যাদবপুরের র্যাগিং সংস্কৃতি: মুখে বিপ্লব বুলি, রাত বাড়লেই শুরু দাদাগিরি
Jadavpur University Ragging: বারবার, রোজ রোজ ঘটে এমন ঘটনা। দু-চারদিন আলোচনা হয়, তার পর সেই চর্চায় পলি পড়ে যায়। আবার কোনও স্বপ্নদীপের মৃত্যু তুলে দিয়ে যায় প্রশ্ন, ফের তা ধামাচাপা পড়ে যায়।
গায়ে মফসসলের গন্ধ, সদ্য স্কুল পেরোনো ছেলেটা কলকাতায় এসেছিল এক চোখ স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু কয়েকটা দিন কাটতে না কাটতেই সেই স্বপ্নে পড়ল কাঁটা। বিশ্বমানের কলেজে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে ভর্তি হয়েও পড়া হল না তাঁর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হস্টেল ভবনের তিন তলা থেকে পড়ে মৃত্যু হল প্রথম বর্ষের পড়ুয়া স্বপ্নদীপ কুণ্ডুর। বুধবার রাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলের এ-২ ব্লকে মেলে স্বপ্নদীপের নগ্ন, অচৈতন্য দেহ। শরীরে আঘাতের চিহ্ন, মাথায় ও পাঁজরে চিড়, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি সদ্য আঠেরো পেরোনো ছেলেটিকে। নদিয়ার হাঁসখালি এলাকার বগুলার ছেলে স্বপ্নদীপের মৃত্যুতে তোলপাড় কলকাতা। আত্মহত্যা না খুন, সেই তরজার মধ্যেই সামনে এসেছে ব়্যাগিং তত্ত্ব।
আরও পড়ুন: ছাত্র বলছে, ‘শিক্ষকের কলার ধরতে পারি’, কে এই যাদবপুরের ছাত্রনেতা সঞ্জীব?
বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে ব়্যাগিংয়ের অভিযোগ নতুন নয়। আলাপ-পরিচয়ের নামে কলেজের উঁচু ক্লাসের দাদা-দিদিদের হাতে নিগ্রহের যে ধারাবাহিকতা চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে, তার শেষ কোথায় জানে না কেউ! স্বপ্নদীপ প্রথম নয়, এর আগেও ব়্যাগিংয়ের বলি হতে হয়েছে অনেক পড়ুয়াকেই। দুর্বলকে, সংখ্যালঘুকে কোণঠাসা করার এই ধারাবাহিক প্রথায় একদিন প্রাণ গিয়েছিল রোহিত ভেমুলার মতো উজ্জ্বল পড়ুয়ার। আজ মৃত্যু হল আরও এক স্বপ্নের। রোহিত ভেমুলার ক্ষেত্রে ছিল জাতপাতের সমস্যা, স্বপ্নদীপের ক্ষেত্রে হয়তো অন্য কিছু। মৃত্যুর আগের দিন রাতে বারবার মা-বাবাকে জানিয়েছিল স্বপ্নদীপ, সে ভালো নেই। না, যোজন দূরে বসে থাকা বাবা-মা, পরিবারের কাছে সে ডাক পৌঁছনোর আগেই যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এক কাশ্মীরি পড়ুয়া অনেক চেষ্টা করেও ধরে রাখতে পারেনি স্বপ্নদীপের হাত। ঘামে ভেজা হাত পিছলে তিন তলা থেকে পড়ে যায় বাংলা নিয়ে পড়তে আসা স্বপ্নদীপ। প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই জানান, আগের দিন বারবার সবাইকে সে জানানোর চেষ্টা করেছিল, সে সমকামী নয়।
