বোরখা-বিশ্বে অন্তর্বাসে বিরোধিতা! তারপরই কোথায় হারিয়ে গেলেন প্রতিবাদী ইরানি মহিলা?
Iran Woman Stripped: বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাবাহিনী ওই তরুণীকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। তারপর চাউর করে দেওয়া হয়, ওই নারী আসলে মানসিক রোগে আক্রান্ত!
দেওয়ালে পিঠ ঠেকলেও অনেকে গুটিয়ে যায়। আর দেওয়ালে চেপে ধরে যদি বন্দুকের নল ধরা হয় কপালের ঠিক মাঝে, তখন কেউ কেউ শেষ চিৎকার করেন। সহস্র কামানের সামনে, গোলার সামনে সেই একক চিৎকার মনে রেখে দেয় মানুষ। যেমন, মনে থেকে যাবে ইরানের এক মহিলাকে। সোশ্যাল মিডিয়া তাঁকে দেখেছে, অজস্র বোরখা পরিহিতা মহিলার মধ্যে একা অন্তর্বাসে বসে থাকতে, হেঁটে বেড়াতে। দেশটা ইরান। সেখানে মেয়েরা বাঁচে না। বাঁচলে মাথা থেকে পা ঢেকে রাখতে হয়। প্রতিক্ষণ মাথা নোয়াতে হয় ইসলামিক বিধির কাছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে ছবিটি ভাইরাল। সে তো হওয়ারই ছিল। ইরানের মতো কট্টর, রক্ষণশীল দেশে একজন তরুণী প্রকাশ্যে ক্যাম্পাসে অন্তর্বাসে ঘুরছে, এমন দৃশ্যই তো ভাইরাল হয়। ভাইরাল হয় না, প্রতিক্ষণ তিলে তিলে মেয়েদের মরে যাওয়ার গল্প, ভাইরাল হয় না সেই সত্য যে, এভাবে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কত কত মেয়ে হারিয়ে যাচ্ছে রোজ। হ্যাঁ, এই তরুণীকেও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি!
ইরানের বাধ্যতামূলক ইসলামিক পোশাক বিধির বিরুদ্ধে ছিল তাঁর প্রতিবাদ। গত শনিবার উত্তর-পশ্চিম তেহরানের ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ক্যাম্পাসে জনসমক্ষে এই তরুণী তাঁর পোশাক খুলে ফেলে অন্তর্বাসে বসে থাকেন, ঘুরে বেড়ান দৃপ্ত হয়ে। যা হওয়ার ছিল, তাই হলো! বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাবাহিনী ওই তরুণীকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। তারপর চাউর করে দেওয়া হয়, ওই নারী আসলে মানসিক রোগে আক্রান্ত! স্থানীয় এক গণমাধ্যম একটি ভিডিও ক্লিপও শেয়ার করেছে। দাবি, ওই ভিডিওতে যুবতীর প্রাক্তন স্বামীকে দেখা যাচ্ছে, মুখ ঝাপসা। লোকটি কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ওই তরুণী মানসিক সমস্যায় ভুগছে এবং সে দুই সন্তানের মা।
আরও পড়ুন- হিজাবের আগুনে পুড়ছে ইরান! কেমন ছিল ইরানের মহিলাদের অতীত
মঙ্গলবার, ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের পর ইরান সরকারের প্রথম মহিলা মুখপাত্র হওয়া ফাতেমেহ মোহাজেরানি হাম-মিহান দৈনিক পত্রিকাকে বলেছেন, ওই মহিলাকে চিকিৎসার জন্য থানা থেকে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তিনি বলছেন, “এই ছাত্রীর জন্য কোনও মামলা দায়ের করা হয়নি। নিরাপত্তার চেয়েও এই ইস্যুকে সরকার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই দেখছে। আমরা একজন ব্যক্তি হিসাবে এই শিক্ষার্থী, যিনি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, তা সমাধানের চেষ্টা করব।” সরকারের মুখপাত্র আরও বলছেন, যদি সিদ্ধান্ত হয় যে ওই তরুণী মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, তাহলে তিনি ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরেও আসতে পারেন। তবে তা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে। কী করে বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল যে প্রতিবাদকারী তরুণী আসলে মানসিক ভারসাম্যহীন? মোহাজেরানি বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে একটি ফাইল রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে মানসিক স্বাস্থ্যের মূল্যায়নের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। তার প্রাথমিক পর্যায় শেষও হয়েছে। ওই ফাইলের তথ্য নাকি বলছে ওই তরুণীর মানসিক স্থিতাবস্থা নেই।
Iran’s authorities must immediately & unconditionally release the university student who was violently arrested on 2 Nov after she removed her clothes in protest against abusive enforcement of compulsory veiling by security officials at Tehran's Islamic Azad University. 1/2 pic.twitter.com/lI1JXYsgtm
— Amnesty Iran (@AmnestyIran) November 2, 2024
জানা গিয়েছে, বাসিজ নামের এক স্বেচ্ছাসেবক আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা পোশাক বিধি সঠিকভাবে অনুসরণ না করার জন্য ওই তরুণীকে হেনস্থা করেন। এরই প্রতিবাদে ওই মহিলা তাঁর সমস্ত পোশাকই খুলে অন্তর্বাস পরে থাকেন শুধু। তারপরেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। মহিলার অবস্থান সম্পর্কে সেই থেকেই আর কোনও স্পষ্ট উত্তর নেই কারও কাছেই।
আরও পড়ুন- মাথা নত স্বৈরতন্ত্রের, কট্টর ইরানে নিষিদ্ধ হল নীতিপুলিশ! আর হিজাব?
জানা গিয়েছে ওই তরুণীর নাম আহু দারিয়াই। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, বেশ কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে শেষবার তাঁকে একটি গাড়িতে উঠতে দেখা গেছিল। ইউরোনিউজ এবং আরও অন্যান্য সংবাদ সূত্র বলছে, আহু দারিয়াইকে গোয়েন্দা এজেন্টরা আটক করে কোনও অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছে। এবিসি নিউজ বলছে, ইরানে বিক্ষোভকারীদের প্রায়ই কর্তৃপক্ষ মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে জোর করে পাঠিয়ে দেয়। জোর করে তাঁদের মানসিক ভারসাম্যহীন বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, ইরান কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে এবং নিঃশর্তভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রীকে মুক্তি দিতে হবে। বাধ্যতামূলক হিজাব আইনের অপমানজনক প্রয়োগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেই হিংস্রভাবে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাঁকে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ইরানের কারাগারে মহিলাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে কাজ করছে। বাধ্যতামূলক হিজাবের ইস্যুটি ইরানে ২০২২ এবং ২০২৩ সালে ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। মাহশা আমিনি নামে এক তরুণী মাথায় হিজাব না পরায় পুলিশি হেফাজতে তাঁর মৃত্যু ঘটে। ২২ বছরের মাহশাকে কঠোর পোশাক বিধি পুরোপুরি মেনে না চলার অভিযোগে তেহরানে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ওই বিক্ষোভ চলাকালীন শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে ইরানে। আমিনির মৃত্যুর পর ইরানের মেয়েরা হিজাব পুড়িয়ে দিয়েছিলেন অনেকেই। তাতে আরও বেড়েছে মৃত্যু। আহু দারিয়াই কি মুক্তি পাবেন? আহু দারিয়াই কি আদৌ বেঁচে আছেন? আহু দারিয়াইরা কি কোনওকালেই বেঁচেছিলেন ইরানে?