বিরাট আসলে ব্র্যান্ড! সচিন ভারতের রত্ন, সেরার সেরা চিরকাল লিটল মাস্টারই

Inscript Debate: আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সচিনকে বহুবার ক্রিজ ছেড়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু এখন প্রযুক্তি অনেকটাই উন্নত তাই ভুল আউট হওয়ার উপায় নেই।

সচিন… সচিন… সচিন… সচিন… মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে উপস্থিত এমন কোনও মানুষ ছিলেন না যাঁর গলা দিয়ে এই নাম উচ্চারিত হয়নি। ২২ গজকে নিজের জীবনের সব থেকে মূল্যবান পথ ভেবে নেওয়া এক ভগবানের চোখে তখন জল। নিজের জীবনের সব থেকে প্রিয় জায়গায় হাত রেখে একবার সূর্যপ্রণাম করলেন, ঠিক যেমনটা করে এসেছেন ১০০ বার, নিজের ১০০ টা আন্তর্জাতিক শতরানের প্রতিটাতে। ঘটনাটি ২০১৩ সালের ১৪ নভেম্বরের। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান স্পিনার ডিওনারিনের বলে স্লিপে ডেরেন সামির হাতে ক্যাচ। আর এই ছিল ক্রিকেটের ভগবানের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। মাঠে উপস্থিত সবাই যথারীতি তাঁদের আইডলকে বিদায় জানালেন। ভগবান মাঠ ছাড়লেন। আর মাঠে এলেন ভগবানেরই আরেক রূপ। বছর গড়াতে থাকল নিজের তালে আর স্টেডিয়ামে সচিন… সচিন… ডাকটা কালক্রমে বদলে হতে থাকল কোহলি… কোহলি…।

২০২২। সম্প্রতি টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যখন টিম ইন্ডিয়ার মোটামুটি সব ব্যাটসম্যানই যাকে হিন্দিতে বলে ‘হাতিয়ার ডাল দিয়া’, ঠিক সেই মুহূর্তে কোনও এক পুরনো ঈশ্বরেরই অবতার যেন ভারতকে হারের মুখ থেকে একা টেনে নিয়ে এলেন, স্টেডিয়াম জুড়ে তখন বিরাট ধ্বনি। সবার সমালোচনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বিরাট কোহলি আবার ছন্দে। সবাই ভেবেছিলেন, সচিন তো সচিন, বিরাট সেদিনের শিশু। কিন্তু কোহলি আবারও সচিন-বিরাট তুলনার আগুন উস্কে দিতে থাকলেন অনুগামীদের মনে।

সময় পাল্টেছে কিন্তু ভারতের নির্ভরশীলতা পাল্টায়নি। গাভাস্কার নির্ভর ভারত থেকে সচিন নির্ভর হয়ে এখন বিরাট কোহলি নির্ভর ভারত। তার সঙ্গে পাল্টায়নি চর্চাও। গাভাস্কার সেরা না কি সচিন থেকে এখন কোহলি না কি সচিন, কে সর্বকালের সেরা? যদি প্রসঙ্গ বিরাট আর সচিনের হয় তাহলে নিজের মাথাকে একটু কষ্ট দিয়ে পিছনে ফিরে দেখা দরকার।

সাল ১৯৮৯ কৃষ্ণামাচারি শ্রীকান্ত তখন অধিনায়ক, ভারত পাকিস্তানের টেস্ট ম্যাচ এক ‘বাচ্চা ছেলের আগমন অনেকটা বলিউডের সিনেমা ‘Chain Kulii Ki Main Kulii’ এর মতো সবার মনে প্রশ্ন তুলেছে, “ইয়ে বাচ্চা ক্যায়া খেলেগা”? পাকিস্তানের বোলারদের গতি তখন ভয়ানক। ওয়াসিম আক্রামের আক্রমণ, ইমরান খানের খান খান করে দেওয়া সুইং, ওয়াকার ইউনিসের ‘ইউ মিস, আই হিট’ বোলিং- এদের মধ্যে ব্যাট করা মানে একপ্রকার আগুনের উপর খালি পায়ে হাঁটা। সচিন হয়তো তখন খুব বেশি রান করতে পারেননি। কিন্তু তাঁর সাহসিকতা এই সমস্ত মহান বোলারদের মনে একটু হলেও সন্দেহের দানা বাঁধাতে সাহায্য করেছিল যে, এই ছেলে বড় হলে একটা কিছু করবেই।