মুক্ত মানসিকতার পীঠস্থানে পড়তে এসে কেন গলা ফাটিয়ে তাঁকে জানাতে হয়েছিল, সে সমকামী নয়। সমপ্রেম নিয়ে বিভিন্ন আন্দোলনে গলা ফাটিয়েছে যাদবপুরের পড়ুয়ারা। 'হোক কলরব' থেকে 'হোক চুম্বন'-এর মতো একাধিক ছকভাঙা আন্দোলনের জন্ম হয়েছে যে প্রতিষ্ঠান থেকে, সেখানে এসে কেন ব়্যাগিং নামক নোংরা প্রথার মুখোমুখি হতে হল স্বপ্নদীপকে। প্রশ্ন উঠছেই। যেখানে ভর্তি হওয়ার সময় রীতিমতো আইনআদালত করে জমা করতে হয় ব়্যাগিং-বিরোধী হলফনামা, সেখানে ছাত্রসুরক্ষার এতটুকু দায়িত্বটুকু কেন নেবেন না কর্তৃপক্ষ? এই সব প্রশ্নের উত্তর কেন জানিনা বছরের পর বছর ধরে ধাঁধার থেকেও জটিল এবং কঠিন।
দুর্বলের প্রতি ক্ষমতাবানের দাপট, আস্ফালন তো গোটা বিশ্ব জুড়ে কোনও নতুন ঘটনা নয়। সেই ক্ষমতার জোরেই দুর্বল দেশের বিরুদ্ধে হঠাৎ করেই যুদ্ধ ঘোষণা করে দেয় প্রথম বিশ্বের একটি দেশ। সেই ক্ষমতার বলেই মণিপুরে ঘর থেকে বের করে এনে মেয়েদের উপর চলে নির্বিবাদে অত্যাচার। দেশের এখান-ওখান থেকে উঠে আসে দলিত নিগ্রহের খবর, কোথাও উচ্চবর্ণের কলসি থেকে জল খাওয়ার 'অপরাধে' শিক্ষকের হাতে পিটিয়ে খুন হতে হয় বছর সাতেকের খুদে পড়ুয়াকে, কোথাও শ্মশান ব্যবহারের অধিকার মেলে না দলিত, সংখ্যালঘুদের। এ-ও আসলে এক ধরনের ব়্যাগিং। যার শুরুটা হয়ে যায় কখনও বাড়ির দাওয়ায়, কখনও বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
গত বছরও কলেজ হস্টেলের আবাসিক তিন উঁচু ক্লাসের পড়ুয়ার বিরুদ্ধে ব়্যাগিংয়ের অভিযোগ আনেন সুমিত বিশ্বাস নামে এক পড়ুয়া। ঘটনাচক্রে তিনিও ছিলেন বাংলা বিভাগের। একই অভিযোগ ছিল দৃষ্টিহীন দুই পড়ুয়ার। গত বছর অক্টোবরে হস্টেলের ঘরে দেহ মিলেছিল আইআইটি খড়্গপুরের এক পড়ুয়ার। অসমের তিনসুকিয়ার বাসিন্দা বছর তেইশের ফয়জন আহমেদের মৃত্যুর জন্য হস্টেলের ব়্যাগিংকেই দায়ী করেছিল তাঁর পরিবার। এমন নানা ঘটনা কানে আসতেই থাকে আমাদের। দেশের মধ্যে এই ব়্যাগিং সংস্কৃতিতে বেশ এগিয়ে আমাদের রাজ্য।
আসলে কী এই ব়্যাগিং? দুর্বলকে কোণঠাসা করা, নিপীড়ন করার এই যে ধারা, তার শুরু কোথা থেকে। আমরা ব়্যাগিং বলতে সাধারণ ভাবে বুঝি, উঁচু ক্লাসের শিক্ষার্থীদের হাতে নীচু ক্লাসের পড়ুয়াদের নিগ্রহ, হেনস্থা। তা কখনও কখনও সাধারণ মজার সীমাতেই আটকে থাকে, কখনও আবার গন্ডি পেরিয়ে হয়ে ওঠে ভয়ানক। যেমনটা হয়েছে স্বপ্নদীপের সঙ্গে।
ব়্যাগিং সংস্কৃতির আমদানি কিন্তু হাল আমলে নয়। জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম বা অষ্টম শতাব্দী থেকেই চলে আসছে এই ব়্যাগিং নামক প্রথা। একেবারে শুরুতে এই ব়্যাগিং ছিল আদতে গ্রিক সংস্কৃতির অংশ। খেলোয়াড় বা নতুন শিক্ষার্থীরা এলে তাদের উপর প্রয়োগ করা হত এই প্রথা। নতুন সদস্যটির ভিতরে কতটা একতা রয়েছে, কিংবা কতটা টিম স্পিরিট রয়েছে, তা যাচাই করে নেওয়া হত ব়্যাগিংয়ের মাধ্যমে। অনেক ক্ষেত্রে এ-ও মনে করা হত, এর মাধ্যমে তার শারীরিক ও মানসিক শক্তি বাড়বে। প্রবীণেরা মিলে একটু বাজিয়ে দেখতেন নতুন সদস্যটিকে। এর মাধ্যমে নতুন জায়গায় মিলেমিশেও যেত নতুন ব্যক্তি। এক সময়ে সেনাবাহিনীতেও অনুসরণ করা হত এই পদ্ধতি। তবে সেই ব়্যাগিং ব্যাপারটি কবে যে সেই গণ্ডি ছাড়িয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়ল বলা কঠিন। ক্রমে নানা বদলের মধ্যে দিয়ে আসতে আসতে আরও কঠোর, আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে এই ব়্যাগিং সংস্কৃতি। এমনকী তা হয়ে উঠেছে প্রাণঘাতীও।
