পিসিওডি দ্বারা কি আপনিও আক্রান্ত? উপসর্গগুলো বুঝবেন কী করে? চিকিৎসাই বা কী?

বর্তমানে মহিলাদের মধ্যে পিরিয়ডজনিত সমস্যার প্রভাব খুব বেশি। অনিয়মিত মাসিক চক্র গড়ে ৫ জনের মধ্যে ৩ জন মহিলার মধ্যে বিদ্যমান। অনিয়মিত মাসিক চক্রের বিভিন্ন ধরণ; কারোর ক্ষেত্রে মাসিক পিছিয়ে যায়, কারোর ক্ষেত্রে কোনও কোনও মাসে মাসিক হয়ই না, আবার কারোর কারোর ক্ষেত্রে একই মাসিক চক্রে একাধিক বার হয়। এটি একটি রোগ যার নাম পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম বা পিসিওডি বা পিসিওএস। বর্তমানে মহিলাদের মধ্যে বিস্তীর্ণ ভাবে ছড়িয়ে পড়া এই রোগের ব্যাপারে অনেক মহিলাই এখনও ওয়াকিবহাল নয়।

পিসিওডি কী? কেন হয়? :-

পিসিওডি বা পিসিওএস বিশেষত মহিলাদের শরীরে হরমোনাল ডিসব্যালেন্সের কারনে হয়ে থাকে। শরীরে থাকা হরমোনের অসামঞ্জস্যের কারনে মহিলাদের ওভারিতে ছোট ছোট গোলাকৃতির সিস্ট বা ক্যাপসুলের মতো দেখতে এক ধরনের থলির সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে এই থলির পরিমান ওভারিতে বাড়তে থাকে এবং মহিলাদের শরীরে নানারকম সমস্যার সৃষ্টি হতে থাকে। যার মধ্যে ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড অনিয়মিত হওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি প্রধান সমস্যা। পিরিয়ড শুরু হওয়ার পর একজন নারীর ডিম্বাশয় থেকে প্রতি মাসেই ডিম্বাণু নির্গত হয়। যৌন সঙ্গম না করলে সেই ডিম্বাণু গুলি রক্তের মাধ্যমে মহিলাদের দেহ থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু পিসিওডি’র ক্ষেত্রে হরমোনের তারতম্য ঘটায় তাতে সমস্যা দেখা দেয়। সেই অপরিণত ডিম্বাণু গুলিই দেহ থেকে বার না হতে পেরে ক্রমে তা জমে জমে ছোট ছোট সিস্টের আকার নিতে শুরু করে। শুরু হয় সমস্যার।
এছাড়াও অত্যাধিক ওজন বৃদ্ধি, মুখে ব্রণ, মুড্ সুইংস, ডিপ্রেশন প্রভৃতি সমস্যাও দেখতে পাওয়া যায়। অনেক ক্ষত্রে দেখা যায় পিসিওডি বা পিসিওএস বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে। ইদানিং পরিবেশ দূষণের কারনেও এই সমস্যার বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে। পাঁচ জন মহিলার মধ্যে গড়ে তিন জন পিসিওডি বা পিসিওএস সমস্যায় ভুক্তভোগী। ডাক্তারের মতে স্ট্রেস বা চিন্তা বৃদ্ধির কারণেও মহিলাদের মধ্যে পিসিওডি বা পিসিওএস এর সমস্যা বাড়ছে। যার ফলে মহিলাদের সন্তানধারনের সময় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। পিসিওডি হওয়ার অন্যান্য কারণের মধ্যে চিকিৎসকরা দায়ী করেছেন মহিলাদের অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রাকে। অত্যধিক পরিমাণে ফাস্ট ফুড, রেড মিট খেলেও দেখা দিতে পারে এই রোগ। মূত্রনালির সংক্রমণ এবং চিন্তার কারণেও শরীরে বাসা বাঁধতে পারে এই রোগ।

পিসিওডির উপসর্গ :-

কীভাবে বুঝবেন আপনি পিসিওডি দ্বারা আক্রান্ত? শরীরে বিভিন্ন উপসর্গগুলোর মধ্যে যেগুলো অন্যতম সেগুলো হলো অনিয়মিত মাসিক চক্র দেখা যায়। সাধারনত পিসিওডি যুক্ত মহিলারা বছরে নয় বারের থেকে কম পিরিয়ডস অনুভব করে। কিছু মহিলাদের ক্ষেত্রে কোন পিরিয়ডস নাও দেখা যেতে পারে, অন্যদিকে অন্যদের ক্ষেত্রে ভারী এবং অস্বাভাবিক রক্তপাত সহ্য করতে হতে পারে।
আবার কিছুকিছু ক্ষেত্রে পিরিয়ড নিয়মিত হলেও তা স্বাভাবিকের থেকে বেশি দিন ধরে হওয়া।
পেটে প্রচন্ড ব্যথা, শরীরে লোম বৃদ্ধি; বিশেষ করে মুখে, বুকে, পিঠে, পশ্চাতদেশে।
মাথার চুল পাতলা হয়ে যাওয়া, মুখে অত্যাধিক ব্রণ হওয়া, ওজন বৃদ্ধি পাওয়া এবং তা হ্রাস না হওয়া, মুড সুইংস, ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা, এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো সন্তানধারণের অক্ষমতা বা বন্ধ্যাত্ব।

