হামাস-ইজরায়েলের সবচেয়ে বেশি ফেক নিউজ ছড়াচ্ছে কোন দেশ? উত্তর অবাক করবে...
Hamas Israel War Fake News : এই মিথ্যা ভিডিওগুলি শেয়ার করা অনেক অ্যাকাউন্টই X-এ মুসলিম বিরোধী মন্তব্য পোস্ট করে নিয়মিত।
একটা প্রচলিত কথা আছে, যুদ্ধে প্রথম নিহত হয় সত্য। প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলের দখলদারিত্ব, প্রতিশোধ নিতে হামলা, ইজরায়েলের পাল্টা হামলায় শুরু হওয়া যুদ্ধে এই কথাটিই যেন ফের প্রমাণ হচ্ছে। যুদ্ধে মানুষ মরছে, বাড়ি গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, পাশাপাশিই খুন হচ্ছে সত্য। ইজরায়েল প্যালেস্তাইনের যুদ্ধ ধীরে ধীরে এগোচ্ছে প্যালেস্তাইন বিরোধিতা এবং ইসলামোফোবিয়ার দিকে। সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে এলন মাস্কের X-এর সৌজন্যে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও, ছবি আর তর্কে এই ইসলাম বিরোধিতা সুস্পষ্ট। ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইজরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে বিভ্রান্তিকর তথ্য ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক জানলে অবাক হয়ে যেতে হয়। এর বেশিরভাগই ভারতের অবস্থিত ডানপন্থী অ্যাকাউন্টগুলি থেকে তৈরি বা সেই অ্যাকাউন্ট থেকেই ছড়িয়ে দেওয়া।
কয়েকটি ভাইরাল হওয়া ফেক নিউজের মধ্যে একটি হচ্ছে সেই ভিডিও যাতে দেখানো হয়েছে হামাস একটি ইহুদি শিশুকে অপহরণ করেছে এবং একটি ট্রাকের পিছনে একটি ছোট বাচ্চার শিরশ্ছেদ করেছে। ব্লু টিক থাকা অ্যাকাউন্টগুলি থেকেই এই মিথ্যা খবরগুলিকে ভাইরাল করা হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ তা শেয়ার করছেন, বিশ্বাস করছেন। এমনই এক ভাইরাল টুইট এও দাবি করে ফেলেছিল যে হামাসের হামলাটি আসলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন।
গাজার যুদ্ধে এই ইসলামোফোবিয়া কেন এত ছড়াল ভারত থেকে? ভারতের অন্যতম নামী ফ্যাক্ট-চেকিং পরিষেবা BOOM বেশ কিছু এমনই 'ভেরিফায়েড' এক্স ব্যবহারকারী খুঁজে বের করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই প্রভাবশালীরা নিয়মিতভাবে বিভ্রান্তিকর তথ্য শেয়ার করেছে। বেশিরভাগই প্যালেস্তাইনকে আক্রমণ করছে আর ইজরায়েলকে সমর্থন করছে। ফিলিস্তিনিদেরকেই সবচেয়ে নৃশংস হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে এই অ্যাকাউন্টগুলি।
আরও পড়ুন- ইজরায়েলের ডানপন্থী সরকার প্যালেস্তাইনের হামাস, দুইয়ের পতন চাই
একটি এমনই অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ভিডিও প্রচার করা হয় দাবি করা হয়েছে যে বেশ কিছুজন তরুণীকে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা 'যৌনদাসী' হিসেবে ব্যবহার করছে৷ তবে, ভিডিওটি সম্ভবত জেরুজালেমের স্কুলের। ভিডিওটির গুণমান তুলনামূলকভাবে নিম্ন হলেও ভালো করে দেখলেই বোঝা যাবে মেয়েরা হেসেখেলে আনন্দ করছে, গল্প করছে, ফোন ঘাঁটছে। তা সত্ত্বেও এই ভিডিওটি হাজার হাজারবার রিটুইট হয়েছে, কমপক্ষে ৬০ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছেছে৷ ভিডিওটি শেয়ার হয়েছে কোথায় কোথায়? অ্যাকাউন্টগুলি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেশিরভাগই ভারতে অবস্থিত। এমনকী ভারত থেকে পরিচালিত ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স বা ওএসআইএনটি চ্যানেল অ্যাংরি স্যাফ্রনের টেলিগ্রাম চ্যানেলেও এটি শেয়ার করা হয়েছিল।
অন্য একটি ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে দাবি করা হয়েছে যে, হামাস একটি ইহুদি শিশুকে অপহরণ করছে। ভিডিওটি একটি পোস্টেই এক মিলিয়নেরও বেশি ভিউ পেয়েছে। বলা বাহুল্য ভিডিওটি ভুয়ো। এই মিথ্যা ভিডিওটি যারা যারা শেয়ার করেছেন, যেখান থেকে সবচেয়ে বেশি ভিউ এসেছে সেই ১০ টি টুইটের মধ্যে ৭টিই ভারতের মানুষের প্রোফাইল বা তাদের বায়োতে ভারতীয় পতাকা রয়েছে৷ এই সাতটি টুইটই X-এ ৩ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে। এই ভিডিওটি আসলে সেপ্টেম্বরের এবং গাজার সঙ্গে এই অপহরণের কোনও সম্পর্কই ছিল না।
