"আজ আছি, কাল নাও থাকতে পারি", মৃত্যুর একদিন আগেই নিয়তির আঁচ পেয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী?
Last Days of Indira Gandhi : ভুবনেশ্বরের সেই সভা, বক্তৃতা… গোটা দেশবাসীর বারবার মনে পড়ছিল সেটা। মৃত্যুর পদধ্বনি আগেভাগেই পেয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী?
১৯৮৪ সালের ৩০ অক্টোবর। ওইদিন গোটা দেশের নজর ছিল ভুবনেশ্বর শহরের দিকে। সমস্ত সংবাদমাধ্যম, ক্যামেরা ওড়িশার এই শহরের দিকে তাক করা। মঞ্চও সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি করা হয়েছে। কারণ, একটু পরেই এখানে বক্তৃতা দিতে উঠবেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বক্তৃতার খসড়া নিয়ে আলাপ আলোচনা আগেই সেরে রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা এইচ ওয়াই শারদা প্রসাদ। সেইমতো খসড়াপত্রও তৈরি রেখেছেন নিজের কাছে। এই বক্তৃতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই সবদিক দিয়ে তৈরি থাকতে হবে।
কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? কারণ, ১৯৮৪ সালেই মাত্র কয়েক মাস আগে, জুনে হয়ে গিয়েছে ‘অপারেশন ব্লু স্টার’। অজস্র রক্ত দেখেছিল স্বর্ণ মন্দির। মারা গিয়েছিলেন অনেক শিখ। এরপরই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে যায়। ইন্দিরা গান্ধী তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, তাঁর নির্দেশেই এমনটা হয়েছে। ফলে গোটা শিখ সমাজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো, গোয়েন্দা, পুলিস সবাই বারবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে ছুটছে। তাঁর শিখ নিরাপত্তারক্ষীদের সরিয়ে দেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে। হামলা হতে পারে ইন্দিরা গান্ধীর ওপর। কিন্তু তিনি যে ‘লৌহমানবী’! ধর্মনিরপেক্ষ দেশে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের হওয়ার জন্য কেন কাউকে সরিয়ে দেওয়া হবে কাজ থেকে? সমস্যা তো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ে; সাধারণ শিখরা কী করেছেন?
আরও পড়ুন : “আমি চাইলে ইন্দিরা গান্ধী নাচবেন,” কেন বিতর্কিত এই মুখ্যমন্ত্রীকে সম্মান জানিয়েছিল ৩ টি দেশ!
তারপরই অক্টোবরের শেষে ভুবনেশ্বরে সভা। বক্তৃতার খসড়া নিয়ে মঞ্চে উঠলেন ইন্দিরা গান্ধী। ভাষণ চলছে ভাষণের মতো। হঠাৎই চমক ভাঙল শারদা প্রসাদের। এখন ইন্দিরা গান্ধী যে কথাগুলো বলছেন, সেগুলো তো লেখা ছিল না। খসড়ার বাইরে গিয়ে এ কি বলছেন প্রধানমন্ত্রী?
“আমি আজ, এই মুহূর্তে বেঁচে রয়েছি। কাল নাও থাকতে পারি। অনেকদিন বেঁচেছি। কিন্তু আমি কোনও অনুতাপ পুষে রাখিনি মনে। পুরো জীবনটাই দেশের কাজে উৎসর্গ করেছি। আর যে কয়েকদিন বাঁচব, দেশের কাজেই নিজেকে নিয়োজিত রাখব। আমার শেষ রক্তের ফোঁটাটুকুও যেন ভারতকে মজবুত করে।”
স্তম্ভিত হয়ে গেলেন নেতা মন্ত্রীরা। স্তম্ভিত জনতা। হঠাৎ এ কি বললেন ইন্দিরা গান্ধী! মৃত্যুর কথা কেন বলছেন তিনি? ওড়িশার রাজ্যপাল বললেন, আপনি তো ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন! তখনও নির্বিকার ‘লৌহমানবী’! তিনি যে মনের কথাই বলেছেন। বলতে ইচ্ছে করছিল যে!