পিসিওডির নিরাময় বা চিকিৎসা :-

পিসিওডি শুরুর দিকেই ধরা পড়লে তা নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে। দীর্ঘকালীন সময় ধরে এই রোগকে অবহেলা করে, শরীরে বাসা বাঁধতে দিলে আপনারই বিপদ বাড়বে। তাই পিসিওডির উপসর্গগুলো বুঝতে পারলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন এবং নিরাময়ের আলোয় আলোকিত হন। পিসিওডির চিকিৎসাগুলি হলো -

১. সঠিক খাদ্য আহরণ :

বেশী চিনি যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। মনে রাখবেন যে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে নরম পানীয়, কুকিজ, কেক, চকলেট, মিষ্টি।
বেশি বেশি সব্জি খান।
বীজযুক্ত ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল, সাদা রুটি, এবং পাস্তা বর্জন করুন এবং কম পরিমাণে পুরোপুরি শস্য ভিত্তিক বিকল্প খাদ্য চয়ন করুন।
ফাইবার রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণের এবং সুস্থ আন্ত্রিক ক্রিয়ার সহায়ক।  প্রতিদিন ২৫-৩০ গ্রাম ফাইবার (আঁশ যুক্ত খাবার) খেতে হবে।
প্রোটিন আপনার রক্তে শর্করার সামঞ্জস্য রাখতে সহায়তা করে এবং মিষ্টান্ন প্রীতি বশে আনতে সাহায্য করে। আপনার খাদ্যতে তাজা মাছ, পাতলা লাল মাংস, জৈব মুরগি, জৈবিক ডিম, গোটা শস্য এবং লেজুস অন্তর্ভুক্ত করুন, যা প্রোটিনের ভাল উৎস।
খাবারে কোন ধরণের চর্বি খাচ্ছেন, তা কোষ পর্যায়ে ইনসুলিন পেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঠান্ডা জলের মাছ, জৈবিক ডিম, আভোকাডো, বিশুদ্ধ অলিভ তেল, এবং অপরিহার্য ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ কাঁচা বাদাম ও বীজ খেতে পারেন।
নিয়মিত খেতে এবং খাবারের মধ্যে আপনার রক্তের শর্করার মাত্রা বজায় রাখার জন্য সকালে এবং বিকেলে স্বাস্থ্যকর খাবার নিশ্চিত করুন।
এছাড়াও আপনি ফল, বাদাম, বীজ এবং প্রাকৃতিক দই সহ সব সুস্থ খাবার খান।

২. শারীরিক ফিটনেস :-

আপনাকে সব সময় ফিট থাকতে হবে এবং নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। হাঁটা একটি আদর্শ ব্যায়াম যেটা আপনি করতে পারেন। ওজন কমানো আপনার স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী যদি আপনার পিসিওডি থাকে। এমনকি একটু কম মাত্রায় ওজন কমানো আপনার হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করতে এবং মাসিক চক্র নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করতে পারে।

৩. ধূমপান :-
পিসিওডি থাকলে ধূমপান বর্জন করতে হবে। ধূমপান করলে শরীরে এন্ড্রোজেনের মাত্রা বৃদ্ধি পায় যা পিসিওডির ক্ষেত্রে একদমই কাম্য নয়।

৪. ঔষধের সেবন (চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী) :-

ডায়াবিটিস এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ-এর ঔষধের সেবন পিসিওডির ক্ষেত্রে নিরাময়ের উপায় হয়ে দাঁড়ায়। আপনি আপনার গাইনোকোলোজিস্টকেও জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে আপনি জন্মনিয়ন্ত্রণের ট্যাবলেট খেতে পারেন কি না? এবং যদি পারেন, তবে কোনটি উপযুক্ত? যে মহিলারা গর্ভবতী হতে চান না, তাদের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলগুলি অত্যন্ত সহায়ক। জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিলগুলি নিম্নলিখিত কাজ করে:

ঋতুচক্র নিয়ন্ত্রণ করে।
শরীরে পুরুষ হরমোনের মাত্রা কমায়।
ব্রণ পরিষ্কারে সাহায্য করে।

অন্যদিকে ডায়াবিটিসের ঔষধ শরীরে অস্বাভাবিক চুলের বৃদ্ধি হ্রাস করে, এবং নারী শরীরে ডিম্বাণুর স্ফোটন স্বাভাবিক করে। তবে উপরিউক্ত ঔষধ অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে তারপরেই ব্যবহার করা উচিত। নাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

পিসিওডি মহিলাদের মধ্যে দিনে দিনে একটি মারাত্মক সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে। সুস্থ্য জীবনযাপনের মাধ্যমে যার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহিলারা বুঝতেই পারেন না তারা পিসিওডির শিকার। ফলত তারা শুরুর দিকেই চিকিৎসার আলো পান না। যখন পান, তখন অনেকটা দেরি হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে এই আর্টিকেল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, মহিলাদের জন্য এবং প্রতিটা পুরুষ মানুষের জন্যেও। পুরুষদের জন্য বললাম কারণ, পুরুষদের মা-বোন-দিদি-বান্ধবী-প্রেমিকা প্রত্যেককেই মাসিক চক্র পার করতেই হয়। সেক্ষেত্রে পুরুষরাও যদি একটু সজাগ থাকেন নিজের ভালোবাসার মানুষদের প্রতি, মহিলাদের রোগ ভেবে যদি অবহেলা না করেন, যদি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের পাশে থাকেন তবে এই রোগের নিরাময় আরও সহজ হবে।

তথ্যসূত্র :

More Articles