‘এক দেশ-এক ভোট’ নীতি: যুক্তরাষ্ট্র কাঠামো ধ্বংসের দিকে আরও এক ধাপ?
One Nation One Election: এই উপমহাদেশে ঐতিহাসিক ভাবে যে সাংস্কৃতিক, ভাষা, জীবন-যাপনে যে বৈচিত্র্য আছে, সংঙ্ঘের কাছে তা এক মূর্তিমান বিপদ।
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় বার শাসনের ঠিক একশো দিনের মাথায় 'এক দেশ- এক ভোট' নীতিতে সিলমোহর দিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। এই প্রসঙ্গে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটি সারা দেশে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন ((এমনকী লোকাল বডি অর্থাৎ পঞ্চায়েত ও মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন) একসঙ্গে করার কথা বলা হয়েছে। মন্ত্রিসভা এই সিদ্ধান্তে নীতিগত সম্মতি দিলেও কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের কথা থেকে এটা পরিষ্কার যে ঠিক কোন নির্বাচন থেকে এই নীতি কার্যকর হবে, তা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে আগামী লোকসভা নির্বাচন থেকেই এই নিয়ম কার্যকরী হবে। রামনাথ কোবিন্দের সুপারিশ যাই হোক না কেন, এ কথাটা কারও অজানা নয় যে সংঘ পরিবার ও ভারতীয় জনতা পার্টি তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থেকেই 'এক দেশ-এক ভোটে'র কথা বলে আসছে। এক দেশ-এক পরীক্ষা, এক দেশ-এক আইন, এক দেশ-এক কর— এগুলি সবই তাদের প্রকল্পিত 'হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান' ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ২০১৫ সালে একটি সংসদীয় কমিটি সরকারকে সুপারিশ করে দেশে একসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভার নির্বাচন করার। সেই সুপারিশের ভিত্তিতেই এই উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন ও তার রিপোর্ট প্রকাশ।
রামনাথ কোবিন্দের ১৮,৬২৬ পাতার রিপোর্টে সুপারিশের অংশে যা যা বলা হয়েছে তার সারাৎসার আলোচনার সুবিধার্থে তুলে ধরা যেতে পারে:
- এখানে দু'পর্বে নির্বাচন করার কথা বলা হয়েছে। প্রথম ধাপে একই সঙ্গে সারা দেশে লোকসভা ও বিধান সভা নির্বাচন করা হবে। দ্বিতীয় ধাপে এই নির্বাচনের একশো দিনের মধ্যে পৌরসভা ও পঞ্চায়েতের মত লোকাল বডিগুলো নির্বাচন করতে হবে।
- লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের সঙ্গে একই সঙ্গে লোকাল বডি নির্বাচন করার জন্য কমিটি ভারতীয় সংবিধানে '৩২৪এ' নামে এক নতুন ধারা যুক্ত করার প্রস্তাব রেখেছে।
- একই সঙ্গে বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন, রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সহযোগিতায় এক অভিন্ন ভোটার তালিকা ও সচিত্র পরিচয়পত্র তৈরি করবে।
- কমিটি বলেছে যে এক সাধারণ নির্বাচন তালিকা তৈরির জন্য সংবিধানের ৩২৫ ধারা সংশোধন করতে হবে। এক্ষেত্রে দেশের বিধানসভাগুলির এক তৃতীয়াংশের সম্মতি প্রয়োজন। তবে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজ্য বিধানসভাগুলোর মতামতের কোনও প্রয়োজন নেই।
- এখানে বলা হয়েছে যে মাঝপথে কোনও সরকারের,তা কেন্দ্রীয় হোক বা রাজ্য— যদি সরকারের পতন ঘটে ও অকাল নির্বাচন করতে হয়, সেক্ষেত্রে নতুন নির্বাচিত সরকার বাকি সময়টা শাসন করবে। সোজা কথায় পাঁচ বছরের সময় সীমার মধ্যে যদি তিন বছর পর কোনও সরকারের পতন হয়, তবে নতুন নির্বাচিত সরকারের সময়সীমা হবে মাত্র দু'বছর।
- কমিটির মতে, যে নির্দিষ্ট সময়ে প্রথম বারে এই অভিন্ন নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হবে, সেবার সাযুজ্যের জন্য বিধানসভাগুলির কার্যকাল কম-বেশি হবে। এ বিষয়ে কমিটির বক্তব্যে যা বোঝা যাচ্ছে, তা হল যদি ২০২৯ সালে লোকসভা নির্বাচন হয় তাহলে অনেকগুলো বিধানসভার কার্যকালের মেয়াদ কমে যাবে।
আরও পড়ুন: খরচে কমানোই একমাত্র লক্ষ্য? ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ নীতির নেপথ্যে কোন পরিকল্পনা বিজেপির?
