বাংলাদেশ নিজের জায়গা ধরে রাখতে পেরেছে; পশ্চিমবঙ্গ পারেনি : কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়
Kamaleshwar Mukhopadhyay Interview : মানুষের যে কোনও ছবি যে কোনও সময় না-ই ভালো লাগতে পারে। তার মানে কিন্তু ছবিটা ভালো নয়, এমন নয়।
সিনেমা এখন কাদের জন্য তৈরি হয়? সিরিজ সিনেমাতেই বা কাদের কথা উঠে আসে? দেশের অন্য রাজ্যে, বা বিদেশের সোজা সাপটা বক্তব্য, রাজনৈতিক অভিমুখওয়ালা সিনেমা নিয়ে চর্চা হয়। বাংলা থেকে কেন এমন সিনেমা-সিরিজ উঠে আসে না? বাংলা কি ভয় পায়? বাঙালি কি ভয় পায় স্পষ্ট বলতে? তাহলে আর্ট শেষমেশ 'আর্ট' হয়েই থাকবে? কমলেশ্বর দ্বন্দ্বে বাঁচেন, দ্বন্দ্বমূলক চর্চা থেকেই দেখেন সিনেমাকে, চারপাশকেও। কোন ভয় ঠিক বাঙালিকে খেয়ে ফেলল স্পষ্টবাদী হতে, উত্তর খুঁজে পেয়েছেন এই দ্বন্দ্বেই। আগামী সিনেমা 'একটু সরে বসুন' থেকে শুরু করে বাংলার মেরুদণ্ড সব নিয়ে কথাবার্তায় পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। ইনস্ক্রিপ্টের হয়ে কথা বললেন রণদীপ নস্কর।
প্র: ‘একটু সরে বসুন’ থেকে মানুষ কী প্রত্যাশা করতে পারে? বনফুলের ছোটগল্পটি বহুপঠিত, তা থেকে সিনেমা তৈরি হলে মানুষের আগ্রহ থাকবেই— সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ‘একটু সরে বসুন’ দর্শকদের নতুন কী দেবে?
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়: বনফুলের গল্পটি রম্যরচনা ছিল, সিনেমাটিও মজার। কিন্তু এটা শুধুই মজা নয়, তাই সোশ্যাল কমেডি বলছি। এখানে সামাজিক কিছু মন্তব্য রয়েছে, যাকে আমরা সোশ্যাল কমেন্টস বলি। সেটা অবশ্যই এসেছে স্যাটায়ার ফর্মে। অনেকগুলো উপাদান আছে তো কমেডির— সবক’টাই এই ছবিতে কোথাও না কোথাও আছে। কখনও হিউমার, কখনও উইট আবার কখনও বা সিম্পল স্যাটায়ার।
প্র: শেষ কয়েক বছরে ‘ককপিট’, ‘পাসওয়ার্ড’, ‘অ্যামাজন অভিযান’ থেকে শুরু করে ‘গুডনাইট সিটি’, ‘দ্য হাঙ্গার আর্টিস্ট’, ‘অনুসন্ধান’ এই সিনেমাগুলো করেছেন। অ্যাডভেঞ্চারধর্মী ছবি, টেক-থ্রিলার, ক্রাইম থ্রিলারের পর ‘একটু সরে বসুন’ করলেন। এই জঁরগুলোর থেকে এটা সম্পূর্ণ আলাদা। হঠাৎ এই জঁরে কাজ করার ইচ্ছা কেন?
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়: বানানোর চেষ্টা করেছি, বানিয়েছি বলব না। দুটো কারণ বলতে পারি এই জঁরে আসার এবং এই ছবিটি করার। আমি বিভিন্ন ধরনের ফর্মে কাজ করার চেষ্টা করেছি। এই ফর্মে আগে কাজ করা হয়নি, এই ভাবনা থেকে কমেডি ছবি বানানো। আর দ্বিতীয়ত, চারপাশে যা চলছে, তা দেখে হাসি পাচ্ছে। আমার ধারণা, আমার একার নয়, সকলেরই হাসি পাচ্ছে। সেই হাসিগুলো এক জায়গায় এনে একটা ছবি বানানো।
প্র: আপনি দীর্ঘদিন ধরে সিনেমা করছেন, ‘মেঘে ঢাকা তারা হোক’, ‘ক্ষত’ হোক; শেষ কয়েক বছরের সিনেমা তো বললামই। তবু কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় বললেই বহু মানুষ এখনও ‘চাঁদের পাহাড়’-ই ভাবেন। কেন?