চার নম্বর টেস্ট ম্যাচ। আবার সেই ‘বাচ্চা ছেলে’ আর তাঁর সামনে ওয়াকার ইউনিসের গতি। একটা সাংঘাতিক বাউন্সার সোজা গিয়ে লাগল সচিনের নাকে, সঙ্গে সঙ্গে গলগলিয়ে রক্তপাত! সবার মনেই উদ্বেগ, এবার কী হবে এই বাচ্চা ছেলের! খেলতে কি পারবে আর? সচিন একটা কথা বলেছিলেন, “ম্যায় খেলেগা”। এর পর যেটা হয়েছিল তা সকলের জানা। ১৯৮৯ থেকে ২০১৩ এই সময়ে ভারত মানে সচিন, সচিন মানেই ভারত। সচিন আউট মানে টিভি বন্ধ। তাঁর রেকর্ডের ইতিহাস সবার জানা। কিন্তু সচিন নামটা কেমন যেন কেজিএফের রকি ভাইয়ের মতো, শুনলেই বিপক্ষের বুকের ধুকপুকানি একটু হলেও বৃদ্ধি পায়, এখনও।

এবার আসি বর্তমানে ভারতীয় পুরুষ দলের সব থেকে মূল্যবান খেলোয়াড়ের বিষয়ে। বিরাট কোহলির নাম খুব তাড়াতাড়িই সকলের মুখে ছড়িয়ে পড়তে থেকেছে। সচিন বিহীন ভারতকে বিরাট যেন আরেকটা বৃহৎ বটবৃক্ষের ছায়া দিতে থেকেছেন নিজের প্রতিভা দিয়ে। সচিনের অনুপস্থিতি একটু হলেও বুঝতে দেননি বিরাট। অনেক বড় কথা হলেও এটাই সত্য যে সচিনের পর কালক্রমে বিরাটই হয়েছেন সকলের নয়নের মণি।

তর্কের খাতিরে হয়তো যুক্তি চলে আসেই কিন্তু সচিন আর বিরাট কে বেশি ভালো ব্যাটসম্যান বলা খুব মুশকিলই। তবু, কিছু বিষয় থেকে তা স্পষ্ট হয়েই যায়।

এক, সচিন যে সময় খেলতে নামেন তখনকার থেকে এখন খেলা অনেক বেশি গ্ল্যামারাস। এখন অনেক বেশিই প্র্যাকটিসের সুযোগ। ব্যাট থেকে শুরু করে অন্যান্য ক্রিকেট কিটের অনেক অনেক মডিফিকেশন হয়েছে, ক্রিজে দাঁড়িয়ে রান করাও অনেক সুবিধার হয়ে গেছে।

দুই, এখন প্রায় সারা বছরই ক্রিকেট হয়, রেকর্ড করার এখন অনেক সুযোগ।

তিন, এখনকার প্রতিপক্ষ দলের বোলিং আর সচিনের সময়ের বোলিংয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। ফাঁকা হেলমেট আর কমজোরি প্যাড পরা ব্যাটসম্যানদের সবার আগে চিন্তা থাকত ওই গতিশীল শক্ত বলের হাত থেকে নিজের প্রাণ বাঁচানোর। এখন সেই বোলিংয়ের ধার আমি অন্তত দেখতে পাই না। আর তার সঙ্গে উন্নত প্যাড হেলমেট হওয়ার দরুণ সেই ভয়ও অতটা কাজ করে না ব্যাটসম্যানদের।

চার, এখন চিকিৎসাও অনেক উন্নত তাই একজন খেলোয়াড় খুব সহজেই কম দিনে চোট-সঘাত সামলে ফিরে আসতে পারেন। সচিনের জীবনের অনেকটা সময়ই ওঁর চোটের কারণে নষ্ট হয়েছে। বিরাট কোহলিকে সেই সমস্যায় খুব একটা পড়তে হয়নি।

পাঁচ, এখন ব্যাটসম্যান ছাড়াও একজন খেলোয়াড় নিজেকে ভালো অ্যাথলিট হিসাবেও তৈরি করতে চান। কিন্তু সচিনের সময় এই বিষয়টা ছিল না। তাই সচিন বিরাটের তুলনা এলে সবার আগে এটাই মনে হয় বিরাট সচিনের থেকে অনেক বড় মাপের অ্যাথলিট।

ছয়, সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্ত। যে কারণে সচিনকে বহুবার ক্রিজ ছেড়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু এখন প্রযুক্তি অনেকটাই উন্নত তাই ভুল আউট হওয়ার উপায় নেই।

সাত, সচিনের কাছে সব কিছুর আগে ছিল ক্রিকেট। নিজের পরিবারের আগেও। সচিন সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে গিয়ে একজন খেলোয়াড়। তুলনায়, বিরাট কোহলি আমাদের কাছে একজন ফ্যামিলি ম্যান, এক গ্ল্যামারাস মুখ।

সব শেষে বলার, সচিন তেন্ডুলকার ভারতের রত্ন। যত দিন ক্রিকেট থাকবে সচিন থাকবেন। বিরাট কোহলি এক ব্র্যান্ড। এখনই নয়, হয়তো আর কয়েক বছর পর ১০০ সেঞ্চুরির মাইলস্টোনে এই কভার ড্রাইভের রাজার নামও থাকবে।

More Articles