তথ্যের খাতিরে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এই বছর (২০২৪) মহারাষ্ট্র, জম্মু-কাশ্মীর ও হরিয়ানায় নির্বাচন হতে চলেছে। দিল্লি ও বিহারে নির্বাচন হবে ২০২৫ সালে, পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, অসম ও তামিলনাড়ুতে ২০২৬-এ, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশে ২০২৭-এ এবং ২০২৮ সালে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা ও কর্নাটকে। সরকারের বক্তব্য দ্রুত প্রস্তাবের খসড়া নিয়ে বাণিজ্য সংস্থা, সামাজিক গ্রুপের কাছে যাওয়া হবে যাতে তারা এই নীতি কীভাবে অর্থনীতি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে এবং কালো টাকা বন্ধে সহায়ক হতে পারে তা বুঝতে পারে।
আমরা যদি এই মুহূর্তে দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা বিন্যাসকে বিচার করি, তাহলে দেখব মন্ত্রিসভা যা-ই সিদ্ধান্ত নিক না কেন, এই মুহূর্তে 'এক দেশ- এক ভোট' লাগু করা বিজেপির পক্ষে খুব একটা সহজ বিষয় হবে না। লোকসভা নির্বাচনের পর এই সময় বিজেপি আর সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নয়,বর্তমানে তার আসন সংখ্যা ২৪০ এবং সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য তারা নীতিশ কুমারের সংযুক্ত জনতা দল এবং চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশম পার্টির উপর নির্ভরশীল। শরিক হিসাবে এদের বিশ্বাসযোগ্যতা নেই বললেই চলে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল এই নির্বাচন চালু করতে হলে একটি ক্ষেত্রে রাজ্য বিধানসভাগুলির এক তৃতীয়াংশের সহমত প্রয়োজন। সেটাও জটিল এবং আগামী নির্বাচনগুলিতে বিশেষ করে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় বিজেপি পরাজিত হয়, তাহলে ছবিটা জটিলতর হবে। আরেকটি কথা হল সংবিধান সংশোধন করে নতুন নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে এক সহমত প্রয়োজন। কোবিন্দের রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যাচ্ছে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, সমাজবাদী পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেস, ডিএমকে, সব কটি সংসদীয় কমিউনিস্ট দল এই নীতির তীব্র বিরোধী। তা-ই এখনই এই নীতি কার্যকরী করা সম্ভব হবে না। অবশ্য তাতে বিজেপির পিছিয়ে আসার সম্ভাবনা নেই কারণ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির এটা কোর ইস্যু।
বিজেপির এই নীতির মূল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনার আগে এর স্বপক্ষে সরকার পক্ষ যে সমস্ত যুক্তি দিচ্ছে, তার সত্যতা জানা জরুরি। এক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এভাবেই দেশে নির্বাচন হত। শুনে মনে হতে পারে যে সংবিধানে বোধহয় এরকম কোনও সুপারিশ রয়েছে। বিষয়টা এ রকম নয়। সংবিধানে লোকসভা ও রাজ্যসভার মেয়াদ নির্দিষ্ট করা আছে কিন্তু কোথাও এক সঙ্গে সমস্ত ভোট করার কথা বলা নেই। এক্ষেত্রে ভারতে সংসদীয় নির্বাচনের ইতিহাসটা স্মরণ করা প্রয়োজন। ১৯৫১ সালে দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়, স্বাভাবিক ভাবেই দেশের লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন এক সঙ্গে হয়। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এ ব্যবস্থাই লাগু ছিল এবং তখন নির্বাচনী রাজনীতিতে কংগ্রেস পার্টির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। পরবর্তীতে বহুদলীয় ব্যবস্থার বিকাশ হয়, বহু জায়গায় আঞ্চলিক দলগুলো ক্ষমতায় আসে। ৬৭' পরবর্তী অনেক সরকার পুরো মেয়াদ শেষ করেনি ফলে সেখানে আগে নির্বাচন করতে হয়। এক কথায় বলা যায়, বহুদলীয় ব্যবস্থার বিকাশের কারণেই কালের নিয়মে আলাদা আলাদা নির্বাচন হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল গণতন্ত্রের মূল্য টাকার অঙ্কে বিচার করা যায় না। এই বিশাল মাপের নির্বাচন সংঘটিত করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা নির্বাচন কমিশনের আছে কি না,সেটাই আজ বড় প্রশ্ন। সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে কমিশনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অযোগ্যতা ও দলদাসবৃত্তির অভিযোগ উঠেছে। স্বাভাবিক ভাবে আজ এই প্রশ্ন উঠছে, যারা লোকবল ও পরিকাঠামোর অভাবে হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচন একসঙ্গে করতে পারল না, তারা কীভাবে একসঙ্গে সারা দেশে নির্বাচন করবে!