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়: কারণ, ‘চাঁদের পাহাড়’ এবং ‘অ্যামাজন অভিযান’— এই দুটোই খুব জনপ্রিয় ছবি। বিদেশ-টিদেশে শ্যুট; গ্ল্যামার কোশেন্ট হিসেবে দেব রয়েছে; আবার বিভূতিভূষণের রচনা। এসবের জন্যই এই দুটো ছবির কথা আসে। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে আমাদের মধ্যে মানি-মাইন্ডেডনেস ভীষণ বেড়ে গেছে। এই দুটো ছবি একটু ব্যবসা-ট্যবসা করেছে তো, তাই আলোচনায় আসে; বাকি ছবিগুলো অতটা করতে পারেনি, কাজেই এতটা আলোচিত নয়।
প্র: ফিল্ম স্টাডিজের ক্লাসে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ বা ‘হাঙ্গার আর্টিস্ট’ নিয়ে কথা হয়। কিন্তু দর্শকদের একটা বড় অংশ এখনও... হতাশ লাগে কখনও?
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়: হতাশ বলব না। আমরা তো এই সামাজিক বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছি। শুধুই মেঘে ঢাকা তারা-র জঁরে যদি পরের পর ছবি করতাম, তাহলে হয়তো সিনেমার ন্যূনতম পপুলিজমের জায়গা থেকে সরে যেতাম। তা তো হয়নি, কাজেই হতাশ লাগে না। আমার একটা অনুসন্ধিৎসা আছে। খুঁজে বার করার নেশা আছে। ধরা যাক, একটা সিনেমা জনপ্রিয় হচ্ছে— কেন হচ্ছে? ধরা যাক ‘শোলে’, কেন জনপ্রিয় হচ্ছে? ‘অ্যালবার্ট পিন্টো কো গুসসা কিঁউ আতা হ্যায়’ ভালো ছবি, কিন্তু জনপ্রিয় হচ্ছে না। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর ফিল্মমেকার, ফিল্ম স্টাডিজের লোকজন, সেমিওলজিস্টদের খুঁজে বার করার একটা প্রচেষ্টা আছে। আমারও আছে। তাই নানা ধরনের ছবি করি, দেখা যাক না কোনটা কাজ করে। কারণ যে কোনও শিল্পের ক্ষেত্রেই কোনও ফর্মুলাই চিরন্তন বা শাশ্বত নয়; মানুষের যে কোনও ছবি যে কোনও সময় না-ই ভালো লাগতে পারে। তার মানে কিন্তু ছবিটা ভালো নয়, এমন নয়।
প্র: 'মানি-মাইন্ডেড' শব্দটা বললেন। এই বছর পুজোয় কোন বাংলা ছবি কত টাকার ব্যবসা করেছে, তার একটা হিসেব কাগজে বেরিয়েছে। সমস্ত কিছুকে সংখ্যায় নামিয়ে আনা হয়েছে। ‘জওয়ান’ ছবি হিসেবে কেমন সেই আলোচনা গৌণ হয়ে তা কত টাকার ব্যবসা করল সেইটা মুখ্য হয়ে উঠছে। এই প্রবণতা কি সার্বিকভাবে একটি সিনেমার আলোচনা-সমালোচনার ক্ষেত্রটিকেই পিছিয়ে দিচ্ছে না?
