ডাকিনীতন্ত্রের চর্চায় প্রবল উৎসাহী ছিলেন নিউটন!
সাক্ষর সেনগুপ্তঃ সালটা ১৬৯৬। অধ্যয়ন অধ্যাপনা এবং গবেষণায় কেমব্রিজের ট্রিনিটি-তে ৩৫ বছরের কর্মজীবন শেষ। তিনি এবার গড়তে চান নতুন কেরিয়ার। মোটা মাইনের সরকারি আমলার চাকরি। তাঁর নতুন ঠিকানা দেশের রাজধানী লন্ডন। বন্ধুদের উমেদারিতে জুটেছে চার গুণ বেশি বেতনের কাজ। সরকারি টাঁকশালে। প্রথমে ওয়ার্ডেন, পরে ভাল কাজ দেখিয়ে সেখানকার ‘মাস্টার’। কে খুঁজে নিলেন এই নতুন পেশায় পথ চলার হদিশ? স্যার আইজাক নিউটন। হ্যাঁ। যিনি গতির তিন সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন, অভিন্ন মহাকর্ষ বলের সন্ধান পেয়েছিলেন, ক্যালকুলাস নামে গণিতের অসীম মূল্যবান শাখা উদ্ভাবন করেছিলেন, সাগরে জোয়ার-ভাটার কারণ বুঝেছিলেন আবার সূর্যালোকের উপাদান বিশ্লেষণ করেছিলেন। যাঁর প্রতিভাকে স্বয়ং আলবার্ট আইনস্টাইন কুর্নিশ জানিয়েছিলেন, সেই নিউটন। বিজ্ঞানী হিসেবে যিনি সকলের শ্রদ্ধেয়। ভাগ্যের পরিহাসে তিনিই ছিলেন নানা দুরভিসন্ধি ও চক্রান্তের ইন্ধনদাতা। নিজের পেশা বা কাজের জগতে কোনওরকম বাধা নির্মমভাবে গুঁড়িয়ে দিতে দ্বিধা করতেন না। আর নানা কুসংস্কার, বুজরুকিতে প্রবল বিশ্বাসী, এমনকি ডাকিনীতন্ত্র চর্চাতেও অসম্ভব উৎসাহী।
এ এক অন্য নিউটন। সকলের অচেনা। জনমানসে রয়েছে তাঁর অন্য ভাবমূর্তি। এক গবেষক, যিনি একাই অঙ্কের সূত্রে উদ্ঘাটন করেন বিশ্বরহস্য, না খেয়ে ও না ঘুমিয়ে কাটান রাতের পর রাত, শুধু পরীক্ষার জন্য সূর্যের প্রচণ্ড দীপ্তির দিকে তাকিয়ে থাকেন অনেকক্ষণ। আশ্চর্য, এই জ্ঞানতপস্বীরও যে অন্য এক জীবন ছিল, তা জানা গেছে ধীরে ধীরে। বিশেষজ্ঞেরা বিস্মিত। বই লিখেছেন দু’রকম নিউটনকে নিয়ে। ৫৫০ পৃষ্ঠার বই ‘নিউটন অ্যান্ড দি ওরিজিন অব সিভিলাইজেশন’। লেখক দুই বিশেষজ্ঞ। ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির জেড বাকওয়াল্ড। এবং তাঁর সহকর্মী মরদেশাই ফিনগোল্ড। নিউটন বিষয়ে যাঁদের গবেষণা বহু কালের। ওঁদের উদ্দেশ্য: দুই নিউটন আলোচনা। রিচার্ড ওয়েস্টফল, যিনি লিখেছেন নিউটনের ন’শো পৃষ্ঠার জীবনী (‘নেভার অ্যাট রেস্ট’), তাঁর স্বীকারোক্তি স্মরণীয়। কাজ শুরুর আগে লেখক ভেবেছিলেন সময় লাগবে দশ বছর। বাস্তবে লাগে তার দ্বিগুণ। ২০ বছরকাল নিউটনে মজে থাকতে গিয়ে তাঁর মনে হয় তিনি ডুবে যাচ্ছেন অতলে। নিউটনের ৮৪ বছরের জীবনে কত যে চড়াই-উতরাই। মানুষটাও যে ভীষণ রহস্যময়।
১৯৩৬ সালের আগে প্রায় ২০০ বছর গুনমুগ্ধরা জানত কেবল এক জন নিউটনকে। মৃত্যু হয় ৮৪ বছর বয়সে। ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ মার্চ। ঘটনাচক্রে তখন লন্ডনে উপস্থিত বিখ্যাত এক ব্যক্তিত্ব। ফরাসি লেখক ভলতেয়ার। প্রয়াত নিউটনকে রাষ্ট্রের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন দেখে তিনি বিস্মিত। মরদেহ কাঁধে নিলেন এক জন চ্যান্সেলর, দুই ডিউক, তিন আর্ল। পিছনে রয়াল সোসাইটি’র সভ্যবৃন্দ। দেহ ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে-তে রাখা হল আট দিন। তার পর সেখানে রাজকীয় মর্যাদায় সমাধি। আর তাতে প্রস্তরফলকে উৎকীর্ণ বিশেষ প্রশস্তি। ‘এখানে শায়িত তিনি, যাঁর মনীষা ঈশ্বর-তুল্য। মানবজাতির এ হেন অলংকার আমাদের গর্ব।’
