'অন্ধকার বলে কিছু নেই, আছে আলোর অভাব', বলতেন আজীবন মার্কসবাদী রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

Ramkrishna Bhattacharya: সাম্রাজ্যবাদের প্রতি, বৈষম্যর প্রতি, মানুষে মানুষে বিভাজনের প্রতি অধ্যাপক রামকৃষ্ণর ছিল অনির্বাণ ঘৃণা।

শরতের আকাশ হলেও ঈষৎ ভারী। শ্যামবাজার, ৩-নং মোহনলাল স্ট্রিটের বাড়ির চারতলায় তাঁর টেবিলে  ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে মহত্তম গ্রন্থরাজি। জানলা দিয়ে মৃদু হাওয়া এলে লেখার কাগজ ইতস্তত উড়ছে‌। কলমখানি চিৎ হয়ে পড়ে আছে, যেমন তিনি শেষবার রেখে গেছেন। অদ্ভুত এক শূন্যতা, চিরনিদ্রার দেশে পাড়ি দিয়েছেন এই সময়কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দর্শন-চিন্তাবিদ, ভারততত্ত্ববিদ অধ্যাপক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। শারদীয়া রবিবার, ২ অক্টোবর, ২০২২, সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে নিউটাউনের CNCI হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। শেষ জীবনে লাংক্যানসার হয়েছিল তাঁর। 

দ্বান্দ্বিক-বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সমাজবিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি  ইত্যাদি মননশীল চর্চার যে নবধারার জন্ম হয়, তার একটি মৌলিক সূচনাবিন্দু অবশ্যই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮০-১৯৬১)। আর সেই আলোকবিন্দু থেকে একটি রেখা টানলে তা রাহুল সাংকৃত্যায়ন (১৮৯৩-১৯৬৩) থেকে ডিডি কোসাম্বি (১৯০৭-'৬৬) থেকে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (১৯১৮-'৯৩) সুকুমারী ভট্টাচার্য (১৯২১-২০১৪) হয়ে যে আলোকবিন্দুটিতে স্পর্শ করে, তা অবশ্যই রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। বহুমুখী জ্ঞানচর্চার এক মুক্ত সত্যান্বেষী। ভাবুক পাঠকবর্গের কাছে আজীবন প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করা এক বিকল্প চিন্তা-প্রস্থান (School of Thought), সংবেদন ও স্বকীয়তার বৃত্তে অনন্যসাধারণ।    

যৌক্তিকতাবাদী এই জ্ঞানতাপসের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১০ ডিসেম্বর, কলকাতার শ্যামবাজারে। পিতামাতার একমাত্র সন্তান। বাল্যকাল থেকেই ছিলেন শান্ত ও স্থিতধী স্বভাবের। যুবক বয়স থেকেই তাঁর আকর্ষণ যুক্তি-চর্চা, তর্ক-বিতর্কের প্রতি। ১৯৬৩ সালে কলকাতার 'স্কটিশচার্চ কলেজিয়েট স্কুল' থেকে সেকেন্ডারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৭-তে বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮-তে এম.এ. পাঠ সম্পূর্ণ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। জ্ঞানলিপ্সায় ছিলেন অদ্বিতীয়, ছাত্রজীবনে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের সময় যুক্তিগঠনের দক্ষতা ছিল লক্ষণীয় বিষয়। পছন্দ করতেন রসিকতাও। ১৯৮৬-তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পূর্ণ করেন তিনি। তারপর সংসার না-পাতা (অবিবাহিত) জীবনে সঙ্গী বলতে শুধু বই, বই আর বই। জ্ঞানচর্চা-জগতে তাঁর বন্ধুবান্ধব বলতে ছিলেন অগ্রজপ্রতিম গোপাল হালদার, চিন্মোহন সেহানবীশ, সমর সেন-সহ বহু প্রথিতযশা মানুষ।

ছাত্রাবস্থাতেই সমাজ-রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণমূলক লেখালিখি শুরু করেন তিনি। অত্যন্ত সহজ-সরল বাক্যে নির্মিত তাঁর রচনাশৈলী এবং যুক্তিসিদ্ধতা সেই প্রজন্মের পাঠকদের মাঝে দ্রুত সমাদর লাভ করে। ছয়ের দশক ছিল অধিকার আদায়ের রাজনীতির উত্তাল দশক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তিনি যুক্ত হন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন বিপিএসএফ-এর সঙ্গে এবং অচিরেই তিনি রাজ্য-সম্পাদক নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক কারণে সাতের দশকে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। একমাস কারাবাসের পর মুক্ত হন তিনি।