এই মিথ্যা ভিডিওগুলি শেয়ার করা অনেক অ্যাকাউন্টই X-এ মুসলিম বিরোধী মন্তব্য পোস্ট করে নিয়মিত। একটি অ্যাকাউন্ট থেকে হামাসের ওই শিশুর শিরশ্ছেদ করার মিথ্যা ভিডিও শেয়ার করা হয়েছিল। সেই পোস্টে ওই ব্যক্তি #IslamIsTheProblem হ্যাশট্যাগটিও ব্যবহার করেছেন।
অন্য একটি অ্যাকাউন্ট যেটি থেকে ফিলিস্তিনিদের ওই যৌনদাসী অপহরণ করার ভুয়ো ভিডিও শেয়ার করা হয়, সেই অ্যাকাউন্টেই লেখা হয়েছিল “মুসলিম মেয়েরা হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হলে তখন তারা সুখে থাকে। কিন্তু হিন্দু মেয়েরা যখন ইসলাম গ্রহণ করে তখন তাদের হয় স্যুটকেস বা ফ্রিজে রাখা হয়।”
প্যালেস্তাইনের প্রতি বিদ্বেষ আরও স্পষ্ট হয়েছে নানা মন্তব্য, ট্যাগ ও ক্যাপশনে। একটি ভারতীয় অ্যাকাউন্ট, যা নাকি একজন অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় সৈনিকের সেখানে তিনি পোস্ট করেছেন, "ইসরায়েলকে অবশ্যই প্যালেস্তাইনকে এই গ্রহ থেকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে।"
ভারতের যে ইসলামোফোবিয়া রয়েছে তা নতুন ঘটনা নয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) উত্থানের পর থেকে এই ফোবিয়া বৃদ্ধি পেয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ইসলামিক কাউন্সিল অফ ভিক্টোরিয়ার একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সমস্ত ইসলামোফোবিক টুইটগুলির বেশিরভাগই ভারত থেকে পাওয়া যায়।
ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা দেখে তাই লাখে লাখে ইসলামবিদ্বেষী মানুষ পতঙ্গের মতো ধেয়ে এসেছে। সোশ্যাল মিডিয়াই তার হাতে গরম প্রমাণ। এই অনলাইন বিদ্বেষের শিকড়ে রয়েছে বিজেপির আইটি সেল। ইজরায়েল প্যালেস্তাইনের যুদ্ধ আসলে বিজেপির একটি সুযোগ, এই দেশে ঘৃণার যজ্ঞে টাটকা আহুতি মাত্র।
আরও পড়ুন- এই মৃত্যু যেন আপনার ঘুম কেড়ে নেয়…
'আই অ্যাম আ ট্রোল' বইয়ের লেখক স্বাতী চতুর্বেদী লিখেছেন, বিজেপির অনলাইন সোশ্যাল মিডিয়া আর্মি আসলে গেরুয়া দলের স্বেচ্ছাসেবকদের একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। রাষ্ট্রের সমালোচনা করলে সেই অ্যাকাউন্টের মালিকের কী করতে হবে, কতটা ট্রোল করতে হবে সেই জন্য জন্য সোশ্যাল মিডিয়া সেল এবং আরও দু'টি বিজেপি অনুমোদিত সংস্থা থেকে নির্দেশ পায়। এই স্বাতী চতুর্বেদী নিজে কাজও করেছেন। বিদ্বেষ, ইসলামফোবিয়া এবং ঘৃণার পাঁকে জীবনকে তলিয়ে যেতে দেখে তিনি আইটি সেল ছেড়ে বেরিয়ে আসেন।
ভারতীয় ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট AltNews-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সম্পাদক প্রতীক সিনহা টুইট করেছিলেন, “ভারত এখন ভারতীয় মূলধারার মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে ইজরায়েলের সমর্থনে বিভ্রান্তিকর সব তথ্য ছড়াচ্ছে। আশা করি বিশ্ব এবার বুঝবে কীভাবে ভারতীয় ডানপন্থীরা ভারতকে বিশ্বের বিকৃত তথ্যের রাজধানী করে তুলেছে।”
এলন মাস্ক টুইটার অধিগ্রহণ করার পরে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে পড়া মিথ্যা তথ্য আটকাতে উঠে পড়ে লাগার কথা বলেছিলেন। মেটা এবং ইউটিউবের মতো কোম্পানিগুলিও তাদের মঞ্চের মাধ্যমে ঘৃণামূলক বক্তব্য, বিভ্রান্তিকর বিষয় এবং অন্যান্য ক্ষতিকর বিষয়বস্তু আটকাতে নানা চেষ্টা করেছে। গত সপ্তাহে, ইউরোপিয় ইউনিয়ন ইজরায়েলের উপর হামাসের হামলার পরে এক্স-এ বিভ্রান্তিকর তথ্যর বন্যা দেখে মাস্ককে সতর্কবার্তাও পাঠায়।
ইজরায়েলের প্রতি পশ্চিমি বিশ্বের সমর্থন এবং ভারত থেকে ডানপন্থী ইসলামোফোবিক অ্যাকাউন্টগুলির ক্রমে সক্রিয় হয়ে ওঠা কি এদেশে কোনও প্রভাবই ফেলবে না? যে দেশের রাজনীতিতে সংখ্যালঘুই বড় ইস্যু, সেখানে গাজার সংকটকে নিছক ফিলিস্তিনি ও মুসলিমদের প্রতি ঘৃণার অস্ত্র করে আখেরে নিজেদের কার্যসিদ্ধি কি করবে না রাষ্ট্রের শাসক? ডানপন্থী সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলিই এর বড় উত্তর।