একসঙ্গে নির্বাচন করলে কালো টাকার প্রভাব কমবে, এটা বিজেপির এক কৌশলী প্রচার যা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে ধারাবাহিক ভাবে করে আসছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল নোটবন্দি। কালো টাকার বিরুদ্ধে সেই জেহাদের গল্পের পরিণতি সবার জানা। নির্বাচনকে কালো টাকা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে যারা নির্বাচনী বন্ড চালু করেছিল, তাদের মুখে কালো টাকা দূর করার প্রতিশ্রুতি নেহাৎই ছেলে-ভোলানো গল্প।
একথা সকলের জানা যে ভারতীয় সংবিধান চালু হবার পর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল। হিন্দুত্ববাদী তাত্ত্বিকেরা হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের আদলে যে রাষ্ট্রের কল্পনা করে, তা চরিত্রগত ভাবে এককেন্দ্রিক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাবনার সম্পূর্ণ বিরোধী। এই উপমহাদেশে ঐতিহাসিক ভাবে যে সাংস্কৃতিক, ভাষা, জীবন-যাপনে যে বৈচিত্র্য আছে, সংঙ্ঘের কাছে তা এক মূর্তিমান বিপদ। ভারতে ষাটের দশকের পর থেকে আঞ্চলিক রাজনীতির বিকাশ ঘটেছে, যেভাবে বিভিন্ন আঞ্চলিক আকাঙ্খার প্রতিনিধিরা রাজনীতিতে উঠে এসেছেন, তাকে এক রাষ্ট্রের সমর্থকদের পক্ষে মেনে নেওয়া মুশকিল। বিজেপি উদ্দেশ্য কেন্দ্র ও রাজ্যের জন্য একই ধরণের ন্যারেটিভ প্রস্তুত করা যার দ্বারা ভোটের সময় আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের ভাবনাকে ভাসিয়ে নেওয়া যাবে।
আরও পড়ুন:মোদি-মন্ত্রিসভার সিলমোহর, ‘এক দেশ এক ভোট’ চালু করতে কেন এত মরিয়া বিজেপি সরকার?
দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখছি কেন্দ্র ও রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের বিষয়টা নির্বাচকমন্ডলী ভিন্ন ভাবে দেখে। এই বৈচিত্রকে অনেকেই ভারতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার টিকে থাকার প্রধান শর্ত মনে করেন। ভারতীয় সংবিধানে এখনো পর্যন্ত যেটুকু আধা-যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আছে, সেটুকু ধ্বংস করার কাজে বিজেপি আদর্শগত ভাবে দায়বদ্ধ। সাম্প্রতিক সময়ে জিএসটির মাধ্যমে রাজ্যগুলিকে অর্থনীতির প্রশ্নে পুরোপুরি কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী করে তোলা হয়েছে। নয়া শিক্ষানীতিতে উচ্চ শিক্ষার আর্থিক সংস্থান ও শিক্ষা নির্দেশিকা এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যে রাজ্যগুলো কেন্দ্রীয় শিক্ষা নীতি মানতে বাধ্য। ভারতীয় সংবিধান কখনোই পূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সওয়াল করেনি কিন্তু মোদি জমানার লক্ষ্য হচ্ছে দেশকে এক এক কেন্দ্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা। এই নীতি সফল হলে তারা দেশের সংসদীয় কাঠামোটির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি প্রধান শাসনব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা করবে। হিন্দু রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সেটা সংঘের কাছে আরও সুবিধাজনক পদ্ধতি হবে। কোবিন্দ কমিটির সুপারিশের বিরোধিতার দায় শুধু বিরোধী দলগুলোর নয়, এ দায় আজ সমস্ত ধর্ম নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক মানুষের।