৫ মাসের শিশুর লাশ ব্যাগে ঝুলিয়ে ফিরছে বাবা! বাংলায় পরিযায়ী শ্রমিকরা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে

Kaliaganj Child Death: অভাব রাজ্যের সীমানা ঘুচিয়ে দেয়। অভাব এরাজ্যের বাবার সঙ্গে অন্য রাজ্যের বাবাকে এক পংক্তিতে দাঁড় করিয়ে দেয়।

নতুন নয়, তবু প্রতিবারই নতুন, প্রতিবারই নির্মম। সময় বদলে বদলে, চরিত্র বদলে বদলে ঘটনা একই থেকে যায় যুগের পর যুগ। কখনও মৃত স্ত্রীর লাশ কাঁধে, কখনও মৃত বাবার দেহ বাঁশে বেঁধে ভারতের শ্রমিক, দরিদ্র নাগরিকদের একরাজ্য থেকে অন্যত্র, এক জেলা থেকে অন্যত্র হেঁটে যেতে হয়, হেঁটে যেতে হবে। কারণ, সরকার অ্যাম্বুলেন্স দিতে অপারগ, স্বাস্থ্য পরিষেবায় সকলের জন্য সমান সুযোগ অপ্রতুল। তাই পাঁচ মাসের ছোট্ট সন্তানের দেহ ব্যাগে ভরে, হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে যেতে হয় বাবাকে। তাও টোটো, বাসে চেপে, ছেলের লাশ বয়ে নিয়ে যেতে হয় ২০০ কিলোমিটার পথ! উত্তর দিনাজপুরের পরিযায়ী শ্রমিকের এই ঘটনা প্রশ্ন তোলে, কলমে ফোয়ারা তোলে, তারপর সপ্তাহখানেক যেতে না যেতেই অন্তরালেও যায়। পাঁচ মাসের সন্তানের দেহ যতটা ভারী, তার চেয়ে ঢের ভারী এই দৃশ্যের ভার। অ্যাম্বুলেন্সের টাকা মেটাতে না পারলে এভাবেই তো নিয়ে যেতে হয় লাশ, এটাই তো দস্তুর!

উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে চাপার পয়সা না থাকলে রাজ্যের (দেশেরও) দরিদ্র মানুষের মরার পরে অত আরাম জোটে না। উত্তর দিনাজপুরের ডাঙ্গিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা অসীম দেবশর্মা পেশায় পরিযায়ী শ্রমিক। কেরলে নির্মাণকার্যের শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তিনি। পাঁচ মাস আগে তাঁর স্ত্রী যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে। ৬ মে দুই শিশুই অসুস্থ হয়ে পড়লে পরের দিনই কালিয়াগঞ্জের স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে সন্তানদের। দু'জনকেই রায়গঞ্জ সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে রেফার করা হয়। চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে জানান, খাদ্যনালিতে সমস্যা রয়েছে দুইজনেরই। সেখান থেকে ফের উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে (এনবিএমসিএইচ) তাঁদের নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। শিলিগুড়ির উপকণ্ঠে সুশ্রুতনগরে অবস্থিত, NBMCH উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম রাজ্য-চালিত রেফারেল হাসপাতাল।

আরও পড়ুন- ৭৫ বছরে একটি মাত্র আইন, ‘অমৃতকালে’ও পরিযায়ী শ্রমিকদের পায়ে পরাধীনতার বেড়ি

৭ মে মেয়ের অবস্থার উন্নতি হলে অসীমের স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। অসীম থেকে যান হাসপাতালেই, তাঁর ছেলের সঙ্কট তখনও কাটেনি। কাটেও না। মৃত্যু হয় ওই শিশুর। অসীম জানিয়েছিলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে জানায়, তিন ঘণ্টার মধ্যে ছেলের লাশ নিয়ে যেতে হবে। অ্যাম্বুলেন্স খুঁজতে থাকেন তিনি। জাতীয় অ্যাম্বুলেন্স হেল্পলাইন ১০২-এ ফোনও করেন। অসীম যা জানতে পারলেন তা হচ্ছে, বিনামূল্যের কোনও অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না। পকেটের সাধ্য নেই, তবু বাধ্য হয়েই NBMCH-এর কাছেই খোঁজ নিয়ে বেসরকারি কিছু অ্যাম্বুলেন্স চালকের সঙ্গে কথা বললেন। ৮,০০০ টাকা চায় সেই বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স। ৮,০০০! কোথায় পাবেন! দর কষাকষিতে হেরে যান শ্রমিক অসীম দেবশর্মা। সন্তান, যে ততক্ষণে স্রেফ লাশ হয়ে গিয়েছে তাঁর ছোট্ট দেহ অগত্যা ভরে নিলেন সেই ব্যাগে যে ব্যাগে জামাকাপড় নিয়ে যাচ্ছিলেন অসীম।