ভারতে এই সংস্কৃতির প্রবেশ সম্ভবত ব্রিটিশ শক্তির হাত ধরেই। ইংরেজি শিক্ষা ভারতীয় পড়ুয়াদের সামনে যেমন নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল, তার সঙ্গেই নিয়ে এসেছিল ব়্যাগিং সংস্কৃতির মতো খারাপ প্রথাও। সেনাবাহিনী ও ইংরেজি স্কুলগুলিতে হাতেখড়ি হলেও স্বাধীনতাপরবর্তী ভারতে ক্রমাগত ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে এই 'ব়্যাগিং' শব্দটি। আর এর পিছনে শুধুই সংখ্যাগুরুর আগ্রাসনই নয়, বহু সময়েই লুকিয়ে থাকে রাজনীতিও। কলেজ ক্যাম্পাসে যে রাজনীতির খেলা চলে, তার একটা ভয়াল দিক চলে কলেজের হস্টেলে। বহু ক্ষেত্রেই মফস্বল থেকে আসা ছেলেপুলেদের সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কেউ পারেন নিজেকে বাঁচাতে, কারওর পরিণতি হয় স্বপ্নদীপের মতোই।
স্বপ্নদীপের মৃত্যুর দায় বারবার হস্টেলের আবাসিকদের ঘাড়েই চাপিয়েছে তাঁর পরিবার। ইতিমধ্যেই দায়ের করা হয়েছে খুনের মামলা। দফায় দফায় আবাসিক পড়ুয়া ও প্রত্যক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। স্বপ্নদীপের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত দিন তিনেক ধরে কলেজে ক্লাস করেছেন শান্তশিষ্ট স্বপ্নদীপ। বিভাগের অধ্যাপকেরা জানান, সহপাঠীদের সঙ্গে তোলেন ছবিও। মানসিক ভাবে কোনও অস্বাভাবিকতা তাঁর মধ্যে লক্ষ্য করেননি কেউই। তবে হস্টেলে ব়্যাগিংয়ের অভিযোগ মেনেছেন বহু পড়ুয়াই। স্বপ্নদীপের এক সহপাঠী সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাগ করে নেন তাঁর সঙ্গে হওয়া ব়্যাগিংয়ের অভিজ্ঞতা। সংসারে অর্থের টান থাকা সত্ত্বেও তাই বাড়িভাড়া বা মেসভাড়া খুঁজছেন তিনি। যাতে স্বপ্নদীপের মতো পরিণতি তাঁরও না-হয়।
আরও পড়ুন: অম্বিকেশ কার্টুন মামলা খারিজ, ১১ বছর ধরে খেসারতের যে পথ পেরিয়ে এলেন যাদবপুরের অধ্যাপক
বারবার, রোজ রোজ ঘটে এমন ঘটনা। দু-চারদিন আলোচনা হয়, তার পর সেই চর্চায় পলি পড়ে যায়। আবার কোনও স্বপ্নদীপের মৃত্যু তুলে দিয়ে যায় প্রশ্ন, ফের তা ধামাচাপা পড়ে যায়। মেটে না সমস্যা। অর্পন মাঝি নামে স্বপ্নদীপের সেই সহপাঠীর দাবি, কোনও একদিন এই ভয়ঙ্কর প্রথার বিরুদ্ধেও সরব হোক প্রতিবাদের পীঠস্থান যাদবপুর। তারা সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে লড়াই করুক ব়্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে। পড়াশোনা করতে এসে কারওর দশা যেন স্বপ্নদীপ বা রোহিত ভেমুলার মতো না-হয় আর, সেই জায়গাটুকু নিশ্চিত করুক মুক্ত চিন্তার প্রতিষ্ঠান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।