পরিবারেই লুকিয়ে বিপদ! হেমন্ত সোরেনের স্ত্রী কল্পনার মুখ্যমন্ত্রিত্বের পথের কাঁটা কে?
Hemant Soren Kalpana Soren : হেমন্ত সোরেন গ্রেফতার হওয়ায় জেএমএমের প্ল্যান বি হিসাবে দেখা হচ্ছে কল্পনা সোরেনকে৷ কিন্তু এতই সহজ নয় সীতা সোরেনকে উপেক্ষা করা।
অর্থ তছরুপের মামলায় ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে গ্রেফতার করা হলো। বহুদিন থেকেই শোনা যাচ্ছিল, এমনটা ঘটলে তাঁর স্ত্রী কল্পনা সোরেন হবেন সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা দলের সূত্রে এমনটাই বলা হয়েছে । বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবেও গত মাসের শুরুতে ঠিক এমন কথাই বলেছিলেন কিন্তু তখন হেমন্ত সোরেন তখন তা একেবারেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এমনকী অদূর ভবিষ্যতেও যে তাঁর স্ত্রী কোনওদিন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন সেই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি অর্থ তছরুপের মামলায় হেমন্ত সোরেনকে গ্রেফতার করেছে। স্ত্রী কল্পনা সোরেন কি তবে সত্যিই মুখ্যমন্ত্রী হবেন? সমীকরণ এতটা সোজা নয়।
তবে প্রথমে জানতে হবে কল্পনা সোরেন আসলে কে? কল্পনা সোরেন কোনও বিধায়কও নন। সুতরাং মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে হলে তাঁকে ছয় মাসের মধ্যে কোনও উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে বিধানসভার সদস্য হতে হবে। তবে এই ক্ষেত্রে আরও একটি বাধা রয়েছে। বিধানসভার মেয়াদ এক বছরেরও কম সময়ে শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে উপনির্বাচনও বাতিল করা যেতে পারে।
ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের বাসিন্দা কল্পনা ২০০৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি হেমন্ত সোরেনকে বিয়ে করেন এবং তাঁদের দু'টি সন্তান রয়েছে - নিখিল এবং অংশ। কল্পনা সোরেনের জন্ম ১৯৭৬ সালে, রাঁচিতে। তাঁর বাবা একজন ব্যবসায়ী এবং মা গৃহিণী। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হওয়ার পরে এমবিএ করেন কল্পনা। বর্তমানে কল্পনা সোরেন একটি স্কুল চালান বলে জানা গেছে। জৈব চাষের সঙ্গেও তিনি জড়িত এবং তিনটি বাণিজ্যিক ভবনের মালিক কল্পনা যার দাম প্রায় ৫ কোটি টাকা। এছাড়াও তিনি নারী ও শিশু ক্ষমতায়ন বিষয়ক অনুষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত যোগ দিয়ে থাকেন।
২০২২ সালে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস হেমন্ত সোরেনের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁর স্ত্রীর মালিকানাধীন একটি কোম্পানিকে শিল্প এলাকায় একটি প্লট পাইয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। সেই প্রথম শিরোনামে আসেন কল্পনা।
আরও পড়ুন- ইডি-র হাতে গ্রেফতার হেমন্ত সোরেন, কোন পথে এবার ঝাড়খণ্ডের রাজনীতি?
