কিন্তু বুঝতে হবে, তাঁরা সমাজ গড়ার কারিগর কেন? কারণ একমাত্র তারাই নিজেদের কাছে নিষ্পাপ মাটির ডেলাগুলো পান। ফলে তারা গড়েপিটে নেওয়ার সুযোগ পান। এই সুযোগটা সমাজের আর অন্যান্য পেশাতে নেই। সে কারণেই, মাস্টারমশাইদের মধ্যে শেখার ইচ্ছে থাকতে হবে, দূরদৃষ্টি থাকতে হবে। সবজান্তা হয়ে গেলে মুশকিল। বাচ্চাদের বয়সের দোহাই দিয়ে তো থামিয়ে রাখা যায় না। বাচ্চাদের মধ্যে আবেগের স্রোতটা বাঁধতে হয় ঠিকই। কিন্তু ওরা অনেকটা ছোট বলেই, স্রেফ বয়সের ওই সংখ্যার ধাপ্পাবাজি দিয়ে ওদের দূরে রাখা যেতে পারে, এমনটা আমি মনে করি না। বাচ্চা তো আকাশ থেকে পড়ে না। আমাদেরই অংশ তারা। অতএব আমরা তাকে সমাজবিমুখ করে রাখব কেন? সে যে এই সমাজেরই অংশ, তা বোঝানোর দায়িত্ব আমাদেরই।
আর এই শেখানোর বোঝানোর জন্য নতুন করে শেখার, বোঝার আগ্রহটাও সবার মধ্যে রাখতে হবে। মাস্টাররমশাই এই তালিকার একজন, তিনি ভিন্নতর কেউ নন। আমি মনে করি, মাস্টারমশাই হবেন ছাঁকনির মতো। কাঁকড়গুলো তাঁকে নিজেকেই তুলে ফেলে দিতে হবে। আর যেটুকু সারপদার্থ রয়েছে তাই ছড়িয়ে দিতে হবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। সেটা যে কোনও ক্ষেত্রেই হতে পারে। মাস্টারমশাইরা শুধু জ্ঞান দিয়ে গেলে হবে না। তাঁদের জীবনেও যে সেই জ্ঞানের প্রভাব রয়েছে তো? থাকলে, তার প্রকাশ ঘটাতে হবে। নয়তো ছাত্র হোক বা সমাজ, সবাই বলবে এই জ্ঞানগুলো শুধুমাত্র কথার কথা হয়ে রইল। এমনটাই কিন্তু হয়, আমাদের সমাজে, প্রতিনিয়ত ঘটে থাকে। ফলে ভাবতে হবে, আমি আমার কথাগুলো কতটা আত্মীকরণ করেছি? আমার জীবনে তার প্রকাশ কতটা জুড়ে? আমি বললাম: 'চল হাঁটি', তার পর নিজেই ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকলাম; এই ধরনের শিক্ষককে কেউ বিশ্বাস করবে না। শুধু শিক্ষক নন। এই ধরনের মানুষকেই কেউ গ্রহণ করবেন না, এটা যেন আমরা মাথায় রাখি।
আরও একটা কথা আমি এই আবহে বলব। সবপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়ে বলছি, আমাদের ছেলেমেয়েদের পাঠ্যক্রমে ধর্ষণ বিষয়ে সচেতনতা সেভাবে নেই। পরিবারে বড়দের (পরিবার বলতে বাড়ি এবং বিদ্যালয়। বিদ্যালয়কেও আমি পরিবার বলেই মনে করি) কর্তব্য, বাচ্চাকে সচেতন করে তোলা। আর বাচ্চার দিক থেকে বলব, সব বাচ্চারই উচিত প্রশ্ন করা। সেই প্রশ্ন করাটাও অবশ্য আমাদেরই শেখাতে হবে। একটা নির্দিষ্ট বয়স থেকে এই অভ্যেসটা যাতে তৈরি হয়, আমাদের দেখতে হবে। নিরুৎসাহিত করা চলবে না।
বইয়ে কিন্তু সবটা থাকে না। আমরা সকলেই জানি, আমরা যাকে গণতন্ত্র বলি সেই পরিসরই তো আবার ঠিক করে দেয় আমার কী খাব, কী পরব, কী শিখব, কী মাখব ইত্যাদি। সেখানে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র আপনাকে সব রকমের সচেতনতা দেবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। তাই সচেতনতাটা শিশুর চারপাশ থেকেই উঠে আসতে হবে। মনোযোগ সহকারে তাকে সচেতন করে।তুলতে হবে।
