আমার গ্রামবাংলার গল্প পড়ে বিদেশি পাঠকরা মুগ্ধ: অমর মিত্র
বাংলা সাহিত্যে আন্তর্জাতিক পুরস্কারের তকমা যে খুব একটা নেই, তা আলাদা করে বলার অপেক্ষা করে না। রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তি ছেড়ে দিলে সুদূর অতীত খুঁড়লে ততটা উল্লেখযোগ্য সম্মান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ১৯১৩ থেকে ২০২২- একশো বছর পার করা এক বিস্তীর্ণ সময়। অথচ, বাংলা সাহিত্যের জার্নি অব্যাহত।
এমন একটা সময়ে শ্রদ্ধেয় লেখক অমর মিত্রকে মার্কিন মুলুকের স্বনামধন্য গল্পলেখক ও'হেনরির নামাঙ্কিত পুরস্কারে সম্মানিত করা হল। ও'হেনরি পুরস্কার শতবর্ষ পেরনো আন্তর্জাতিক পুরস্কার। আমেরিকার বিখ্যাত ছোটগল্পকার ও'হেনরি বাঙালি পাঠকের কাছে সম্যক পরিচিত। ইতিপূর্বে কোনও বাঙালি বা কোনও ভারতীয় লেখক এই পুরস্কার পায়নি। এই পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায় বিখ্যাত লেখকরা রয়েছেন। উইলিয়াম ফকনার, সল বেলো, অ্যালিস মুনরো, উইলিয়াম ট্রেভর প্রমুখ। তিন-চার বছর ধরে অন্য ভাষার সাহিত্যের অনুবাদের ক্ষেত্রেও এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।
এই সম্মান শুধু লেখকের নয়। তাবৎ বাংলা সাহিত্য, এমনকী, ভারতীয় সাহিত্যানুরাগী সকলের। বাঙালির গর্বের সম্মান। বাংলা সাহিত্যে দীর্ঘ কয়েক দশক আলো করে আছেন শ্রদ্ধেয় অমর মিত্র। গল্প-উপন্যাসের খবর যাঁরা নিয়মিত রাখেন, তাঁরা জানেন তাঁর লেখনীর ব্যাপ্তি। সাহিত্য অকাদেমি পাওয়া লেখক কখনও নিজেকে থেমে থাকতে দেননি। পঁয়তাল্লিশ বছর আগে লেখা গল্প 'গাঁওবুড়ো' যে এখনও কতটা প্রাসঙ্গিক, তা এই পুরস্কারে স্বীকৃত হল।
বাংলা সাহিত্যের এই মাহেন্দ্রক্ষণে লেখকের মুখোমুখি হয়েছিলেন আর এক গল্পকার-ঔপন্যাসিক প্রবুদ্ধ মিত্র।
প্রবুদ্ধ মিত্র: অমরদা, প্রথমেই আপনাকে এই ও'হেনরি পুরস্কারের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন। বাংলা ছোটগল্পের জগতে প্রথমবার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এল আপনার গল্পের হাত ধরে। খবরটা যখন প্রথম পেলেন, তখন আপনার অনুভূতি কেমন হয়েছিল ?