একদিকে উনিশ শতকের নানামাত্রিক চিন্তাচেতনার প্রভাব, অন্যদিকে মনোভুবনে জিজ্ঞাসার অবিরাম পালাবদল, বছর দুই-এর মধ্যেই সরে এলেন প্রায়োগিক রাজনীতি থেকে। বুঝলেন, রাজনীতি তাঁর উপযুক্ত জায়গা নয়। তাই পরবর্তীকালে বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গর সঙ্গে নিকট সম্পর্ক থাকলেও সক্রিয় রাজনীতি আর করেননি‌। তবে বিভিন্ন সমাজ-রাজনৈতিক সংগঠন আয়োজিত আলোচনাসভায় আমন্ত্রিত বক্তা হয়ে অংশগ্রহণ করেছেন।  

সাতের দশকে যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও স্নায়ুযুদ্ধর অভিঘাত আছড়ে পড়ছে মননবিশ্বে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে লাখে লাখে মানুষ নেমে আসছে রাস্তায়, বাংলার আকাশে নকশাল বসন্তর বজ্রনির্ঘোষ, মানবমুক্তির আশায় আশান্বিত হলেও নির্বিকার প্রবুদ্ধ তিনি- ফলিত রাজনীতির সঙ্গে তাত্ত্বিক রাজনীতির দূরত্ব অনুভব করলেন। বুঝলেন, ভারতের ক্ষেত্রে এই দূরত্ব এক বাধা, অতএব তাকে অতিক্রম করতে হবে। ক্রমসম্প্রসারিত হলো তাঁর ভাবনাবিশ্ব, বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পরিণত তত্ত্ববিশ্বর চারণভূমিতে দাঁড়িয়ে তিনি গ্রহণ করলেন আরো কঠিনতর দায়িত্বভার। তাঁর কাজ হয়ে উঠল, 'তাত্ত্বিক মার্কসবাদ-লেনিনবাদ' এবং ভারতীয় বস্তুবাদী দর্শনের সহজবোধ্য পুনর্বিশ্লেষণ ও পুনর্ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা। এক আশ্চর্য স্বকীয়তায় ঋদ্ধ বিশ্লেষণ পদ্ধতির প্রয়োগ ও নতুন তাৎপর্য উদ্ভাবনের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের ধারাটিকে আরও দৃঢ়তর অবস্থানে দেখতে চান তিনি। কারণ তিনি জানেন, সলতে ঠিকঠাক পাকানো না গেলে আগুন জ্বালানো বৃথা।                

ছয়ের দশকে BPSF-এর উদ্যোগে কলকাতার তৎকালীন মার্কিন তথ্যকেন্দ্র-USIS-এর সামনে ভিয়েতনামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নকল রাষ্ট্রসংঘের অধিবেশনে, আসামীর কাঠগড়ায় মার্কিন রাষ্ট্রপতি লিন্ডন বরিস জনসনের ভূমিকায় রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

পেশায় ছিলেন শিক্ষক‌। কলকাতার ব্রাহ্ম-সমাজী আনন্দমোহন কলেজে সান্ধ্য-ইংরেজি বিভাগের রিডার হিসেবে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। দীর্ঘ অধ্যাপনার জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন ২০০৭-এ। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'আর্টস অ্যান্ড কমার্স কলেজ'-এর ইংরেজি বিভাগের স্নাতকোত্তর পঠনপাঠন বিভাগের 'অতিথি অধ্যাপক' হিসেবে শিক্ষাদানের কাজে নিযুক্ত হন তিনি । ২০০৯ থেকে ২০১০ পর্যন্ত দিল্লির 'ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ফিলোজফিক্যাল রিসার্চ'-এর 'ভিজিটিং প্রফেসর' এবং ২০০৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত দিল্লির 'ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশন'-এর 'এমেরিটাস ফেলো' হিসেবে দায়িত্বভার সামলেছেন। আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন কলকাতার 'পাভলভ ইনস্টিটিউট'-এর সমাজবিজ্ঞান, দর্শন ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণাধর্মী পত্রিকা 'মানবমন'-এর সঙ্গে । লিখেছেন 'পরিচয়', 'অনুষ্টুপ', 'চতুরঙ্গ'-সহ নানা বাংলা-ইংরেজি পত্রিকায়। অন্যদিকে, কোনওদিনই বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠীর কাগজ বা সংবাদপত্রর অনুরোধ এলে, লিখতে অস্বীকার করেছেন তিনি।       

