ড্রোন নয়, সমুদ্রে বেপথুকে খুঁজতে একসময় ব্যবহার হত কবুতর-বাহিনী

Pigeons, Sea Rescuers: সবচেয়ে বড় কথা অনেক সহজে অতিবেগুনি রশ্মি বা ইউভি লাইট চোখে দেখতে পায় পায়রারা। আর সেই গুণটাই কাজে লাগাতে চেয়েছিল মার্কিন উপকূলরক্ষা বাহিনী।

সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া নাবিককে দিশা দেখাত লাইট হাউজেরা। সেই বাতিঘরের আলো বন্দরে ফিরিয়ে আনত বেপথু নাবিক, সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া মানুষকে। কিন্তু বাতিস্তম্ভের আলো দেখে যে ফিরে আসতে পারবে না নিজে নিজে, তাঁকে কীভাবে খুঁজে বের করা হবে।

এখন তার জন্য উপকূলরক্ষা বাহিনীর কাছে নানা কৌশল, নানা ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে টহলদার হেলিকপ্টার, ড্রোন দিয়ে নজরদারির ব্যবস্থা। কিন্তু একটা সময় ছিল, যখন এত সব প্রযুক্তিগত সাহায্য থাকত না উপকূলরক্ষী বাহিনীর কাছে। ফলে সে সময় ভরসা করতে হত এমন কিছুর উপরে যা আসলে ভীষণ রকম প্রাকৃতিক।

আরও পড়ুন: টয়লেট পেপার নয়, এক সময়ে ভুট্টাই ছিল মানুষের শৌচাগারের অন্যতম সঙ্গী

এখনকার মতো আধুনিক ড্রোন তাদের হাতে না থাকলেও তাদের হাতে এক প্রাকৃতির ড্রোন তুলে দিয়েছিল প্রকৃতি। প্রয়োজন ছিল শুধু প্রশিক্ষণের। কবুতরের পায়ে বেঁধে চিঠি আদানপ্রদানের গল্প তো আমরা অনেক শুনেছি। এমনকী নব্বই দশকের একটি হিন্দি ছবিতে দুর্দান্ত ভাবে প্রদর্শিত হয়েছিল পায়রার এই দুর্দান্ত ক্ষমতা। এমনকী তা নিয়ে একটি জনপ্রিয়তম গানও রয়েছে লতা মঙ্গেশকর ও বালা সুব্রহ্মন্যমের গলায়। কিন্তু সেই পায়রাই যে এনে দিতে পারে অতল সমুদ্রের মাঝখানে হারিয়ে যায় বিপন্ন মানুষের খোঁজ, তা ভাবা কঠিন। কিন্তু একটা সময় এমন কাজই করেছিল মার্কিন উপকূলরক্ষী বাহিনী।

তা সেনাবাহিনীর কাজে এমন প্রাণীদের ব্যবহার নতুন কিছু নয়। পুলিশ কুকুর বা সেনাকুকুরের ব্যবহার তো আমরা প্রায়শই দেখি বিভিন্ন অভিযানে। বহু সময়েই জলের নিচে নজরদারির জন্য ডলফিনদের ব্যবহার করার নজির ছিল, এমনকী কাজে লাগানো হত উটকেও। আর এমন সব নজিরই বোধহয় মার্কিন সেনাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল পায়রাকে ড্রোন হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে।

সেটা ১৯৭০ সালের ঘটনা। একবার মার্কিন উপকূলরক্ষী বাহিনী ঠিক করেন, তারা এবার থেকে সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খোঁজা ও উদ্ধারের কাজে ব্যবহার করবেন পায়রাকে। ওই প্রকল্পের নাম রাখা হল প্রজেক্ট সি হান্টস গোল। যন্ত্রের বদলে রিয়েল টাইম স্পটার দিয়ে উদ্ধারকাজ চালানো আরও বেশি সহজ হবে। এমন একটা বিশ্বাস থেকেই শুরু হল পায়রাদের প্রশিক্ষণ। যদিও উপদ্রবকারী পাখি হিসেবে বেশ নামডাক ছিল পায়রার, তা সত্ত্বেও দু'টো গুণের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল পায়রাকেই। কী কী গুণ! প্রথমত, খুব তাড়াতাড়ি প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় পায়রাকে, দ্বিতীয়ত পায়রার চোখের দৃষ্টি মারাত্মক। অন্যান্য বহু পাখির মতোই পায়রাও বহু দূরের জিনিস চোখে স্পষ্ট দেখতে পায়। সবচেয়ে বড় কথা অনেক সহজে অতিবেগুনি রশ্মি বা ইউভি লাইট চোখে দেখতে পায় পায়রারা। আর সেই গুণটাই কাজে লাগাতে চেয়েছিল মার্কিন উপকূলরক্ষা বাহিনী।