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়: একদম, একদম! খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা এটা। ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশনের ক্ষেত্রে কোয়ান্টিটি ম্যাটার করছে; কোয়ালিটি নয়। আমি বলছি না পপুলার ছবির কোনও কোয়ালিটি নেই, খুব ভালো ছবিও অনেকক্ষেত্রেই জনপ্রিয় হয়েছে; সেখানে জরুরি অনেক কথাও বলা হয়েছে। সেই ফর্ম আর কনটেন্টকেই ছবির মাপকাঠি করলে ভালো হয়। অবশ্য জেমস মোনাকো তো ‘হাউ টু রিড আ ফিল্ম’-এ বলেই গেছেন: There are three aspects of a film: 1. Science of films— the entire technological aspects of a film; 2. Art of film— how you are telling your story and how you are engaging your audience; আর তিন নম্বর কিন্তু Commerce of film। সিনেমা জিনিসটা যতই স্বাধীনভাবে করা হোক না কেন, করতে তো কিছু টাকাপয়সা খরচ হয়; এই মাধ্যমটা ঠিক সাহিত্য-ফটোগ্রাফি-পেন্টিংয়ের মতো নয়। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, ফিল্ম একটা কালেক্টিভ আর্ট। স্বাভাবিকভাবেই এখানে অনেক টাকা লগ্নি হবে এবং তা ফেরত আনার প্রশ্নও উঠবে; কাজেই একটা কমার্শিয়াল আসপেক্ট থাকবেই। কিন্তু আমরা যদি গ্রেট মাস্টারদের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব ছবির ব্যবসায়িক দিক মাথায় রেখে তাঁরা কিন্তু কাজ শুরু করেননি। হয়তো সিনেমা মুক্তির পর তা হিট করেছে, অনেক বিক্রি হয়েছে— তখন টাকাপয়সার প্রসঙ্গ এসেছে। আবার পৃথিবীর ইতিহাসে কিছু মাইলস্টোন ছবি আছে, যেগুলো একেবারেই টাকাপয়সা রোজগার করতে পারেনি। কাজেই ছবিকে ‘মাপা’-র ক্ষেত্রে কিন্তু সায়েন্স অফ ফিল্ম বা আর্ট অফ ফিল্মটা খুব জরুরি; রাদার দ্যান কমার্স অফ ফিল্ম।
একটা খুব অদ্ভুত বিষয় আমার চোখে পড়ে! আর্ট অফ ফিল্মকে ছেড়ে দিলাম, শিল্পকে তো আর কোয়ান্টিফাই করা যায় না; কিন্তু যাকে কোয়ান্টিফাই করা যায় অথচ আমরা খুব মনোযোগ দিই না, তা হচ্ছে সায়েন্স অফ ফিল্ম। বিভিন্ন সমালোচনামূলক লেখাতেও এর বিশেষ উল্লেখ পাই না। সেলুলয়েড থেকে ডিজিটাল ইমেজ আসার পর একটা অন্য ভাষা তৈরি হলো; ডিজিটাল সাউন্ডট্র্যাক তৈরি হওয়ার পর সাউন্ডের ভাষাটা পাল্টে গেল, মিউজিকও বদলে গেল। এখন এসেছে কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজ, বা সিজিআই। কালার গ্রেডিং বদলে গেল। আগে আমরা RGB (রেড, গ্রিন, ব্লু) ধরে কালার গ্রেড করতাম; এখন প্রত্যেকটা রঙ ধরে ধরে, আলাদা আলাদা জায়গা সিলেক্ট করে কালার গ্রেড করা যায়। এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, তাদের প্রভাব নিয়ে বিশেষ কথা হয় না। কাজেই সায়েন্স অফ ফিল্ম, আর্টস অফ ফিল্ম— এগুলো চাপা পড়ে কেবলই কমার্স অফ ফিল্ম নিয়ে কথা হচ্ছে, এটা কাম্য নয় বলেই আমার মনে হয়। যদি ব্যবসা মাথায় রেখে একটা বিল্ডিং ডিজাইন করি, তাহলে তার আর্কিটেকচারাল স্প্লেন্ডার নষ্ট হয়। রোমের কলোসিয়াম বা সিস্টিন চ্যাপেল যদি আগে থেকে বাজেট করে বানানো শুরু হতো, তাহলে মাইকেলেঞ্জেলোকে ডাকা হতো না আঁকার জন্য। পৃথিবীই বঞ্চিত হতো একটা উচ্চমানের শিল্প থেকে।
