মাথা নত স্বৈরতন্ত্রের, কট্টর ইরানে নিষিদ্ধ হল নীতিপুলিশ! আর হিজাব?
Iran Hijab Protest: ইরানের কেন্দ্রীয় সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়েছেন, ইরান সরকার নীতিপুলিশ বাহিনী ‘গস্ত-এ-এরশাদ’-কে সম্পূর্ণ ভাবে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।”
“সিংহাসন খালি করো, কী জনতা আতি হ্যায়”
সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে লেখা হলেও রামধারী সিং দিনকরের এই উক্তিটি যথার্থভাবে খেটে যায় ইরানের ক্ষেত্রে। স্বৈরতন্ত্র চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে, দেশে শুধু ‘গণ’ই থেকে যায়, ‘তন্ত্র’ আর থাকে না। কয়েক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত ইরানের পরিস্থিতি সেরকমই ছিল। হিজাব বিরোধী আন্দোলনে সেখানে প্রাণ গিয়েছে অসংখ্য মানুষের। গত ১৬ সেপ্টেম্বর, হিজাববিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ মাহশা আমিনের মৃত্যু হয় পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন। পরিবারের তরফে দাবি করা হয়, হত্যা করা হয়েছে মাহশাকে। প্রতিবাদে গর্জে ওঠে সমগ্র ইরান। মাহশার মৃত্যুর চল্লিশ দিন উপলক্ষ্যে শোক সভার আয়োজন করেছিল তাঁর অনুগামীরা। সরকারি নির্দেশে নিরীহ মানুষদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় বর্বর পুলিশ। তবে তাতে আন্দোলন কমা তো দূর, আরও জোরদার হয়।
সরকার বিরোধী আন্দোলনে পথে নেমে যায় তরুণ প্রজন্ম। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে শতাধিক বিক্ষোভকারী প্রাণ হারালেও প্রতিবাদের আগুন নেভেনি। পুলিশি হেফাজতে কুর্দিশ তরুণী মাহশা আমিনির মৃত্যুর পর থেকেই দেশের মহিলারা কার্যত প্রাণ হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। ইতিমধ্যেই গত মাসের শুরুতে ইরানের খ্যাতনামা শেফ মেহরশাদ শাহিদিকে পিটিয়ে খুন করে ইরানের রেভলিউশনারি গার্ড ফোর্স। হিজাব-বিরোধী আন্দোলনে পথে নেমেছিলেন শাহিদি। ১৯ বছরের তরুণ শেফ শাহিদিকে ইরানের জেমি অলিভার বলা হত। মাহশার মৃত্যু দিয়ে যে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল, শাহিদির মৃত্যুতে সেই প্রতিবাদই হয়ে ওঠে আরও ভয়ডরহীন। পরিস্থিতি এমন যে এখন দেশের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের মৃত্যু পর্যন্ত চাইছেন আন্দোলনকারীরা। ইরানের জায়গায় জায়গায় স্লোগান উঠছে ‘ডেথ টু দ্য ডিক্টেটর’। কয়েক মাস আগে পর্যন্তও এসব অসম্ভব মনে হচ্ছিল। পুলিশি অত্যাচারে বছর বাইশের তরুণী মাহশা এবং উনিশ বছরের তরুণ শাহিদির মৃত্যুতে ক্ষোভে ফুঁসছে দেশের জনগণ, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম। দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর নির্বিচার গুলিও তাঁদের থামাতে পারছে না।
আরও পড়ুন- হিজাব নয়! কর্নাটক থেকে ইরান, আন্দোলনের মূল মন্ত্র নারীস্বাধীনতা
এই আন্দোলনকে ইরান সরকার নাম দিয়েছিল দাঙ্গার। সরকারের তরফে কড়া ভাষায় জানিয়ে দেওয়া হয় আন্দোলন না থামালে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর মধ্যেই দেখা দেয় সেই নৃশংস ‘ব্যবস্থা’। ১৬ নভেম্বর বিকেলবেলা, মেট্রোযাত্রীদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালায় নিরাপত্তারক্ষীরা। ইরানের রাজধানী তেহরানের মেট্রো স্টেশনে নিরাপত্তারক্ষীদের বিরুদ্ধে গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে। সেই ভিডিও সামনে আসতে বিক্ষোভ শুরু হয় গোটা বিশ্বজুড়ে। সরকারের এমন জঘন্য মানসিকতার বিরোধিতা করে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে জাতীয় সংগীত গাইতে অস্বীকার করে ইরানের ফুটবল দল। তার মধ্যেই ইরানের প্রধান ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেই এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে সরব হন তাঁরই ভাইঝি ফারিদেহ মোরাদখানি। ইরানে তাঁর কাকার উগ্র ইসলামি শাসনকে ‘খুন এবং শিশু খুনের রাজত্ব’ বলে অভিহিত করেছেন তিনি। ফলত গ্রেপ্তার হতে হয় তাঁকে। ফারিদেহের গ্রেফতারির প্রতিবাদে বোরখা খুলে, নিরাভরণ হয়ে, চুল কেটে প্রতিবাদে সরব হন দেশের মেয়েরা। ইরানের বিদ্রোহীদের সমর্থন জানান বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সাধারণ মহিলা-পুরুষ, এমনকী খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরাও। ইরান প্রশাসন চরম বলপ্রয়োগের পথে হাঁটলেও নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি বিক্ষোভকে। ১৯৭৯ সালের পর এত বড় রাজনৈতিক সংকট এর আগে কখনও আসেনি ইরানে।
পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে তাতে আয়াতোল্লা আলি খামেনেই বুঝতে পারেন সিংহাসন ‘খালি’ করার সময় অগ্রসর। তবে তেহরানের সিংহাসন এক্ষুনি খালি না হলেও, তাতে যে বেশ জোরে একটা ধাক্কা লেগেছে তা বলাই বাহুল্য। সরকারের বেঁধে দেওয়া হিজাববিধির বিরুদ্ধে গত দু’মাস ধরেই আন্দোলন চালাচ্ছিলেন ইরানের তরুণ প্রজন্ম। পথে নেমে হিজাব ছিঁড়ে ফেলে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন হাজার হাজার ইরানি মহিলা। অকথ্য অত্যাচার, হত্যার হুমকি, পুলিশের গুলি কিছুই থামাতে পারেনি বিদ্রোহকে। মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় পাঁচশোর বেশি বিদ্রোহী মারা গিয়েছেন বিগত আড়াই মাসে, যার মধ্যে প্রায় ৬৭ জন নাবালক। তবে এবার আন্দোলনকারীদের সামনে মাথা নত করতে হল ইরানের সরকারকে। রবিবার জানা যায়, এই আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিয়ে ইরানের উগ্র, কট্টর, অমানবিক নীতি পুলিশকে পাকাপাকিভাবে বরখাস্ত করে দিয়েছে সে দেশের সরকার। আশ্বস্ত করা হয়েছে শীঘ্রই পরিবর্তন আনা হবে হিজাব নীতিতে। ইরানের কেন্দ্রীয় সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল মহম্মদ জাফর মন্তেজারি জানিয়েছেন, “ওই নীতিপুলিশ কোনও দিনই ইরানের কেন্দ্রীয় বিচারব্যবস্থার অন্তর্গত ছিল না। ইরান সরকার ওই নীতিপুলিশ বাহিনী ‘গস্ত-এ-এরশাদ’-কে সম্পূর্ণ ভাবে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।”
আরও পড়ুন- হিজাবের আগুনে পুড়ছে ইরান! কেমন ছিল ইরানের মহিলাদের অতীত
ইরানের কেন্দ্রীয় সরকার গস্ত-এ-এরশাদ থেকে গা ঝেড়ে ফেললেও এই বাহিনীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইরানেরই প্রেসিডেন্ট। ২০০৬ সালে ইরানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই নীতিপুলিশ বাহিনীর। তখন সরকারের তরফে সরাসরি জানানো হয়েছিল, এই বাহিনীর লক্ষ্য হবে ইরানে হিজাব সংস্কৃতি যথাযথ ভাবে পালিত হচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত করা। মেয়েদের ‘শালীনতা’-র পাঠ দেওয়া। সোজা ভাষায় যাকে বলে নীতিপুলিশি। ইরানের সরকারের না-মঞ্জুর কিছু করলেই জুটবে ভয়ঙ্কর শাস্তি। হিজাব না পরায় মাহশাকে তুলে নিয়ে যায় এরাই। এর কয়েকদিন পর পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু হয় তাঁর। এর প্রতিবাদে গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকেই টানা চলছিল আন্দোলন। যার ফল অবশেষে হাতে পেলেন ইরানের মহিলারা। ১৬ বছর পর নিষিদ্ধ হল এই গস্ত-এ-এরশাদ বাহিনী।
একটা সময় হিজাব ছাড়াই নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াতেন ইরানের মহিলারা। ঘন, লম্বা চুল উড়ত ইরানের আকাশে। অনেকে স্বেচ্ছায় হিজাব পরতেন। তবে হিজাব পরার পাশাপাশি জিন্স, মিনি স্কার্ট এবং শর্ট-হাতা টপ পরেও ইরানের রাস্তায় স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতে পারতেন সেই দেশের মহিলারা। সত্তরের দশকের ইরানের ছবি দেখলে বোঝা যায়, সেই সময় বিকিনি পরে সমুদ্র সৈকতে নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়াতেন ইরানের মহিলারা। স্কুল-কলেজে উল্লেখযোগ্য ছিল ছাত্রী সংখ্যা। তবে ১৯৭৯ সালে আয়াতোল্লা রুহুল্লাহ খোমেইনি ক্ষমতায় আসার পরই নির্দেশ দেন, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দেশের সব মহিলাকে হিজাব পরে থাকতে হবে। তারপর ১৯৮৯ সালে ক্ষমতায় আসীন হয়ে একই নীতি বজায় রেখেছিলেন আয়াতোল্লা আলি খামেনেই। ফলত এগিয়ে যাওয়ার বদলে, আরও পিছিয়ে যায় ইরান। এখন দেখার বিষয়, নিজেদের কট্টর-রক্ষণশীল নীতি কতটা প্রত্যাহার করে সে দেশের সরকার। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, ইরান কি আবার ফিরে যাবে সেই আগের সময়ে? উত্তর দেবে সময়ই।