প্রায় ৬ মাস ধরে লাগাতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল একদল পায়রাকে। হলুদ, কমলা ও লাল রঙের যে কোনও বস্তু যাতে সমুদ্রের মধ্যে থেকে চিহ্নিত করতে পারে তারা। কেন এই তিনটি রং! কারণ যে কোনও ভাসমান ডিভাইস বা রাফ্টের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রচলিত রং নাকি এই তিনটেই। প্রশিক্ষণের পর হেলিকপ্টারের নিচে পায়রাদের জন্য তৈরি হয় একটি বিশেষ চেম্বার, যেখান থেকে নীচেটা স্পষ্ট দেখা যায়। এমনভাবেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, যাতে উজ্জ্বল কোনও রং দেখতে পেলেই তারা সেই কক্ষে রাখা বিশেষ প্যাডেলে চাপ দেয়, এবং সেই সংকেত চলে যায় সোজা উপকূলরক্ষী বাহিনীর কাছে। পরীক্ষায় দেখা যায়, ৯০ শতাংশ সময়েই ওই উজ্জ্বল জিনিসগুলি চিহ্নিত করতে সফল হয়েছে পাখিগুলি। যেখানে মানুষের সাফল্য়ের হার মাত্র ৩৮ শতাংশ। ফলে এই প্রকল্প যে সুপারডুপার হিট হয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এই প্রকল্পের খরচ ছিল বেশ বেশি। আগামী দু'বছরে এই প্রকল্প বাবদ যে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিল উপকূলরক্ষী বাহিনী, তা ছিল চমকে ওঠার মতোই। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ১২ কোটি টাকারও বেশি অর্থমূল্যের লক্ষ্য রেখেছিল তারা। ১৯৮০ সাল নাগাদ ফেডারেল বাজেট কমানোর প্রশ্ন উঠতেই প্রথম কোপ পড়ে প্রজেক্ট সি হান্ট-এ। বন্ধ হয়ে যায় পায়রাদের প্রশিক্ষণ ও তাদের দিয়ে উদ্ধারের কাজও।

এর মধ্যে আরও একটু দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। গোটা প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় প্রথম যে তিনটি পায়রা উপকূলরক্ষী বাহিনীর স্কুল থেকে স্নাতক হয়ে ফিরেছিল, একটি দুর্ঘটনায় তাদের হারায় আমেরিকা। এরবার একটি অভিযানে গিয়ে জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে সমুদ্রে ভেঙে পড়ে একটি কপ্টার। পাইলট-সহ অন্যান্যরা বেরিয়ে আসতে পারলেও সলিল সমাধি হয় তিনটি পায়রার। ওই প্রজেক্ট সি হান্টের আওতায় প্রায় ১০টি পায়রাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল নৌবাহিনী। তার জন্য ভালোই খরচা করতে হয়েছিল উপকূলরক্ষা বাহিনীকে।

আরও পড়ুন: গাছ চেরাই নয়! জানেন, চেনের করাত প্রথম আবিষ্কার হয়েছিল সন্তানের জন্ম দিতে!

যাই হোক, খরচ, পরিশ্রম, প্রশিক্ষণ ও লক্ষ্যবস্তু খুঁজে আনতে প্রায় ৯০ শতাংশ সাফল্যের পরেও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি পায়রার ব্যবহার। তার জায়গা পরবর্তীকালে নেয় ড্রোন। আরও তীক্ষ্ণ, আরও নির্ভুল দৃষ্টিতে সমুদ্রে বেপথু মানুষকে, জাহাজ কিংবা নৌকাকে খুঁজে আনছে তারা। ব্যবহার চলছে কপ্টারেরও। তবে যে ভাবে পায়রাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের অভিনব ভাবে কাজে লাগিয়েছিল সে সময় মার্কিন উপকূলরক্ষা বাহিনী, তা কিন্তু জায়গা করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।

More Articles