জনমানসে অজানা নিউটনের আত্মপ্রকাশ ১৯৩৬ সালে। সে এক আশ্চর্য ঘটনা। ব্যক্তিগত কাগজপত্র প্রায়ই পুড়িয়ে ফেলতেন বিজ্ঞানী। তার বাইরেও কাগজ ছিল অসংখ্য। যে সব তাঁর জীবনীলেখকরা ছুঁয়েও দেখেননি। আর কেমব্রিজ বিশ্ববিদালয়ের মহাফেজখানা সংগ্রহে রাখেনি। রাখবে কেন, ও সব নাকি ফালতু। ও রকম বহু বান্ডিল নিউটনের পরিবারের তরফে ওই বছর নিলামে তোলা হল। মাত্র ৯০০০ পাউন্ডে অনেকটা কিনলেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইন্স। লেখাজোখা পড়তে বসে তিনি বিস্ময়ে হতবাক। নিউটন যতটা না ভেবেছেন গ্রহ-তারা নিয়ে, তার চেয়ে ঢের বেশি পরীক্ষা করেছেন অ্যালকেমি বিষয়ে। হ্যাঁ, অ্যালকেমি। মধ্যযুগীয় বুজরুকি। পারদকে সোনা বানানোর স্বপ্ন। অথবা অনন্ত যৌবন লাভের সালসা প্রস্তুতের খোয়াব। ডাকিনীতন্ত্র চর্চাতেও আগ্রহ তাঁর। ৬৬৬ সংখ্যাটি যে অশুভ, ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম যে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০৪ অব্দে, কিংবা ব্রহ্মাণ্ড যে ধ্বংস হবে ২০৬০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ— এ সব বিষয়েও বিস্তর খেটে প্রবন্ধ রচনা! এই নিউটন নাকি বস্তুবাদের জনক! মহাবিজ্ঞানীর জন্মের ত্রিশতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে কেইন্স যে বক্তব্য রাখলেন তার শিরোনাম— নিউটন দ্য ম্যান। কেইন্স বললেন, ‘নিউটন ওয়জ নট দ্য ফার্স্ট অব দি এজ অব রিজন, হি ওয়জ দ্য লাস্ট অব দ্য ম্যাজিশিয়ানস।’
নিউটনের আধুনিক জীবনীকারেরা একটা ব্যাপারে একমত। বন্ধুত্বে যতটা না চেনা যেত তাঁকে, তার চেয়ে ঢের বেশি বোঝা যেত শত্রুতায়। তখন বিজ্ঞানী কুটিল, প্রতিহিংসাপরায়ণ। প্রায় হিংস্র। জ্যোতির্বিজ্ঞানী জন ফ্ল্যামস্টিড অ্যাস্ট্রোনমার রয়াল। গ্রিনউইচ মানমন্দিরের অধিকর্তা। সুতরাং, গ্রহ-তারার চলনের প্রচুর তথ্য তাঁর হাতে। যে গ্রন্থ রচনা করে তিনি জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন, সেই ‘প্রিন্খিপিয়া ম্যাথমেটিকা’-র নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হবে। নিউটন চান তাতে সংকলিত হোক জ্যোতির্বিজ্ঞানের সর্বশেষ তথ্য। যা রয়েছে মানমন্দিরের হেফাজতে। নিউটন তখন রয়াল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। পদাধিকার বলে সোসাইটিতে ডেকে পাঠালেন ফ্ল্যামস্টিড-কে। এলেন তিনি। প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও। নিউটন তাঁর দু’চক্ষের বিষ। বলা বাহুল্য, নিউটনও তাঁকে দেখেন না সুহৃদ হিসাবে। বিদ্বেষ দ্বিপাক্ষিক। ফ্ল্যামস্টিড সন্দেহ করেন নিউটন কলকাঠি নাড়েন বলেই অ্যাস্ট্রোনমার রয়াল হয়েও তিনি বেতন পান কম। তেমন মানুষের তলব পেয়ে রয়াল সোসাইটিতে আসা। তীব্র বাদানুবাদ হল দুজনের। ফ্ল্যামস্টিড নিউটনের মুখের ওপর জানিয়ে দিলেন মানমন্দিরে সংগৃহীত তথ্য গ্রিনউইচ-এর সম্পত্তি। হুকুম করলেই নিউটন তা পেতে পারেন না। ঝগড়ার পরিণাম? রয়াল সোসাইটি থেকে বহিষ্কৃত হলেন ফ্ল্যামস্টিড।
আর এক জন। রবার্ট হুক। রয়াল সোসাইটির কিউরেটর। তিনি অভিযোগ করলেন নিজের গ্রন্থে নিউটন সাহায্য নিয়েছেন তাঁর গবেষণার। অথচ কৃতজ্ঞতা স্বীকারের সৌজন্য দেখাননি। অভিযোগ শুনে নিউটন ক্ষিপ্ত। মন্তব্য করলেন, ‘আমি যদি বহু দূর দৃষ্টিপাত করে থাকি, তবে তা দৈত্যদের কাঁধে দাঁড়ানোর সুবাদে।’ অর্থাৎ, হুক কোথাকার কে? ‘প্রিন্খিপিয়া’ তো রচিত কোপার্নিকাস, কেপলারের সাফল্যের সূত্র ধরে। নাহ্, মন্তব্যের ইঙ্গিত শুধু ওটুকু নয়। খোঁচাও লুকিয়ে তার মধ্যে। সাহায্য যদি নিয়েই থাকি তবে তা দৈত্যদের থেকে, বামনদের থেকে নয়। খোঁচার লক্ষ্য হুক। তিনি যে খর্বকায়।
নিউটনের জীবনে সবচেয়ে বড় বিতর্ক বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। এ ঝগড়ায় তাঁর প্রতিপক্ষ জার্মান গণিতজ্ঞ গডফ্রিড উইলহেল্ম ফন লিবনিৎজ। ক্যালকুলাসের আবিষ্কর্তা কে, নিউটন না লিবনিৎজ? সত্য এই যে, নিউটন প্রথমে আবিষ্কার করেন গণিতের ওই শাখাটি। কিন্তু গোপনীয়তা তাঁর প্রিয় বলে আবিষ্কারটি না ছেপেই তিনি বসে থাকেন চুপচাপ। এর অনেক পরে লিবনিৎজ নিজের মতো করে আবিষ্কার করেন ক্যালকুলাস। এবং তা ছাপেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। নিউটনের বন্ধুদের উস্কানিতে নিউটনের সন্দেহ হয়, কারও মারফত তাঁর আবিষ্কার পৌঁছেছে লিবনিৎজ-এর কাছে। তড়িঘড়ি ছেপে দিয়ে তিনি এ বার দাবি করছেন কৃতিত্ব। লিবনিৎজ সন্দেহ উড়িয়ে দিলেন ফুৎকারে। শুরু হল কাজিয়া। প্রথমে গালমন্দ, পরে প্রায় রাজনৈতিক ঝামেলা। ইউরোপ মহাদেশ দু’ভাগ হয়ে গেল ক্যালকুলাস কাজিয়ার সূত্রে। এক দিকে নিউটন ও ইংল্যান্ডের প্রায় সমস্ত বিজ্ঞানী। অন্য দিকে লিবনিৎজ এবং ইউরোপের অন্য দেশের বিশেষজ্ঞরা। ঝগড়া চলল প্রায় তিন দশক। নিষ্পত্তি? হ্যাঁ, রয়াল সোসাইটি বসাল তদন্ত কমিশন। যার সদস্য মনোনীত করলেন নিউটন স্বয়ং। করবেনই তো, তিনি যে সোসাইটির প্রধান। সবচেয়ে বড় স্ক্যান্ডাল এই যে, কমিশনের রিপোর্ট বেনামে লিখলেন নিউটন। সিদ্ধান্ত? কী আবার, এই সারসত্য যে, নিউটনই ক্যালকুলাসের আসল আবিষ্কর্তা। বিজয়ী নিউটন মন্তব্য করলেন, ‘দ্বিতীয় আবিষ্কর্তা মানে লবডঙ্কা।’ এতটাই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে পারতেন তিনি। হয়তো এজন্যই তাঁর সম্পর্কে শেষ কথাটি বলেছিলেন অলডাস হাক্সলি। ‘মানুষ হিসাবে নিউটন হয়তো নেহাতই ব্যর্থ, কিন্তু দানব হিসাবে অসাধারণ, অবিস্মরণীয়।’
তথ্যসূত্রঃ