অমর মিত্র: ১৯৭৭-এ লেখা গল্প ২০২২-এ আরও প্রাসঙ্গিক। একটি গল্প এত বছর ধরে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করছে। এবং সেই পাঠক বিদেশের। ও’হেনরি প্রাইজ কমিটির এডিটররা একজন মেক্সিকান, বাকি দু'জনের একজন হয়তো আমেরিকান, অন্যজন আশপাশের কোনও দেশের। বহু দূরের মানুষ তাঁরা। এবং এদেশ সম্পর্কে কতটা জানেন, তা আমি জানি না। তাঁরা এই গল্প পড়ে আমাকে মেল করেছেন। একটিই শব্দ বারবার উচ্চারণ করেছেন, 'ওয়ান্ডারফুল, ওয়ান্ডারফুল!' আমি বুঝতে পারছি, এই গল্প দেশ-কালের ঊর্ধ্বে, বিশ্বমানবের। আবার আমার গ্রামবাংলার তো নিশ্চয়ই। আমি নিজের লেখা নিয়ে আরও প্রত্যয়ী হলাম। ভাল লেগেছে খুব। কিন্তু মনে মনে একটা সাহস ছিল ভাবার যে, আমি মহৎ লেখকদের পাশে দাঁড়ানোর অনুপযুক্ত নই। তা যেমন গল্পে, তেমনই উপন্যাসেও।
প্রবুদ্ধ মিত্র: এই যে গল্পটি- 'গাঁওবুড়ো', এটা রচিত হয়েছিল আপনার কথা অনুযায়ী ১৯৭৭ সালে। প্রথম যখন 'অমৃত' পত্রিকা আপনার গল্পটি গ্রহণ করে শারদীয় সংখ্যার জন্য এবং তা ছাপা হয় না, যে কোনও কারণেই হোক- তখন একজন লেখক হিসেবে এই প্রত্যাখ্যানকে কি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন? যদিও পরবর্তীতে শ্রদ্ধেয় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় আপনার গল্পটি পড়ে অভিভূত হয়েছিলেন, আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে উনি ওঁর বই দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন এবং 'অমৃত'-তেই অন্য সংখ্যায় তা ছাপা হয়েছিল। একই গল্পের ওপর এই দুই অভিজ্ঞতা কীভাবে আপনার লেখকজীবনকে প্রভাবিত করেছিল ?
অমর মিত্র: পায়ের তলার মাটি শক্ত হয়েছিল। আমি লিখতে পারব, তা বুঝেছিলাম।
প্রবুদ্ধ মিত্র: আপনাকে জীবনের বিভিন্ন সময়ে বারবার প্রত্যাখ্যান, উপেক্ষা বা অপমানের স্বীকার হতে হয়েছিল। এই গল্পের চলচ্চিত্রায়ণ নিয়েও হয়েছে বঞ্চনা। আজ এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিকে সেইসব বঞ্চনা বা অপমানের যোগ্য জবাব বলে আপনার অগুনতি অনুরাগী মনে করছেন। এ-ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
অমর মিত্র: এখন আর কিছুই মনে হয় না। ভুলে যাচ্ছি। ভুলে গেছি। জীবনের অংশ এসব। আমি জবাব দিতে লিখিনি। যা-ই হয়েছে, সবই আমার অভিজ্ঞতার অন্তর্গত। জীবন এমন হয়। সবকিছু মনে রাখতে নেই। জীবন আমাকে লিখতে দিয়েছে, এটাই বড় পাওয়া।
প্রবুদ্ধ মিত্র: ও'হেনরির নামাঙ্কিত পুরস্কারপ্রাপ্তি লেখকজীবনে বিরাট গর্বের। কিংবদন্তিদের পাশে আপনার নামটি জুড়ে গেল। অথচ, প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদমাধ্যমে যেন একটু দ্বিধা, স্বীকৃতি দিতে যেন কিছুটা বিলম্ব। অথচ, সোশ্যাল মিডিয়া উজাড় করে দিয়েছে এই খবর এবং তজ্জনিত উচ্ছাসে। কী বলবেন?