প্র: বাজার একটা 'ট্রেন্ড' তৈরি করেছে। মানুষ দেখছে কোন ধরনের ফিল্ম-সিরিজ বানালে বা বই লিখলে একটু দ্রুত অর্থোপার্জন সম্ভব। গত চার-পাঁচ বছরে তাই হরর এবং কমেডি বানানোর 'ট্রেন্ড' জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু এত 'হরর' সত্ত্বেও ‘তুম্বাড়’-এর মতো ছবি হচ্ছে না। ‘তুম্বাড়’ যেমন রাজনৈতিকভাবে সচেতন, ক্রাফটের দিক থেকে অসামান্য…
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়: (থামিয়ে) এখানে একটা কথা বলি। রাজনীতি সারা পৃথিবীতেই আছে, হলিউডও তার বাইরে নয়। কিন্তু আমাদের এখানে একটা বিষয় আছে, তা বারবার আলোচিতও হয়, শিল্পীর অনিরাপত্তা। একজন শিল্পীর যদি নিরাপত্তার অভাব হয়, শুধু শারীরিক বা সামাজিক নিরাপত্তা বলছি না, অর্থনৈতিক নিরাপত্তারও অভাব হয়; তাহলে যে আর্ট ফর্মেই তিনি কাজ করুন না কেন, তিনি চেষ্টা করেন একটা 'স্টেটাস ক্যো' মেনে চলার। ভেঙেচুরে নতুন কিছু করার ভাবনাটা তাঁর মধ্যে থাকে না। তিনি ভয় পান। শিল্পের যে কোনও ফর্মের সঙ্গেই সাহস বিষয়টা সাংঘাতিকভাবে জড়িয়ে। রাজনৈতিক ছবির কথা উঠল যখন, আমরা মনে করতে পারি ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’-এর কথা। ১৯০৫-এর নৌ-বিদ্রোহ নিয়ে ওই সময়ে ওই ভাবে ছবিটা বানানো যথেষ্ট সাহসের কাজ, তাই না?
চ্যাপলিন ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ বানাচ্ছেন, সেটাও যথেষ্ট সাহসি কাজ। এদেশে সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল নিয়ে সবসময় আলোচনা হয়, বাকিদের কথা একটু বলি। বিমল রায় ‘উদয়ের পথে’ করছেন, নিমাই ঘোষ ‘ছিন্নমূল’ করছেন— তার মধ্যে সরাসরি রাজনীতি আসছে। এগুলো তো সব মাইলস্টোন ছবি। এই ছবিগুলো তৈরি হচ্ছিল মানে— শিল্পীর মনন সমাজের বিভিন্ন নীতি এবং প্রথাকে বারবার প্রশ্ন করছিল। শুধু যে রাজনৈতিক দলকে প্রশ্ন করা তা নয়, একটা নীতি কারও পছন্দ হয়নি বা অর্থনৈতিক পদক্ষেপ মনঃপূত হয়নি— সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হতো। কিন্তু সেটা ততক্ষণই বলতে পারব, যতক্ষণ আমি মনের মধ্যে নিরাপদ; আমার সাহস আছে। যে মুহূর্তে সেই নিরাপত্তার অভাব অনুভূত হবে, আমি মেপে কথা বলা শুরু করব। আর মেপে কথা বললে তো স্বতঃস্ফূর্ততা চলে যাবেই। পরিমিতভাবে কথা বললে স্বাভাবিকভাবেই আমি রাজনৈতিক প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব কারণ যদি রাজনৈতিক কথা সোচ্চারে বলি, তাহলে কেউ না কেউ তো আমার শত্রু হবেই।