ছেলেমেয়েদেরও দায় আছে। বুঝতে হবে, আমাকে যারা ভালবেসে শিক্ষা দেন, ভালবেসে বকেন তাঁরা সকলেই আমার অভিভাবক। এমন নয় যে শুধুমাত্র জন্মদাতাদেরই অভিভাবক হতে হবে। আমি মনে করি, অভিভাবকের দায়িত্ব যারা পালন করবেন তাঁদের অবশ্যই একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পরিকাঠামো তুলে ধরা উচিত। সেখান থেকে আত্মসচেতনতা আসবে। আত্মসচেতনতা এলে অবশ্যই সে প্রশ্ন করতে শিখবে। মানুষ প্রশ্ন করতে শিখলে, সে যতই কণ্টকিত পথই হোক না কেন, সত্যের সন্ধান পাবেই। আর যে মানুষ প্রশ্ন করতে জানবে না, তার অনুসন্ধানী মনও জাগবে না। ফলে সে কোনও দিনও অন্ধকারের বুক চিরে আলোর দিশাও দেখতে পাবে না। এগিয়ে যেতে হলে, প্রশ্ন করতে হবে। এবং সেই প্রশ্নের আড়ালেই তো উত্তর রয়েছে। সেই উত্তরটা খুজতে হবে। আমি মনে করি সমস্ত অভিভাবকের এটা দায়িত্ব। জানতে চাওয়ার রাস্তায় বাচ্চাদের হাঁটতে শেখানোর দায়িত্ব।
আজকাল অনেকেই জানার ছলে সমাজমাধ্যমের দাসত্ব করে। প্রলোভন থাকবে, চিরকালই ছিল। আগে আমরা যখন সিনেমাহলে সিনেমা দেখতাম সেখানেও তো বিভিন্ন বিজ্ঞাপন হত। আসল কথা ভালোটুকু তুলে নেওয়া। সমাজমাধ্যমে যেমন হিংসায় উস্কানি থাকতে পারে, যৌনতার সুড়সুড়ি থাকতে পারে, তেমনই আছে প্রকাণ্ড বিশ্বের নানাবিধ জ্ঞান। এবার মানুষ কীভাবে একে ব্যবহার করবে তার নিয়ন্ত্রক মানুষই। যে মূল্যবোধ তাকে নিয়ত গড়ছে তার উপর নির্ভর করছে হাতটা কোথায় গিয়ে থামবে, একজন কোন জিনিসের খোঁজ করবে। অতএব ছাত্র হোন বা নাগরিক, সুশিক্ষিত হলে সমাজমাধ্যমের যে ভালো দিকটা তা সে উপলব্ধি করতে পারবেন এবং তাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু মানুষ যদি সুশিক্ষিত না হন, তাহলে সমাজমাধ্যমের যে খারাপ দিকগুলো আছে তার প্রভাব বাড়তে থাকবে। এবং তার ছাপ সমাজের ওপরেও পড়বে। বাঁচাতে পারে সুশিক্ষা।
আরও পড়ুন: বাংলায় রেনেসাঁর ধারাকে আটকে দিয়েছিলেন বিবেকানন্দ | মুখোমুখি আশীষ লাহিড়ী
মনে রাখতে হবে, তুমি যদি আজ নির্যাতিতার পাশে না দাঁড়াও, তাহলে তোমার নিজের লড়াইটাও খুঁজে পাবে না। আমি যে এটা নতুন কিছু বলেছি এমন নয়। আমারা যখন লড়াই করি, এটা ভেবেই হয়তো লড়াইটা করি। এখনও যখন মহাভারত পড়ি তখনও তো মনে করি দ্রৌপদী যখন রাজসভায় যে প্রশ্নগুলো করেছিল, সে প্রশ্নগুলো তো আমারও। আজ যদি আমিও সভায় দাঁড়াই আমিও তো একই প্রশ্ন করব। হয়তো আমরা উচ্চারণগুলো আলাদা হবে, ভাষার প্রয়োগ অন্য রকম হবে। এই লড়াইগুলো আগেও ছিল, এখনও আছে। আবার ভবিষ্যতেও থাকবে। শুধু মাত্রাগুলো বদলে যাবে।
(অনুলিখনে তনভিয়া বড়ুয়া)