ইউটিউব ভিডিও দেখে UPSC-তে র্যাঙ্ক করাও সম্ভব! বাজিমাত করে দেখালেন তরুণী
UPSC Exam Tips: কোনও কোচিং ছাড়াই UPSC পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তরুণী পাণ্ডে। ২০২১ সালে UPSC পরীক্ষায় মেধাতালিকায় সর্বভারতীয় র্যাঙ্ক অনুযায়ী ১৪তম স্থান পেয়েছেন এই মেয়ে।
ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা UPSC ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ পরীক্ষা পরিচালনা করে, যা UPSC CIVIL SERVICE নামেই পরিচিত। অনেক প্রার্থীই আইএএস (IAS), আইপিএস (IPS) এবং আইএফএস (IFS)– এর জন্য কীভাবে প্রস্তুতি শুরু করবেন তাই নিয়ে বিভ্রান্ত হন। এমনটা কখনই দাবি করা যায় না যে, কেবলমাত্র একবারের চেষ্টাতেই এই কঠিন পরীক্ষা উত্তীর্ণ হওয়া যায়। তবে হ্যাঁ, বহু মানুষই নিজেই শৃঙ্খলাপরায়ণ পদ্ধতিতে কঠিন পরীক্ষায় সহজেই উত্তীর্ণ হয়েছেন এমন উদাহরণও কিন্তু রয়েছে। ভারত তথা গোটা বিশ্বের অন্যতম কঠিন পরীক্ষাগুলির মধ্যে একটি ইউপিএসসি। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পরীক্ষার্থী এই পরীক্ষায় বসেন, তবে মাত্র কয়েকজনেরই স্বপ্ন পূরণ হয়।
সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেশের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পরীক্ষাগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হওয়ায় কিছু পরীক্ষার্থীই প্রথম প্রচেষ্টায় এই পরীক্ষায় সফল হন। তবে দেখা যায়, অনেক পরীক্ষার্থী লাগাতার প্রচেষ্টা চালিয়ে অবশেষে সাফল্যের স্বাদ পান। এমনই কঠিন এই পরীক্ষা। আর এবার এই পরীক্ষায় সাফল্য অর্জন করলেন ঝাড়খণ্ডের ৩২ বছর বয়সী তরুণী পাণ্ডে। রিপোর্ট অনুযায়ী, তিনি প্রথম চেষ্টাতেই এই সাফল্য অর্জন করে এক অবাক করা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
কোনও কোচিং ছাড়াই UPSC পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তরুণী পাণ্ডে। ২০২১ সালে UPSC পরীক্ষায় মেধাতালিকায় সর্বভারতীয় র্যাঙ্ক অনুযায়ী ১৪তম স্থান পেয়েছেন এই মেয়ে। শুধু তাই নয়, হয়েছেন একজন সফল IAS অফিসার। কিন্তু তরুণীর জীবন জয়ের গল্প আর পাঁচজন আইএএস অফিসারের থেকে অনেকটাই আলাদা। জানা যাক তাঁর সাফল্যের কাহিনি।
আরও পড়ুন- আর কিছুদিনেই পরিত্যক্ত নগরী হতে চলেছে রাজধানী দিল্লি! বিষের বাষ্পে যে ইঙ্গিত
ঝাড়খণ্ডের জামতারার বাসিন্দা তরুণী পাণ্ডে। যদিও তাঁর বেড়ে ওঠা পশ্চিমবঙ্গের চিত্তরঞ্জনে। এখানেই কেজি থেকে শুরু করে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তারপর বাবার বদলি হলে চলে যান ঝাড়খণ্ডে। সেখানেই দ্বাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা শুরু করেন। তরুণীর কথায়, ছোট থেকেই তিনি ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। আর নোটপ্যাডে ‘ডঃ তরুণী পাণ্ডে’ নামে সই করার স্বপ্ন দেখতেন। দ্বাদশ শ্রেশির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনা করতে সিকিম চলে যান।
তরুণীর কথায়, “মেডিসিন নিয়ে পড়ার আমার বরাবরের ইচ্ছে। আমার পরিবার আমাকে বাধা দেয়নি। আমি পড়াশোনাতেও খুব ভালো ছিলাম। মেডিকেলের পড়াও আমি খুব ভালোভাবে করেছি।” কিন্তু সিকিমে মেডিকেল পড়াকালীন তাঁর জীবনে নেমে আসে একের পর এক দুর্যোগ যা তাঁর ডাক্তারি পড়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সিকিমে থাকাকালীন স্বাস্থ্য মাঝে মাঝেই খারাপ হতে থাকে তরুণীর। কোনও স্থায়ী রোগ নয়। হঠাৎ হঠাৎ করে এসে পড়ত রোগ। প্রথমে ডেঙ্গু, তারপর টাইফয়েড এবং শেষে সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন তিনি। এরসঙ্গেই একদিন সিকিমের পাহাড় থেকে পিছলেও পড়ে যান তিনি। তারপরেই তাঁর ডাক্তারি পড়ায় ইতি টানা হয়। ঝাড়খণ্ডে ফিরে আসেন তরুণী।
বিপদ এখানেই বিদায় নেয়নি। ২০১৬ সালে বাড়ি ফেরার কিছুদিনের মধ্যে তাঁর পরিবারের কাছে খবর আসে, শ্রীনগরে শহিদ হয়েছেন তাঁদের এক আত্মীয়। এরপর শুরু হল তাঁর বোনের সঙ্গে আরেক যুদ্ধ। বিভিন্ন সরকারি অফিস এবং আমলাদের কাছে তরুণী এবং তাঁর বোনকে ছুটোছুটি করতে হয়েছিল সেই সময়। এই ছুটোছুটি করতে গিয়েই তিনি নিজের ‘প্যাশন’ আরেকবার খুঁজে পান।