আমি তো ব্যক্তিগতভাবে খুব রাজনৈতিক একজন মানুষ। কই, আমার আশেপাশে বিরোধী মতাদর্শের যাঁরা রয়েছেন, আমার সঙ্গে তো তাঁদের সম্পর্ক খারাপ হয়নি! রাজনৈতিক দর্শন তো কোনও ব্যক্তিগত বিষয় নয়। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া, পড়াশোনা করা, মানুষের সঙ্গে মেশা, পারিবারিক প্রভাব— সব কিছু মিলিয়ে রাজনৈতিক দর্শন তৈরি হয়। সেই দর্শন অনুযায়ী কেউ নিজের জীবনধারণের ধারাটি ঠিক করেন। সেই জায়গাটা যদি ঠিক রাখা যায়, তাহলে নিজেকে এত ‘অনিরাপদ’ ভাবার কারণ দেখি না। হ্যাঁ, 'অপাংক্তেয়' হওয়ার চিন্তা আসে বটে, আমারও আসে, নিশ্চয়ই আমার বিরুদ্ধ মতাদর্শের লোকেদেরও আসে। মনে হয় যে, আমার ভাবনার সঙ্গে বাকিটা মিলছে না। সেটা তো পরিবারেও হয়, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গেও হয়; সর্বত্র হয়। সেটা ভেবে তো আর নিজের মত পোষণ করব কী করব না তা ঠিক করা যায় না। আমার মনে হয় না, বাংলার মানুষ যতটা ভাবেন, আদৌ ততটা নিরাপত্তার অভাব আছে বলে। জওয়ান-এর উদাহরণ দিয়েই বলি। জওয়ান যে প্রসঙ্গগুলো তুলে এনেছে, তার জন্য কি শাহরুখ খানের জনপ্রিয়তা কমেছে? আমার তো মনে হয় বেড়েছে। আসলে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা সবাই অর্থনৈতিকভাবে অনিরাপদ জায়গায় রয়েছি। যদি ছবি ভালো চলত, হলের সংখ্যা বাড়ত, লগ্নি ভালো হতো— তাহলে এত চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন ছিল না। এটা শুধু অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইতে এসে দাঁড়িয়েছে।
প্র: এখনকার কমেডি ছবিগুলোও ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ বা ‘মৌচাক’-এর মতো সামাজিক ধারাভাষ্য দিতে পারছে না বলে অভিযোগ ওঠে। অধিকাংশক্ষেত্রে 'কমেডি' হয়ে উঠছে বাস্তবের সঙ্গে যোগাযোগহীন কয়েকটি হাসির ঘটনার সমাহার। বাস্তব অতিরিক্ত তিক্ত, নিরাশাজনক হয়ে যাওয়ার কারণেই কি সব ধরনের ছবি সত্যবিমুখ হয়ে কেবল বিনোদনের আধার হয়ে থাকছে?
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়: না, আমার তা মনে হয় না। তিক্ততার বিষয় নয়। সবচেয়ে বিপর্যস্ত সময় কিন্তু সবচেয়ে বড় সম্ভাবনার জন্ম দেয়। নাৎজি দলের ক্ষমতায় আসার সময় হচ্ছে ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৯ এবং হিটলারের জাতীয়তাবাদ তখন তুঙ্গে। বেশিরভাগ শিল্পী তখন হিটলারের হয়ে কথা বলতেন— একটা বড় নাম হচ্ছে লেনি রাইফেনস্টাল। অত ভালো পরিচালক হয়েও হিটলারকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু তারপর কী হলো? ১৯৩৯-এর পর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ যখন শুরু হলো, বৈজ্ঞানিক-শিল্পী-চিন্তকরা ধীরে ধীরে হিটলারের পাশ থেকে সরে গেলেন। এই ঘটনা কিন্তু সারা পৃথিবীতেই ক্ষমতার সঙ্গে হয়েছে— ফ্র্যাঙ্কোর সঙ্গে হয়েছে, পিনোশের সঙ্গে হয়েছে, মুসোলিনির সঙ্গে হয়েছে। আমার ধারণা, এখানেও এরকমই হবে। এখন অনেকেই পক্ষ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। আগে পক্ষ নিতেন, এখন পক্ষ নেওয়া বন্ধ করছেন, এরপর বিপক্ষে দাঁড়াবেন। আমি বিশ্বাস করি, বিপর্যস্ত সময় সব থেকে সম্ভাবনাময়; কারণ এখনই মানুষ কথা বলবে। দ্বিতীয়ত, নতুন প্রজন্ম কিন্তু কথা বলছে। বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করছেন, এবার রাইট ব্রেনের কাজ করা শুরু হবে। এতদিন লেফট ব্রেন ক্যালকুলেটিভ হয়ে কাজ করছিল। ক্রমশ যেদিকে আমরা এগোচ্ছি, তাতে আবেগ-স্বতঃস্ফূর্ততা-অনুভূতি আরও বেশি কাজ করতে শুরু করবে; গঠন আস্তে আস্তে ভাঙতে শুরু করবে। সেটা দেখে যাওয়ার জন্য আমরা হয়তো থাকব না। কিন্তু বদল হচ্ছে। সম্প্রতি অ্যামাজন প্রাইম বা নেটফ্লিক্সে যে সিরিজগুলো দেখছি, তাদের মধ্যে কিন্তু একটা বদলে যাওয়া ধাঁচ খুঁজে পাই। ওরা ক্রমশ সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কিছু কাজ করছে— অ্যানার্কিজম নিয়ে, ট্রেড ইউনিয়ন কথা বলছে। অদ্ভুত কিছু ছবি-সিরিজ সারা পৃথিবী থেকে উঠে আসছে। ভারতেও শুরু হয়েছে। একটা নড়াচড়া শুরু হয়েছে, লোকজন কথা বলা শুরু করছে, নতুন যারা আসছে তারা ধাক্কা দিচ্ছে। বাংলাতেও এটা হবে বলে আমার বিশ্বাস। এই মুহূর্তে হয়তো হচ্ছে না, হয়তো দর্শক সত্যিই মুক্তির পথ খুঁজছেন— সামাজিক বাস্তবতা থেকে সবাই দীর্ঘদিন মুখ ফিরিয়ে থাকবেন, এমনটা হতে পারে না।
প্র: এপার বাংলার ছবি-সিরিজ নিয়ে একটা বড় শ্রেণির দর্শকের নিরুত্তাপ ভাব দেখা যায়। সকলেই যে নিজের ভাষা-সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন, এমনটা নয়। তাঁরাই কিন্তু খুঁজে খুঁজে ওপার বাংলায় নুহাশ হুমায়ুনের কাজ দেখছেন, মোস্তফা সারওয়ার ফারুকির কাজ দেখছেন, বাংলাদেশের অভিনেতাদের অভিনয় দেখছেন। কিন্তু এপার বাংলার কাজ নিয়ে আশ্চর্য উদাসীনতা! কেন?
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়: দুটো বিষয় মনে হয়। এর ঐতিহাসিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটটা সামান্য হলেও বলতে চাই। বাংলাদেশ এবং ভারত— দুটো দেশই ইউরোপিয় উপনিবেশ। কিন্তু পোস্ট-কলোনিয়াল হ্যাংওভার কলকাতার যতখানি ছিল বা আছে, ঢাকার ততখানি নেই— এটা সত্যি। দ্বিতীয়ত, বাঙালি ভীষণ ভুগেছে। দাঙ্গা-মন্বন্তর-যুদ্ধ তো বটেই, আস্ত একটা দেশভাগ ভুগেছে। তার উপর আবার বাঙালি সংকর জাতি, জেনেটিক ইউনিফর্মিটি তো নেই! সুতরাং তারা যে অন্য সংস্কৃতির প্রতি ভালনারেবল হবে, সেটা খুব স্বাভাবিক। বোঝার একটা সহজ উপায় আছে। ধরা যাক, সকালে উঠে আমি ইংলিশ ব্রেকফাস্ট খাই, দুপুরে হয়তো রুটি-তড়কা খেলাম, বিকেলে হয়তো মশলা ধোসা খেলাম, রাত্রে আবার মাটন রোগান জোশ দিয়ে রুটি। চারটে আলাদা আলাদা ক্যুইজিন। এই বিভিন্ন সংস্কৃতি থেকে আহরণ করার প্রবণতা আমাদের সংস্কৃতিকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ করেছে এটা যেমন সত্যি, পাশাপাশি শিকড়হীনও করে দিয়েছে। দক্ষিণ ভারতে কিন্তু চাউমিন, তার সঙ্গে রোগান জোশ, তার আগে ইডলি, রাত্রে তড়কা— এভাবে খায় না। বাঙালি খায়। বাঙালি কিন্তু সে কারণেই হঠাৎ শেক্সপিয়র পড়ে, রম্যাঁ রলাঁ-ও পড়ে, আবার হঠাৎ-হঠাৎ দস্তয়েভস্কিও পড়ে। এই বিষয়টা কিন্তু পুরোপুরি রেনেসাঁর ফসল। আমরা রেনেসাঁর এই ফসলটা উপভোগ করছিলাম, এমন সময়ে দেশটা ভাগ হয়ে গেল। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হওয়াটা পুরোপুরি ভুল। দেশভাগের পর বাংলা সংস্কৃতির চর্চা, লালন-পালন কিন্তু বাংলাদেশ চালিয়ে গেল— শুধু ওদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা নয়, ওরা বাংলা ভাষাকেই সারা পৃথিবীতে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিল। আমরা যখন বেঙ্গলি ডায়াস্পোরা দেখছি, তখন বাংলাদেশের মারফতই দেখছি।
অপরপক্ষে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অনেক বেশি হিন্দিকেন্দ্রিক বাঙালি হয়ে উঠল। শুধু হিন্দিকেন্দ্রিক বলা ভুল, কখনও দক্ষিণকেন্দ্রিক, কখনও অন্যান্য অঞ্চলের প্রভাব এসে পড়ল। আরেকটা কারণ হচ্ছে, অর্থনীতি যে কোনও সংস্কৃতির নির্ধারক। মহারাষ্ট্র বা পঞ্জাব অর্থনৈতিকভাবে সফল, ওদের উদাহরণ দিয়ে বলি। পঞ্জাবের নির্মাতারা গোটা বলিউডে ছেয়ে গিয়েছে, মারাঠি পরিচালকরা বলিউডের চৌহদ্দির মধ্যেও একটা নিজস্ব পরিচিতি তৈরি করে ফেলেছে, নিজস্ব সংস্কৃতি ধরে রেখেছে। দক্ষিণেও তাই। শুধুমাত্র ঐতিহাসিক কারণে নয়, এরা অর্থনৈতিক কারণেও নিজেদের সংস্কৃতি ধরে রাখতে পেরেছে। আমরা আমাদের অর্থনৈতিক দৌর্বল্যের কারণেই প্রায় সমস্ত কিছুর সঙ্গে সমঝোতা করতে বাধ্য হলাম, এমনকী নিজেদের ভাষার সঙ্গেও। আমি শেক্সপিয়র আর দ্বিজেন্দ্রলাল রায় দু'জনকেই পড়ছি, তা যেমন দারুণ একটা বিষয়; পাশাপাশি এও সত্যি যে আমি ভাসমান জায়গায় রয়েছি— আমার নিজের কোনও স্বতন্ত্র শেকড় তৈরি হচ্ছে না, ঋত্বিকবাবু এই কথাটা বারবার বলতেন।
