ছাদ থেকে রোগীর মরণঝাঁপ, কী অবস্থা রাজ্যের মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির? আসল তথ্য জানুন
এতটা সময় ধরে তাঁকে ভুলিয়ে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছে। তাতেও কর্ণপাত করেননি সুজিত। অতঃপর, কার্নিশ থেকে পড়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ওই হাসপাতালেরই আইটিইউ-তে ভর্তি করা হয়। শেষে সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
কে আগে প্রাণ করিবেক দান! অনেকটা এইরকমই প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা দেখল কলকাতা। কে আগে এক আত্মহত্যার লাইভ ফুটেজ করিবেক ক্যাপচার! এইরকমই ছবি-শিকারিদের নিরলস তিতিক্ষার সাক্ষী থাকল এই কলকাতা। আত্মহত্যা করব করব বলে করলেন। ঝাঁপ দেব দেব বলে দিলেন। তখন সেখানে দর্শক কলকাতা। পরিষ্কার করে বললে দমকল, পুলিশ, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। সঙ্গে হাসপাতালের নিজস্ব রক্ষীরা। বাঁচানো গেল না লোকটাকে, যাঁর শনিবারই বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। ২২ দিন আগে মাকে হারিয়েছেন তাঁর দুই সন্তান। আজ তারা বাবাকে হারিয়ে অনাথ হল। তাতে কার কতটা ক্ষতি হল, এ নিয়ে হিসেব করবে না শহর কলকাতা। সুজিত অধিকারীকে কেন বাঁচানো গেল না, এই নিয়ে দমকল, পুলিশ, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী- প্রত্যেকের কাছে যুক্তি আছে, তা সদুত্তর নাইই বা হলো, তাতে কার কী এল গেল। কারণ মোদ্দাকথা হলো, কলকাতার বুকে এই ধরনের ঘটনা নতুন নয়। পাভলভের মতো হাসপাতালেও নারকীয় পরিস্থিতিতে রোগীর দিনযাপনের ঘটনা ঘটেছে। নতুন একটাই বিষয়, এই শহরের বুকে এদিনও সুজিত অধিকারী রেখে গেলেন একরাশ কঠিন প্রশ্ন। ব্যর্থতা বুকে নিয়ে বিদায় নেন সুজিতরা।
মল্লিকবাজারের বেসরকারি হাসপাতালের আটতলার কার্নিশ থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে ওই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন সুজিত অধিকারীর। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে তিনি কার্নিশে বসেছিলেন। হাজির ছিল পুলিশ, দমকল, বিপর্যয় মোকাবিলা কর্মী ও হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষীরা। এতটা সময় ধরে তাঁকে ভুলিয়ে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছে। তাতেও কর্ণপাত করেননি সুজিত। অতঃপর, কার্নিশ থেকে পড়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ওই হাসপাতালেরই আইটিইউ-তে ভর্তি করা হয়। শেষে সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
প্রশ্ন এক, দেড় ঘণ্টা সময়টা এতটাই কম? পুলিশ, দমকল, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী কেউ কেন তাঁকে উদ্ধার করতে পারল না?
আরও পড়ুন: ২০৩০-এ মানুষের কাছে সুখের ধারণাটুকুও থাকবে না? || কথাবার্তায় রত্নাবলী রায়
প্রশ্ন দুই, পুলিশ, দমকল কেন নিচে জাল বিছোনোর চেষ্টা করল না?
প্রশ্ন তিন, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী হাতে সময় পেলেও কেন তাঁর কাছাকাছি গেল না?
প্রশ্ন চার, এইচডিইউয়ের বিছানা থেকে রোগী বেরিয়ে কার্নিশে গেলেন কী করে?
প্রশ্ন পাঁচ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নার্স দেখেন সুজিত জানলা খুলে জোর করে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। নার্স দৌড়ে গিয়ে আটকানোর চেষ্টা করেন। যুক্তি যাইই হোক, হাসপাতালের জানলা রোগী পালানোর উপযোগী?
প্রশ্ন ছয়, ঘটনার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, সুজিত সম্ভবত ‘বেড কি’ (যে লম্বা লোহার দণ্ডের সাহায্যে হাসপাতালের বেডের উচ্চতা বাড়ানো-কমানো হয়) ব্যবহার করে জানলার স্ক্রু কেটে ফেলেছিলেন।
এখানেই প্রশ্ন উঠছে, এক জন রোগী ‘বেড কি’ দিয়ে জানালা খুলে ফেললেন, অথচ কেউ টের পেলেন না! দীর্ঘ সময় ধরে তিনি জানালার স্ক্রু কাটলেন, কিন্তু সবই হলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চোখের আড়ালে!
শেষ প্রশ্ন, কোনও রোগী বিপজ্জনকভাবে কার্নিশের ধারে চলে গেলে, তাঁকে ফেরানোর জন্য সেই রোগীর মর্জির ওপরই নির্ভর করে বসে থাকা ছাড়া কি সত্যিই আর কোনও উপায় নেই?