ঠিক তার পরেরদিনের ঘটনা। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। ওইদিন অনেকগুলি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল ইন্দিরা গান্ধীর। প্রথমেই তথ্যচিত্রকার পিটার উস্তিনভের সঙ্গে মিটিং ছিল। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর ওপর তখন একটা তথ্যচিত্র বানাচ্ছিলেন। তারপর ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যালিঘানের সঙ্গে বৈঠক ছিল। সন্ধ্যায় বাকিংহাম প্যালেসের রাজকুমারী অ্যানের সম্মানে ডিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে ব্যস্ত শিডিউল। গেরুয়া শাড়ি পরে পরিপাটি করে তৈরি হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এবার নিজের বাসভবন থেকে যাবেন আকবর রোডের অফিসে। কাছাকাছি বাড়ি, তাই ভেতর থেকেই রয়েছে রাস্তা।
সেই রাস্তা দিয়েই একটু একটু করে এগোচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সঙ্গে ছাতা হাতে সিপাহী নারায়ণ সিং; পেছনে ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধাওয়ান, নিরাপত্তা অফিসার রামেশ্বর দয়াল। ইন্দিরা গান্ধীর একটু পাশেই ছিল নিরাপত্তাকর্মী বিয়ন্ত সিং। হঠাৎই তৎপর হয়ে উঠল সে। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে সটান গুলি চালাল। লক্ষ্য? ইন্দিরা গান্ধী! তিনি দেখলেন, তাঁর পেটে গুলি লেগেছে। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরও দুটি গুলি ছুটে আসে। কোমর আর বুক ভেদ করে চলে যায় সেটা। বিয়ন্ত সিং চিৎকার করে ওঠে, ‘গুলি চালাও!’
আরও পড়ুন : বন্ধ ঘরে যোগশিক্ষার আড়ালে… ইন্দিরা-যোগগুরুর সম্পর্ক নিয়ে ফিসফাস চলে আজও
কাকে বলল এমনটা? দেখা গেল, খানিক দূরেই দাঁড়িয়ে আছে আরেক নিরাপত্তারক্ষী সতবন্ত সিং। হাতে অটোমেটিক কার্বাইন। ঘটনার প্রাথমিক ঝটকায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল সে। বিয়ন্ত সিংয়ের চিৎকারে ‘সম্বিত’ ফিরল। কার্বাইনের চেম্বারে থাকা ২৫টি গুলিই চালিয়ে দিল ইন্দিরা গান্ধীকে লক্ষ্য করে। গেরুয়া, কালো পাড় শাড়ির রং বদলে গেল মুহূর্তে। মাটি ভেসে গেল রক্তে…
এত দ্রুত ও আকস্মিক এই ঘটনা ঘটল যে, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে থাকা মানুষজনও ঘাবড়ে গেল। নিরাপত্তা অফিসার রামেশ্বর দৌড়ে এলেও পায়ে সতবন্তের গুলি খেয়ে পড়ে যান। এদিকে ভেতর থেকে তড়িঘড়ি বেরিয়ে আসেন রাজীব-পত্নী সোনিয়া গান্ধী। আকবর রোড থেকে ছুটে এল পুলিস ফোর্স। ততক্ষণে বন্দুক ফেলে দাঁড়িয়ে পড়েছে বিয়ন্ত আর সতবন্ত সিং। কেবল একটিই কথা বলল তারা, “আমাদের যা করার ছিল, করে দিয়েছি। এবার আপনাদের যা করার, করুন।” তড়িঘড়ি গ্রেফতার করা হল দুজনকে।
এই ঘটনা কি দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার ফল? কারণ, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনের এলাকায় একটা অ্যাম্বুলেন্স সবসময় থাকত। ঘটনাচক্রে, ১৯৮৪-র ৩১ অক্টোবরের দিনটিতেই সেই অ্যাম্বুলেন্সের চালক আসেননি। বাধ্য হয়ে সাদা অ্যাম্বাসাডর করে রক্তাক্ত ইন্দিরা গান্ধীকে দিল্লি এইমসে নিয়ে যাওয়া হয়। শাশুড়িকে আগলে গাড়িতে বসেন সোনিয়া গান্ধীও। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতা ছিল এমনই, বাড়ি থেকে কেউ এইমসে ফোন করে এমারজেন্সি সংবাদও দেননি। তাই কেউই প্রস্তুত ছিল না। গাড়ি থেকে নামিয়ে জরুরি বিভাগে ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে যেতে মিনিটখানেক সময় লাগে।
আরও পড়ুন : ‘বাংলাদেশি বাবু’ ও ইন্দিরা গান্ধীর কণ্ঠস্বর! দেশের সবচেয়ে বড় রহস্য আজও অধরা
সবাই বুঝেছিলেন, আর কিছু করার নেই। এতগুলো গুলি শরীর ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, রক্তে ভেসে গিয়েছে সমস্ত দেহ। গুলিতে ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুস, যকৃত। পাঁজরের হাড় ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছে। অন্ত্রেও মারাত্মক আঘাত। মস্তিস্কেও আঘাত লেগেছে। নাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না, স্থির চোখ, দেহের তাপমাত্রা একটু একটু করে কমছে। তবুও চেষ্টা করেছিলেন ডাক্তাররা। কিন্তু, কিছু যে করা যাবে না আগেই বুঝে গিয়েছিলেন সবাই। ঘটনার চার ঘণ্টা পর ডাক্তাররা ইন্দিরা গান্ধীকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। সন্ধ্যায় গোটা দেশে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে। ভুবনেশ্বরের সেই সভা… সেই বক্তৃতা… গোটা দেশবাসীর বারবার মনে পড়ছিল সেটা। মৃত্যুর পদধ্বনি আগেভাগেই পেয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী?