বোমায়, গুলিতে ক্ষতবিক্ষত শরীর, যেভাবে প্রতারিত হয়ে রাশিয়ার যুদ্ধে অসংখ্য ভারতীয় যুবক

Indians enlisted with Russian Army: যাঁরা ফিরেছেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশেরই শরীরে যুদ্ধের ক্ষত। ড্রোন হামলা, বোমা-গুলিতে উড়ে গিয়েছে হাত, পা, আঙুল। শরীর ক্ষতবিক্ষত।

প্রায় বছর তিনেক ধরে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ জিইয়ে রেখেছে রাশিয়া। কখনও আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়েছে, কখনও পাল্টা দান ফিরিয়ে দিয়েছে ইউক্রেন। তবু হার মানেনি ভলোদিমির জেলেনেস্কির বাহিনী। আর এই যুদ্ধের ফাঁদে কার্যত নিঃশেষিত হয়েছে রুশ সেনা। তবে হার মানেনি তারাও। বিভিন্ন দেশ থেকে নাগরিকদের নিয়ে এসে যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছে তারা। আর এই কাজে তাঁদের মধ্যস্থতাকারী হয়ে উঠেছে বিভিন্ন অসৎ ট্রাভেল এজেন্টসরা। যারা বিদেশে মোটা টাকার চাকরির অফার দিয়ে এ দেশ থেকে অসংখ্য বেকার যুবকদের ঠেলে দিয়েছে রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করতে, মরতে। সম্প্রতি রাশিয়ার যুদ্ধের ময়দান থেকে দেশে ফিরেছেন এমনই কয়েক জন ভারতীয়। যাঁদের জোর করে নিয়োগ করা হয়েছিল রুশ বাহিনীতে।

যুদ্ধে কারওর চোয়াল উড়ে গিয়েছে, কারওর ড্রোন হামলায় হাত-পা ক্ষতবিক্ষত। তাঁদের কাছে সে যেন এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। চোখের সামনে সহযোদ্ধার রক্তাক্ত দেখে দেখে কার্যত শারীরিক, মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন যুদ্ধে অদক্ষ এই সব যুবকেরা। দেখা গিয়েছে, এই সব যুবকদের বেশিরভাগই ফাঁদে পড়েছে কোনও না কোনও ট্রাভেল এজেন্টদের। যারা কৌশলে ভালো বেতনের চাকরির লোভ দেখিয়ে ওই সব যুবকদের বিদেশে পাচার করেছে। এমনকী বেতন পরিবারের কাছে পৌঁছে দেবে বলে নকল ডেবিট কার্ড পর্যন্ত তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু আসলে তেমন কোনও কিছুই ঘটেনি পঞ্জাব বা উত্তরপ্রদেশে বসবাসকারী ওই সব যুবকদের জীবনে। বরং তাঁরা গিয়ে পড়েছেন সোজা রুশ মিলিটারি ক্যাম্পে। যেখানকার না ভাষা তাঁরা বুঝেছেন, না যুদ্ধের শিক্ষা পেয়েছেন ভালো মতো। কার্যত কিছু না জেনেই গিয়ে পড়েছেন যুদ্ধের ময়দানে। কখনও বোমার শার্পনেল এসে ক্ষতবিক্ষত করেছে শরীর, কখনও নিথর শরীর পড়ে থেকে পরদেশে যুদ্ধের মাঠে। পরিবারের হাতে একটি সিকি-পয়সাও পৌঁছে দেয়নি সেই ট্রাভেল এজেন্টরা।

আরও পড়ুন: সেনা নিয়োগের ফাঁদ! গরিব ভারতীয়দের যেভাবে যুদ্ধের বলি করছে রাশিয়া

ভুক্তভোগীরা জানাচ্ছেন, কারওর কারওর ট্র্যাভেল এজেন্টরা তাঁদের বুঝিয়ে দুটো ডেবিট কার্ড বানাতে বাধ্য করেছিল একই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের। বলা হয়, ওই ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে পরিবারের হাতে টাকা পৌঁছে দেবে তারা। একই অ্যাকাউন্টের একটি এটিএম কার্ড তো তাঁদের কাছে রয়েছে, কিন্তু অন্যটি রয়েছে ট্রাভেল এজেন্টদের কাছে। সেই সুযোগটা নিয়ে যেটুকু অর্থ তারা যুদ্ধক্ষেত্রে উপার্জন করেছে, সেটুকুও নিয়ে ভেগে গিয়েছে এই সব প্রতারকেরা। খালি হাতে খালি পেটে যুদ্ধের ট্রমা আর শারীরিক চোট নিয়ে দেশে ফিরে আসতে পেরেছেন কয়েক জন মাত্র। বাকিরা বলি হয়েছেন অন্য দুই দেশের যুদ্ধের। যাদের যুদ্ধের কারণ, লাভ-ক্ষতি কোনও কিছু সম্পর্কেই সম্যক ধারণা নেই এই গরিব, অসহায় যুবকদের।

সম্প্রতি রাশিয়া সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে এই সব ভারতীয়দের বিষয়ে কথা বলেছিলেন মোদি, জানিয়েছিলেন, কীভাবে প্রতারণা করে তাঁদের রাশিয়ায় নিয়ে গিয়ে যুদ্ধের কাজে লাগানো হয়েছে তাঁদের। তা শুনে বন্ধুদেশকে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন পুতিন তাঁদের ফেরানোর। সম্প্রতি রাশিয়া থেকে মধ্যরাত্রে দিল্লিতে পৌঁছন এমনই ৪৫ ভারতীয়। খুব শিগগিরই এমনই প্রতারিতদের আরও একটি ব্যাচ ভারতে ফিরতে চলেছে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রক জানাচ্ছে, রুশ সেনাবাহিনীতে এখনও আটকে রয়েছেন অন্তত ৫৫ জন ভারতীয়। তাঁদের মধ্যে ৬ জন পঞ্জাবের বাসিন্দা রয়েছেন। রয়েছেন হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দাও। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানান, এখনও পর্যন্ত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে পড়ে বলি হয়েছে আট ভারতীয় যুবক। যাঁদের প্রত্যেকেই ট্র্যাভেল এজেন্ট দ্বারা প্রতারিত হয়ে বাধ্য হয়েছেন রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে। তারা অবশ্য প্রাথমিক ভাবে জানায়, সরাসরি যুদ্ধে নয়, বরং রুশ সেনাবাহিনীর সাপোর্ট স্টাফ বা সহায়ককর্মী হিসেবেই পাঠানো হয়েছিল ওই সব যুবকদের। কিন্তু রাশিয়া পৌঁছনোর পর বাস্তবে তাঁদেরকে দুটি পথের কথা হয়। হয় রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করো, বাহিনীতে যোগ দাও। নাহলে দশ বছরের জেলের সাজা ভোগো। বাধ্য হয়েই যুদ্ধে গিয়েছেন তাঁরা। রাশিয়ার রস্তভ-অন-ডন এলাকায় মাত্র ১৫ দিনের জন্য প্রশিক্ষণে পাঠানো হত তাঁদের। তার পরে সোজা পাঠিয়ে দেওয়া হত রুশ ওয়্যার-জোনে।

আর সেই ওয়্যার জোন আসলে সাক্ষাৎ মৃত্যুক্ষেত্র। হরিয়ানার বাসিন্দা রজত গুপ্তা পঞ্জাবের আরও ৫ যুবকের সঙ্গে গিয়েছিলেন রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধে। জানালেন, রুশ ওয়্যার জোনে সারাদিন রাত বোমা আর ড্রোনের বৃষ্টি হতে থাকে। তাঁদের থেকে মোবাইল পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। যাতে কেউ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারেন। গত এপ্রি মাসে রুশ সেনায় যোগ দেন রজত। তাঁর ট্রাভেল এজেন্ট বা দোভাষি যিনি ছিলেন, তাঁরা একবারের জন্যও বলেনি রুশ সেনার ভয়াবহ চুক্তির কথা। তাঁরা কেউ বুঝতেই পারেননি, ওসব সাপোর্টিং স্টাফের গল্প আসলে নেহাত মিথ্যে কথা। তাঁদের নিয়োগ করা হচ্ছেই যুদ্ধেক্ষেত্রে মরবার জন্য। এক্ষেত্রে ভাষাটাও একটা বড় চ্য়ালেঞ্জ ছিল এই সব ভারতীয়দের জন্য। বহু সময়েই গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্য নিয়ে কথা বোঝার চেষ্টা করতেন তাঁরা। ইংরেজি ভাষাও অথর্ব সেখানে। রুশ বাহিনীর মধ্যে অধিকাংশই কথা বলেন একমাত্র রুশ ভাষায়। কোনও মতো আকার ইঙ্গিত বুঝে কাজ চলত। বেশির ভাগ ভারতীয় যুবক যাঁরা এই সব ট্র্যাভেল এজেন্টদের ফাঁদে পড়েছে, তাঁদের বয়স ১৮-২২-এর মধ্যে। এই বয়সে ওই সব ভয়ঙ্কর যুদ্ধের অভিজ্ঞতা দেশে ফিরেও দুঃস্বপ্নের মতো লাগে তাঁদের কাছে।

যাঁরা ফিরেছেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশেরই শরীরে যুদ্ধের ক্ষত। ড্রোন হামলা, বোমা-গুলিতে উড়ে গিয়েছে হাত, পা, আঙুল। শরীর ক্ষতবিক্ষত। তাঁদের প্রাথমিক কাজ ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে একদম সামনে থেকে গুলি চালানো, কাছাকাছি জলের উৎস থেকে জল ভরা বালতিতে, বাকি সৈনিকদের রেশনের জোগার, হাতে হাতে অস্ত্র জুগিয়ে যাওয়া। কখনও কখনও আবার নিরাপত্তা কর্মী হিসেবেও বহাল করা হত তাঁদের অস্ত্রভাণ্ডারের। এমনকী রুশ সেনার আধিকারিকদেক জন্য তাঁবু খাটিয়ে দেওয়ার ছিল, তাঁদের কাজের অঙ্গ। বহু ক্ষেত্রেই বহু ভারতীয়কে রুশ সেনাবাহিনীর হাতে মার খেতে হয়েছে বলেও অভিযোগ। যদিও রজতের সঙ্গে কখনও তেমন কিছু হয়নি। বরং রুশ বাহিনী তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীলই ছিল। কিন্তু তাঁদেরও করার মতো কিছুই ছিল না। অচিরেই রজতেরা বুঝতে পারেন, পালিয়ে লাভ হবে না। ওই যুদ্ধক্ষেত্রে পালাতে গেলেও মৃত্যু যে বাঁধা।

দ্বাদশ শ্রেণী পাশ করতে না করতেই চাকরির আশায় হন্যে ২৩ বছরের যুবক পড়ে যান ট্রাভেল এজেন্টদের প্রতারণার ফাঁদে। ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার নাম করে তাঁকে রাশিয়ায় নিয়ে গিয়ে তোলে সেই প্রতারকেরা। শেষপর্যন্ত মুখভর্তি ক্ষত নিয়ে ঘরে ফিরেছে পঞ্জাবের হোশিয়ারপুরের সেই যুবক। রাশিয়া যাওয়ার আগে স্থানীয় একটি কারখানায় কাজ করত ছেলেটি। সেখানে ৮-৯ হাজার টাকা আয়ও করত সে। তবু উপরি আয়ের স্বপ্ন শেষ করে দিল সব। অমৃতসরের বাসিন্দা বছর উনিশের শামসের সিংয়ের গল্পটাও কিছু আলাদা নয়। রুশ ভিসা যখন হাতে পেলেন তিনি, তখনও তিনি জানতেন আজারবাইজান বা দুবাই যাচ্ছেন। কিন্তু পৌঁছলেন শেষপর্যন্ত রাশিয়ায়। ভেবেছিলেন, বিদেশের মাটিতে গিয়ে খেটে পরিবারের দারিদ্র খানিকটা দূর করবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভাঙতে সময় লাগেনি বেশি। রজত, সামশেরদের মতোই পরিস্থিতি উত্তরপ্রদেশের ব্রিজেশের। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দু'টো পা নিয়ে প্রায় এক মাস হাসপাতালে কাটিয়ে অবশেষে দেশে ফিরেছে সে।

আরও পড়ুন:ইউক্রেনে ভয়াবহ রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার! রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে ভয়ঙ্কর অভিযোগ তুলল আমেরিকা

তাঁদের রোজগার করা অর্থটুকু হাতছাড়া হয়েছে, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শেষপর্যন্ত গিয়েছে শারীরিক সক্ষমতা এবং মনের জোর। এত এত রক্ত, এত কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখা গোটা জীবনটাকেই যেন ছাড়খার করে দিয়েছে তাঁর। ইতিমধ্যেই ওই সব প্রতারক ট্র্যাভেল এজেন্টদের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছে সিবিআই। কিন্তু নিজেদের খেটে রোজগার করা অর্থটুকু ফিরে পেতে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা। রজত জানান, তাঁর অ্যাকাউন্টে প্রায় ৬.৯৫ লক্ষ টাকা ঢুকেছিল। তার মধ্যে মাত্র ২ লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন তিনি। বাকিটা নিয়ে চম্পট দেয় প্রতারক ট্র্য়াভেল এজেন্টরা। এদিকে, অ্যাকাউন্টে বেতন ঢুকেছে জানার পর থেকেই বুলেট প্রুফ জ্যাকেট থেকে শুরু করে ডিজেল, থাকা-খাওয়া বাবদ টাকা কাটতে শুরু রুশ বাহিনী। ইতিমধ্যেই পুলিশকে ওই সব ট্র্যাভেল এজেন্টদের পরিচয় নামধাম জমা দিয়েছেন দেশে ফেরা এই সব যুবকেরা। সেই সব তথ্য় নিয়েই নতুন করে তদন্তে নেমেছে সিবিআই।

এখনও যাঁদের ফেরা হয়নি দেশে, এখনও রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে রোজ রোজ মরে যাচ্ছেন, ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের যত দ্রুত সম্ভব ফেরানোর চেষ্টা করছে সরকার। আশায় বুক বাঁধছেন তাঁরাও। নিজের দেশে নিজের ঘরে ফেরার ওই মৃত্য়ুর উপত্যকা থেকে।

More Articles