টোটো নিয়ে শিলিগুড়ির প্রাইভেট বাসস্ট্যান্ডে যান। সেখান থেকে রায়গঞ্জগামী বাসে ওঠেন। পাছে কেউ জেনে যায় ব্যাগে মৃতদেহ আছে তাই ভয়ে ভয়ে ব্যাগটি আসনের নীচে পায়ের ফাঁকে লুকিয়ে রাখেন। আর এই পুরোটা পথ নিজের ছোট্ট সন্তানের দেহ বয়ে নিয়ে যাওয়ার পাথর আটকে রাখেন গলার কাছে। কোনওদিন পৃথিবীর কোনও শব্দে সেই অনুভূতি লেখা সম্ভব নয়। রায়গঞ্জে নেমে কালিয়াগঞ্জ যাওয়ার জন্য আরেকটি বাসে ওঠেন অসীম। সেখানে এক আত্মীয়কে খবর দিয়ে রেখেছিলেন। কালিয়াগঞ্জ থেকে তাঁর গ্রামে যাওয়ার জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১২ কিলোমিটারের পথ মাত্র। তার আগের লম্বা সফর সন্তানের লাশ ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছেন বাবা অসীম দেবশর্মা। কালিয়াগঞ্জ পৌরসভা থেকে ব্যবস্থা করা হয়েছিল অ্যাম্বুলেন্সের। স্থানীয় ব্লক অফিস পরিবারকে ২০০০ টাকা দিয়েছে 'সমব্যথী' প্রকল্পে। শেষকৃত্যের জন্য অর্থ দেওয়া হয় এই প্রকল্পে। সন্তান হারা বাবা, যাকে ৫ মাসের সন্তানের লাশ ব্যাগে বয়ে আনতে হয়, তাঁর 'সমব্যথী' হওয়া সম্ভব কিনা প্রশাসন জানে না। শুধু দেশের নাগরিকদের একাংশ (বড় অংশ) জানে, আজ কালিয়াগঞ্জ হলে কাল নাগপুর, কাল নাগপুর হলে পরশু উত্তরপ্রদেশ। কালিয়াগঞ্জেরই পাশে তাই কয়েক ঘণ্টার পরেই উঠে এল মধ্যপ্রদেশের শাহদোল। কন্যার মৃতদেহ বাইকে চাপিয়ে ফিরলেন বাবা।

আরও পড়ুন- রোগে অনটনে জেরবার! চাকরি চেয়ে যে অবাক করা চিঠি লিখেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়…

মৃত মেয়ের জন্য শববাহী গাড়ি মেলেনি। কারণ? কারণ আপামর দরিদ্রের যা হয়, একই! টাকা নেই, তাই বেঁচে থাকতে খাবার জোটে না, শিক্ষা বা আশ্রয় জোটে না। মরে গেলে অ্যাম্বুলেন্স জোটে না, শববাহী যান জোটে না। তাই মৃত কন্যার দেহ মোটরবাইকে চাপিয়েই বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন লক্ষ্মণ সিংহ। মধ্যপ্রদেশের শাহদোল থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরের কোটা গ্রামের বাসিন্দা লক্ষণের ১৩ বছরের কন্যা মাধুরী সিকেল সেল অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত হয়। শাহদোলের এক সরকারি হাসপাতালে মেয়েকে ভর্তি করিয়েছিলেন বাবা। হাসপাতালেই মৃত্যু হয় মেয়ের। দেহ বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে অ্যাম্বুলেন্স চেয়েছিলেন লক্ষ্মণ। লক্ষণের বাড়ি হাসপাতাল থেকে ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে না হওয়ায় তাঁকে অ্যাম্বুল্যান্স দিতে রাজি হয়নি কর্তৃপক্ষ। শববাহী যানে মৃতদেহ চাপানোর সামর্থ নেই। ফলে মোটরবাইকেই মৃত মেয়েকে ঝুলিয়ে...

বাড়ির প্রায় অনেকটা কাছে আসার পর জেলাশাসক মেয়ের দেহ বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি গাড়ির ব্যবস্থা করে দেন। তবে সেই গাড়িতে মৃতের শরীর হালকা হয়ে যায়। যাবতীয় গ্লানির ভার এসে পড়ে কালিয়াগঞ্জের বাবা আর শাহদোলের বাবার হাতে, কাঁধে, সারা দেহে। অভাব রাজ্যের সীমানা ঘুচিয়ে দেয়। অভাব এরাজ্যের বাবার সঙ্গে অন্য রাজ্যের বাবাকে এক পংক্তিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। সন্তানদের বয়স পাঁচ মাস হোক বা ১৩ বছর লাশের ভার একই।

More Articles