হেমন্ত সোরেনের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনাটি সমস্ত দিক থেকেই এই ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ। ২০২২ সাল থেকেই সূত্রপাত। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম), কংগ্রেস এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) জোটের বিধায়কদের তৎকালীন কংগ্রেস শাসিত ছত্তিশগড়ের রায়পুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বিমানবন্দর থেকে বিধায়কদের নিয়ে যাওয়া হয় নাভা রায়পুরের একটি বিলাসবহুল রিসর্টে। ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন তখন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিরুদ্ধে তাঁর সরকার ফেলার চেষ্টার অভিযোগ আনেন। ওই একই সময়ে, মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের বৌদি সীতা সোরেন ঝাড়খণ্ডের হেমন্ত সোরেন সরকারের বিরুদ্ধে 'জমি লুট' রোধ করতে না পারার অভিযোগ আনেন। এই সীতা সোরেন হচ্ছেন তিনবারের বিধায়ক এবং হেমন্তের বড় ভাই দুর্গা সোরেনের স্ত্রী।
২০২৪ সালের জানুয়ারির শেষভাগে সেই একই অবস্থা শুরু হলো ফের। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার নেতা হেমন্ত সোরেনকে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট গ্রেফতার করেছে। এই সময় সীতা সোরেনের আবির্ভাব হয়েছে ফের! জেএমএমের এই পারিবারিক কলহই রাজ্যের সরকার গঠনের অনিশ্চয়তার কারণ।
৪৯ জন জোট বিধায়কের মধ্যে ৩৫ জন মঙ্গলবার একটি সভায় যোগ দিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। বাকিরা সীতা সোরেনকে সমর্থন করছে বলেই মনে করা হচ্ছে। সীতা সোরেন আগেই ব্যাপক দুর্নীতির জন্য ঝাড়খণ্ড সরকারের সমালোচনা করেছিলেন। ভারতীয় জনতা পার্টি এবং কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলিও হেমন্ত সোরেনের বিরুদ্ধে ঠিক একই অভিযোগ এনেছে।
হেমন্ত সোরেনকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ০.৮৮ একর খনির ইজারা জমা দিতে হয়েছিল। ২০২১ সালে ওই জমি নিয়েছিলেন তিনি। সীতা সোরেন বলেছিলেন, "গুরুজি (শিবু সোরেন, জেএমএম সুপ্রিমো) এবং আমার স্বামী, জল, জঙ্গল, জমির যে দর্শন তৈরি করেছিলেন তা ধ্বংস করা হচ্ছে। দুর্নীতিবাজ অফিসারদের ঢাল করা হচ্ছে। জনগণ আমাদের সরকারের কাছে আশা করেছিল, কিন্তু এখন তারা হতাশ।"
হেমন্ত সোরেন গ্রেফতার হওয়ায় জেএমএমের প্ল্যান বি হিসাবে দেখা হচ্ছে কল্পনা সোরেনকে৷ কিন্তু এতই সহজ নয় সীতা সোরেনকে উপেক্ষা করা। তিনবারের জেএমএম বিধায়ক সীতা সোরেন নিজেকে 'শিবু এবং দুর্গা সোরেনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী' বলে আসেন। তাঁর নজরও রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর আসনের দিকে। সীতা বলেছেন, "আমি সোরেন পরিবারের বড় পুত্রবধূ এবং আমার স্বামী ঝাড়খণ্ড তৈরির জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করেছিলেন। আমি হেমন্ত সোরেনকেই উত্তরাধিকারী বলে মনে করতাম, অন্য কাউকে নয়।"
আরও পড়ুন- কংগ্রেস-তৃণমূল বন্ধুতার পথে কাঁটা অতিরিক্ত ‘বামপ্রীতি’! মালদহের সভা থেকে যা বললেন মমতা
সীতা সোরেনের দুই মেয়ে, রাজশ্রী এবং জয়শ্রীও মায়ের সঙ্গেই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন। জেএমএমের ছাত্র সংগঠন এবং যুব শাখা দুই-ই থাকা সত্ত্বেও তাঁরা তাদের মৃত বাবার নামে একটি শাখা তৈরি করেন, দুর্গা সোরেন সেনা গড়েন। ২০২১ সালে, জেএমএম তার ছাত্র সংগঠনের ১২ জন সদস্যকে দলবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে বহিষ্কার করে। এরা পরে দুর্গা সোরেন সেনাতে যোগ দেয়।
পরের বছর, সীতা সোরেনের তৃতীয় কন্যা বিজয়শ্রী, দুর্গা সুরেন সেনার কেন্দ্রীয় সভাপতি, বলেন, "ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন দুর্নীতিবাজদের দিয়ে ঘেরা। হেমন্ত স্যার রাজ্যকে চরম দারিদ্র্য থেকে বের করার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তার চারপাশে রাজ্য সরকারের পদমর্যাদার এমন লোক রয়েছে যারা দুর্নীতিগ্রস্ত।”
মজার বিষয় হলো, কল্পনা এবং সীতা, দু'জনেই ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার বাসিন্দা, রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর নিজের জেলা। কল্পনার মুখ্যমন্ত্রিত্ব নিয়ে নিজের অবস্থান সাফ জানিয়ে সীতা সোরেন বলেছেন, "যদি কল্পনা সোরেনকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়, আমি সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেব না। আমি এই বাড়ির বড় ছেলের স্ত্রী।"