অমর মিত্র: কেউ কেউ তো সংবাদ দিয়েছেন। বাংলা পত্রিকা ছোট করে হলেও দিয়েছে। সর্বভারতীয় পত্রিকা 'দ্য হিন্দু' বা 'দ্য টেলিগ্রাফ' দিয়েছে। 'ইন্ডিয়া টুডে' করছে। একটি বড় চ্যানেল করবে। সময় যায়নি। তবে একথা ঠিক, বড় প্রতিষ্ঠানের কেউ হলে বা ক্ষমতাবান হলে অনেক বেশি প্রচারিত হতাম। বড় যোগাযোগ থাকলেও তা হত। আমি ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষ। নিজেকে নিজে গড়েছি। কে কীভাবে নিল, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
প্রবুদ্ধ মিত্র: এবার আসা যাক 'গাঁওবুড়ো' গল্পটির প্রসঙ্গে। এই গল্পের মূল চরিত্র বুড়ো ফকিরচাঁদ তার জীবনসায়াহ্নে হেঁটে চলেছে এক মহান উদ্দেশ্য মাথায় নিয়ে। তার অনেক সমস্যা। যা সমাধানের সন্ধান পেতে সে হেঁটে চলেছে তার নিজের গ্রাম কুসুমপুর থেকে বহু দূরের কোনও এক কন্যাডিহি গ্রামের বড়বাবুর দেখা পেতে। মনে অগাধ বিশ্বাস, বড়বাবু তার নিজের এবং পথে দেখা হওয়া মানুষজনের সমস্যা মিটিয়ে দেবে। এ এক দীর্ঘ যাত্রা। শেষে তার কি ঘটল বা অন্যরা কেন তার অপেক্ষায় রইল- এ হলো গল্পের সারাৎসার। এক অন্তর্নিহিত দর্শন গল্পজুড়ে রয়েছে। এই দর্শনই গল্পটাকে আবহমান করে তুলেছে। কোনও ঘটনাসূত্র কি আছে এর রচনার পেছনে ?
অমর মিত্র: তেমন নেই। আমি তো অনেক হাঁটতাম। অনেক অনেক পথ। ক্যাম্প অফিসে যেতে আট-দশ মাইল হাঁটতে হত। বিস্ময়ে বিভোর হয়ে থাকতাম সেই যাত্রাপথের চারদিক দেখে।
গাঁওবুড়ো ফকিরচাঁদের ওই যাত্রাপথ আমারই যাত্রাপথ। আমি যে অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে গিয়েছি, তা থাকে নিজের অন্তরের গহিনে। লেখার সময় তা বেরিয়ে আসে অবচেতনা থেকে। আমি কল্পনা করতে ভালবাসি। কল্পনা, দেখা- সব মিলিয়ে এই গল্প। এই গল্প আমার জীবনের পথে যাত্রা। সাহিত্যের পথে যাত্রা। যে-গন্তব্য ছিল অনিশ্চিত।
প্রবুদ্ধ মিত্র: এই পুরস্কার নিঃসন্দেহে বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে প্রবল আলোড়ন তুলেছে এবং তুলবে। যারা বাংলা ছোটগল্প লিখে চলেছেন, দীর্ঘদিন যাবৎ বা যাঁরা নতুন লিখতে আসছেন, তাঁরা অবশ্যই এই ঘটনায় প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত। অনীশ গুপ্ত কৃত এই গল্পের ইংরেজি তর্জমা 'দ্য ওল্ড ম্যান অফ কুসুমপুর' গত বছর আমেরিকার 'দ্য কমন' পত্রিকায় প্রকাশিত। এখানেও 'হর্নবিল' প্রকাশনা এটিকে আপনার একটি অনূদিত ইংরেজি গল্পগ্রন্থ 'দ্য ওল্ড ম্যান অফ কুসুমপুর ও আদার স্টোরিজ'-এ গ্রন্থায়িত করেছে। বাংলা সাহিত্যে এই ঐতিহাসিক ঘটনার পর আপনার কি মনে হয়, বাংলা ছোটগল্পের আকরে লুকিয়ে আছে সেইসব রত্নখনি, যার নিয়মিত অনুবাদ হলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলা গল্প পুরস্কৃত হবার আরও সম্ভাবনা রয়েছে?
অমর মিত্র: নিশ্চয়ই। বাংলার মাটি ছোটগল্পের জন্ম দেয়।বাংলা সাহিত্যে এত ভাল ভাল গল্প লেখা হয়েছে, তার অনুবাদ না হওয়ায় পশ্চিম বঞ্চিত হয়েছে, এই হিরে-মানিকের সন্ধান না পেয়ে। ভাল গল্পের, উপন্যাসের অনুবাদ হওয়া দরকার।