সম্ভবত এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নেই হাসপাতাল, পুলিশ, দমকল এবং বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কাছে।
পরে প্রেস বিবৃতি দিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, সুজিত অধিকারী, বয়স ৩৩। তাঁর রোগ নির্ণয় করা হয়েছে epileptic fits, অর্থাৎ মৃগী রোগ বলে। তাঁকে শনিবার ছাড়ার কথা ছিল, এটা জানত তাঁর পরিবার। ইনশিওরেন্সের অধীনে তাঁর চিকিৎসা চলে। তাঁকে বাঁচানোর সবরকম চেষ্টা করে পুলিশ, দমকল এবং বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
হাসপাতাল থেকে রোগীর ঝাঁপ দেওয়া বা অন্যভাবে আত্মহত্যার ঘটনা নতুন নয়।
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে আত্মহত্যা
এই বছরের ২৪ মে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগীর আত্মহত্যা। মৃতের নাম নয়ন বাগ (৪৪), বাড়ি হুগলির গোঘাট থানার নৃসিংহবাটিতে।
পেটে যন্ত্রণা নিয়ে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন নয়ন বাগ। ২৪ তারিখ ভোররাতে হঠাৎ তিনি জরুরি বিভাগের দুইতলা থেকে নিরাপত্তারক্ষীদের চোখ এড়িয়ে নীচের তলায় চলে আসেন। সেখানেই গলায় গামছা দিয়ে আত্মহত্যা করেন নয়ন। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে এত নিরাপত্তারক্ষী ও সিসি ক্যামেরা থাকা সত্ত্বেও কীভাবে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটল, প্রশ্ন তোলেন পরিবারের সদস্যরা।
আরজি করে আত্মহত্যা
এই বছরের ঘটনা। আরজি কর হাসপাতালের ৫ তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা রোগীর। বনগাঁর বাসিন্দা পঞ্চানন হালদারের (৬০) সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে যায়। তারপর তিনি বনগাঁ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে আরজি কর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তারপর থেকে তিনি এমারজেন্সি বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলায় ভর্তি ছিলেন।
এছাড়া তাঁর ব্রেন টিউমারও ছিল। ২৫ তারিখ ভোরে পাঁচতলার জানলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। সূত্রের খবর, মানসিক অবসাদে তিনি ভুগছিলেন। যখন তিনি পাঁচ তলা থেকে ঝাঁপ মারেন, নিচে এসি-র মধ্যে আটকে যান। এরপরই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে দমকলে খবর দেওয়া হয়। তাঁকে বাঁচানো যায়নি।
এই বছরের গোড়া থেকে বিভিন্ন হাসপাতালে পরপর রোগীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এছাড়া পাভলভের মতো প্রথম শ্রেণির মানসিক হাসপাতালের বিরুদ্ধে নারকীয় পরিবেশে রোগীকে রাখার অভিযোগ উঠেছে।
কাঠগড়ায় পাভলভ
পাভলভ মানসিক হাসপাতালে গাছে উঠে পড়েন রোগী। দিনটা ১৯ জুন। ওই রোগীকে নামাতে হিমশিম খান হাসপাতালের কর্মীরা। নিরুপায় হয়ে ডাকতে হয় দমকলকে। শেষমেশ আধ ঘণ্টার চেষ্টায় নামানো সম্ভব হয় ওই রোগীকে।
এই ঘটনা পাভলভকে দাঁড় করিয়ে দেয় একরাশ প্রশ্নের সম্মুখে। স্বাস্থ্যকর্মী এবং চিকিৎসকদের নজর এড়িয়ে কীভাবে ওই রোগী গাছে উঠে গেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পাভলভে রোগীদের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে নতুন করে।
অন্ধকার, স্যাঁতস্যাতে, নোংরা ঘরে ১৩ জন মানসিক রোগীকে তালাবন্দি করে রাখার খবর সামনে আসে। সেই ঘরে যত্রতত্র লোহার ধারালো টুকরো পড়ে থাকা এবং রোগীদের শরীরে ক্ষতচিহ্ন মিলেছে বলেও জানা যায়। স্বাস্থ্য দপ্তরের এই রিপোর্টে ফের কাঠগড়ায় ওঠে পাভলভ হাসপাতাল। ইতিমধ্যেই হাসপাতালের সুপারকে শোকজ করেছে স্বাস্থ্য দপ্তর।
জানা গিয়েছে, রোগীদের খাবারের পরিমাণ কম এবং নিম্নমানের। দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকতে হয় রোগীদের, নেই কোনও ডায়েট কমিটি, ডায়েট চার্ট, নেই রোগীর উপযোগী পথ্য। শুধু তাই নয়, বছরে ১ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ হয় আবাসিকদের পোশাকের জন্য, অথচ আবাসিকদের ছেঁড়া পোশাক পরিয়ে রাখা হয় বলে অভিযোগ। সূত্রের খবর, রোগীদের দেওয়া হয় না অন্তর্বাস। হাসপাতালের আউটডোরের অবস্থাও ভয়াবহ। জানলা-দরজা ভাঙা, শৌচাগার ব্যবহারের অযোগ্য। সাধারণ চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধ নেই হাসপাতালে। স্বাস্থ্য দপ্তরের নজরদারি দলের রিপোর্টেও তার উল্লেখ মিলেছে। লিখিত জবাব চেয়ে ৭ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল হাসপাতালের সুপারকে। তিনি যাইই উত্তর দিন, শহরের এই নামী মানসিক হাসপাতাল বারবার অনিয়মের ফাঁদ গলে বেরিয়ে গেছে। আবার যে কে সেই!
সময় গড়িয়ে যায়, বিস্মৃতির অতলে চলে যায় পাভলভ, আরজি কর কিংবা মল্লিকবাজারের বেসরকারি হাসপাতাল। সুজিতরা এই শহরকে ধার দেন, তাঁদের আত্মহত্যার লাইভ এবং ভাইরাল ফুটেজ। তবে একই সঙ্গে তাঁরা ব্যধিগ্রস্ত সিস্টেমের জন্য রেখে যান কয়েক বিন্দু চোখের জল। রাজা বদলায়, দেশ বদলায়। কিন্তু দশক দশক পরেও বদলাবে না এই ঘুণধরা সমাজ? সুজিতদের মৃত্যুর দায় নেবে কে? সমাজ, প্রশাসন না সিস্টেম? উত্তর মেলা ভার!