বস্তুবাদী দৃষ্টিতে ভারততত্ত্ব চর্চায় অধ্যাপক ভট্টাচার্যর মনীষা ছিল প্রজ্ঞালব্ধ মৌলিক চিন্তারাশির ব্যাপক সমাহার। বৌদ্ধ দর্শন, চার্বাক/লোকায়ত দর্শনের পাশাপাশি মার্কসীয় দ্বন্দ্বতত্ত্ব, বস্তুবাদ ও সমাজবিজ্ঞানের ইতিহাস-সম্বন্ধিত তাঁর রচনাসম্ভারে দীপ্ত মননশীলতার সঙ্গে ছিল সূক্ষ্ম সৃজনশীলতার অভূতপূর্ব মেলবন্ধন। তাঁর অন্বেষণ ছিল বিচিত্র, চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রটি ছিল বহুস্তরীয় ও সর্বব্যাপ্ত । তাঁর রচনা যেমন ভরে থাকত ভারত ও ইউরোপের পৌরাণিক মহাকাব্য, ধ্রুপদী থেকে আধুনিক সাহিত্যের পাঠ-পর্যালোচনায়; আবার তেমনই বিশ্বজুড়ে চলা নান্দনিক ভাষ্যের নানা বহুমাত্রিক দিকগুলি সম্পর্কেও আলোকপাত করে তিনি দুই খণ্ডে লিখেছিলেন 'মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব'। নন্দনতত্ত্বকে কেন্দ্র করে সমাজবাস্তবতার নিরিখে যৌক্তিকতাবাদী দৃষ্টিতে রচিত এরকম একটি গ্রন্থ বিশ্বের কোনও গ্রন্থাগারে আর দ্বিতীয়টি নেই। সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, রাজনৈতিক বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর নিরলস, সুগভীর চিন্তাভাবনার ফসল ২৮টি বিচার-বিশ্লেষণধর্মী মৌলিক গ্রন্থ এবং ১৭৫টির অধিক সন্দর্ভ। 

বিগত শতাব্দীজুড়ে একদিকে যখন ভারতীয় ব্রাহ্মণ পরম্পরার চিন্তা-প্রস্থান 'বেদান্ত' বা 'উপনিষদ'-কেই ভারতীয় প্রজ্ঞার একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে হাজির করা হচ্ছে, তখন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সেই অলীক একত্ববাদী ধারণার ওপর 'কামারের এক ঘা' দিয়ে সামনে নিয়ে আসছেন শ্রমণ-পরম্পরার চিন্তা-প্রস্থান বৌদ্ধ দর্শন, চার্বাক দর্শনকে। ২০০৯-এ প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘স্টাডিজ অন দি চার্বাক/লোকায়ত’ এবং ২০২০-তে 'মোর স্টাডিজ অন দি চার্বাক/লোকায়ত'। প্রকাশিত হয় কেমব্রিজ স্কলার প্রেস থেকে। এক্ষেত্রে বলা যায়, ভারতীয় দর্শনধারার প্রাথমিক স্তরের বস্তুবাদ বা চার্বাক দর্শনচর্চার সূচনা করেছিলেন দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। সেখান থেকে অনেকটা এগিয়ে তাকে সমৃদ্ধতর জায়গায় নিয়ে গেছেন তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসূরি রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য।

নিজের ঘরে আত্মমগ্ন

তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু পাভলভ ইনস্টিটিউটের গবেষক বাসুদেব মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, "রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর জ্ঞানপ্রভা ছিল ঝলসে দেওয়ার মতো। ভারতীয় মনোবিজ্ঞানের পথিকৃৎ ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের চেয়ে বয়সে অনেক অনুজ হলেও তিনি রামকৃষ্ণদার পাণ্ডিত্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথকেও যথেষ্ট শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন তিনি।... আমার মনে হয়েছে তাঁরা দু'জনেই ছিলেন রেনেসাঁ আন্দোলনের পক্ষপাতী।" 'চেতনালহর' পত্রিকার সম্পাদক অনন্ত আচার্য জানিয়েছেন, "সর্বার্থেই তিনি ছিলেন এক ব্যতিক্রমী চিন্তাবিদ, তাঁর চলে যাওয়া চিন্তাচর্চার খোলামাঠে এক স্থায়ী শূন্যস্থান তৈরি করল, এই শূন্যস্থান সহজে পূরণ হওয়ার নয়।"

সাম্রাজ্যবাদের প্রতি, বৈষম্যর প্রতি, মানুষে মানুষে বিভাজনের প্রতি অধ্যাপক রামকৃষ্ণর ছিল অনির্বাণ ঘৃণা। সমাজ-রূপান্তরই ছিল তাঁর সুগভীর জ্ঞানচর্চার মূল উদ্দেশ্য। দায়বদ্ধতা ছিল শুধুমাত্র মেহনতি মানুষের এবং তাঁদের নিয়ে যাঁরা চিন্তাশীল- সেই অংশের প্রতি। 'কমিউনিজম কী' তাঁর শেষ গ্রন্থ । বলা যায়, এক শৃঙ্খলমুক্ত পৃথিবী নির্মাণের এমনতর গভীর উপলব্ধিই তাঁর জ্ঞানচর্চার প্রকৃত ইন্ধন। তাঁরই কথায়, "অন্ধকার বলে কোথাও কিছু নেই, যা আছে তা কেবলই আলোর অভাব, পারলে একটা প্রদীপ জ্বেলো‌।"                 

More Articles