তরুণীর কথায়, যদি এক দশক আগেও তাঁকে কেউ জিজ্ঞেস করত তিনি কী হতে চান, তাহলে বলতেন, ডাক্তার। কিন্তু ২০১৬ সালের ঘটনা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। “যখন আমি আমার বোনের সঙ্গে এই আমলাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, আমি দেখছিলাম তাঁরা কতটা ভাল কাজ করেন। আমি বুঝতে পেরেছি, সিস্টেমে থাকার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি কতটা ভাল করতে পারে। সেই দিনই, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমিও একজন সরকারি কর্মচারী হতে চাই এবং কারও পরিবারকে সাহায্য করতে চাই, যেভাবে সকলে আমাকে সাহায্য করেছিলেন।”
এরপর শুরু হয় প্রস্তুতি। কিন্তু আবার এল বাধা। ২০২০ সালে ইউপিএসসি পরীক্ষার ৪ দিন আগে তিনি কোভিড আক্রান্ত হন। এরপর তিনি আবার ২০২১ সালে এই পরীক্ষা দেন এবং তিনি জানতেন এটাই তাঁর প্রথম ও শেষ প্রচেষ্টা (জেনারেল ক্যাটাগরির বয়স অনুযায়ী)। “COVID-এর প্রথম আক্রমণ আমাকে সত্যিই কঠিনভাবে আঘাত করেছিল। প্রায় চার মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। পরের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য আমার হাতে বাকি ছিল মাত্র ছয় মাস, তাই অনেকটাই চাপ ছিল,” জানান তরুণী।
তরুণী CSE মেইনস ২০২১-এ ১৪ তম স্থান অর্জন করেছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়, যা তাঁর জয়কে আরও বিশেষ করে তুলেছে তা হল, তিনি কোনও কোচিং ক্লাসে যোগ দেননি৷ তরুণী কেজি থেকে মেডিকেল পড়া অবধি কোনওদিন কারও কাছেই কোচিং নেননি। তাই ইউপিএসসি দেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি সেই পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন। “আমাকে আমার প্রিলিমের জন্য মাত্র চার মাসের মধ্যে প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল। আমি সৎভাবে বিশ্বাস করি, সাধারণ পরিস্থিতিতে একজন ব্যক্তির কমপক্ষে দুই বছর UPSC-এর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। যেহেতু আমার কাছে আর অন্য কোনও চয়েস ছিল না, তাই আমাকে পরীক্ষা পাস করার জন্য অতি স্মার্ট কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল৷ আমি YouTube ভিডিও দেখে আমার নোট প্রস্তুত করতাম। আমি স্ট্যান্ডার্ড বইও পড়িনি কারণ আমার কাছে সেই সময় ছিল না।”
তিনি আরও জানিয়েছেন, তাঁর প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষা তাঁকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছিল। “যেহেতু আমার পড়াশোনা বিজ্ঞান নিয়ে, তাই বিজ্ঞান এবং বাস্তুবিদ্যা আমার জন্য অনেকটা সহজ ছিল। কিন্তু অর্থনীতি এবং রাজনীতি সেই অর্থে কঠিন ছিল, তাই আমাকে তাদের উপর ফোকাস করতে হয়েছিল বেশি,” বলছেন তরুণী।
আরও পড়ুন- চার পায়ে হাঁটা থেকে কাঁচা মাংস খাওয়া, কেমন ছিল বাস্তবের মোগলি
ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসের (IFS) অংশ হতে চান তরুণী এবং অন্যান্য প্রার্থীদের সাহায্য করতে বেশি কিছু টিপসও দিয়েছেন:
১. সৎ হও
“আমি অনেক মানুষকে পেয়েছি যাঁরা পরীক্ষায় যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন কিন্তু ইন্টারভিউ ক্লিয়ার করেননি। ইন্টারভিউতে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কেন ইউপিএসসিতে যোগ দিতে চাই, তার জন্য অনেকেই কারণ হিসেবে বলেছেন অর্থ, ক্ষমতা, বড় বাংলো ইত্যাদি আরও অনেক কিছু।” তরুণীর কথায়, এইসব কারণগুলি পরিষেবাতে যোগদানের প্রধান কারণ হওয়া উচিত নয়৷ “আপনি যদি সমাজের জন্য ভালো কিছু করতে চান তবেই অনুগ্রহ করে যোগ দিন,” জানান তিনি।
২. আশা হারাবেন না
“আমি জীবনে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি। একটিই জিনিস যা আমাকে সাহায্য করেছে তা হল লক্ষ্যে অবিচল থাকা। এমনকী যদি আপনি প্রথম প্রচেষ্টায় উত্তীর্ণ নাও হন, আশা হারাবেন না চেষ্টা চালিয়ে যান।”
৩. কোচিংয়ের দরকার নেই
তিনি বলেন, “একটি মিথ প্রচলিত আছে যে ইউপিএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য কোচিং বাধ্যতামূলক, অথবা কোচিং ছাড়া মানুষ পাস করতে পারে না। আমরা ডিজিটাল যুগে বাস করি, আমাদের হাতে অনেক বিনামূল্যের সম্পদ রয়েছে। তাদের ব্যবহার করা শুরু করুন।”
৪. ইংরেজি কোনও বাধা নয়
“আমি একটি ছোট শহর থেকে এসেছি। আমার মতো অনেক শহরে ইংরেজি একটি বাধা হিসাবে বিবেচিত হয়। বিশ্বাস করুন, আপনি ২২ টি ভাষায় UPSC পরীক্ষা দিতে পারেন। ইংরেজি যে স্ট্যাটাস বা শিক্ষার চিহ্ন নয় মানুষকে সেই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে,” জোর দিয়ে জানান তরুণী।