আমাদের সব থিয়েটার বস্তুত বিদেশি থিয়েটারের অনুবাদ; একটা সিনেমা বানিয়ে কান-বার্লিনে দেখাব— এরকমই অনেকের ভাবনা থাকে। আমাদের সংস্কৃতি ভীষণভাবে ইউরোসেন্ট্রিক একটা সংস্কৃতি হয়ে গেছে। এই ইউরোসেন্ট্রিক বাঙালিকে কিন্তু মারাঠি বা পঞ্জাবি বা মালয়ালির থেকে একটু আলাদা করে দেখা প্রয়োজন। সকালে উঠে একজন চেন্নাইয়ের মানুষ যা ভাবেন আর একজন কলকাতার মানুষ যা ভাবেন— তার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে। ‘আইফা’ বলে একটা পুরস্কার হয়। সেটা তো ভারতীয় সিনেমার পুরস্কার; তাহলে সেখানে গুজরাতি-মারাঠি-ভোজপুরী-বাংলা ছবি নেই কেন? তার মানে ভারতীয় ছবি মানেই হিন্দি ছবি, এমনটা ধরে নেওয়া হচ্ছে? এটা নিয়ে আমরা চট করে প্রশ্ন করব না, কিন্তু দক্ষিণ প্রশ্ন তুলবে। দক্ষিণিরা নিজেদের মতোই চলবে— মূলধারায় হোক বা সমান্তরালে। আদুর গোপালকৃষ্ণন মূলধারার না হয়েও সিনেমা তাঁর ভাষাতেই করবেন, আবার মণি রত্নম মূলধারার হয়েও কয়েকটা হিন্দি ছবি করার পর ফিরে এসে নিজের ভাষাতেই ছবি করবেন। এঁরা তো নিজ-নিজ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সফল। মণি রত্নমের তো দরকার ছিল না ফিরে এসে নিজের ভাষায় ছবি করার? তিনি তো বলিউডে সাফল্যের শীর্ষে? তবু তিনি এলেন। কারণ, তাঁদের সেই অর্থনৈতিক নিরাপত্তাও আছে, সামাজিক ইতিহাসও আছে; আমাদের ক্ষেত্রে তা নেই। বলিউডের কোনও বাঙালি পরিচালক যে মাপের সিনেমা মুম্বইতে বানান, এখানে তো পারবেন না। সেই পরিকাঠামো, টাকা— কিছুই দেওয়া যাবে না। এই সুবিধা আবার বাংলাদেশের আছে বলেই তারা নিজের জায়গাটা ধরে রাখতে পেরেছে; পশ্চিমবঙ্গ পারেনি। দেশভাগ না হলে হয়তো ছবিটা অন্যরকম হতো। দেশভাগ আমাদের অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে চলে গেছে। এপার বাংলার সংস্কৃতি চর্চার পক্ষে সাংঘাতিক ক্ষতিকর একটা বিষয় এই দেশভাগ। এটাকে সব থেকে ভালোভাবে যিনি চিহ্নিত করেছিলেন, তাঁর নাম ঋত্বিক কুমার ঘটক।
প্র: বিশ্বায়নোত্তর যুগে তো আর গ্রাম-শহর আলাদা করা যায় না, বাঁকুড়ায় বসেও ওয়াশিংটনে কী হচ্ছে খবর মেলে। স্মার্টফোন আসার পর, ডেটা রেভোলিউশনের পর একজন মানুষ আরও বেশি করে অপর মানুষের মতোই হয়ে উঠছেন। বৈচিত্র্যহীনতা আসছে, সবাই সবার মতো হয়ে উঠতে চাইছে। চরিত্র লিখতে গিয়ে এই বৈচিত্র্যহীনতার ক্রমবর্ধমান অভাব অনুভব করেছেন কখনও?
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়: এটা একটা বিরাট প্রশ্ন! যেখানে সংস্কৃতিটাই মনোলিথিক, সেখানে সুপারস্ট্রাকচার বা মাইন্ডও মনোলিথিক হবে সেটাই স্বাভাবিক। সংস্কৃতি মনোলিথিক কেন? খুব সহজ। দাঁত মাজতে কোলগেটই লাগবে, জিন্স পরলে লিভাই’জ ছাড়া চলবে না। এই বিশ্বাসটা বাজারই তৈরি করে, স্বাভাবিকভাবেই তাই জিন্সের কাটগুলো একরকমই হবে। প্রত্যেকটা বাড়ি হবে সোজা উঠে যাওয়া, সবক’টা বাড়ির বাইরের দিকটা কাচের, সবগুলো বাড়ির নিচে থাকবে বেসমেন্ট। এই বৈচিত্র্যহীনতা কিন্তু বিদেশে গেলে আরও বেশি করে দেখা যায়। কলকাতা বা পুরনো দিল্লির তো তবু কিছু দৃশ্যত আলাদা গঠন বা বৈশিষ্ট্য আছে, কিন্তু যত আবাসন তৈরি হয়েছে, তত শহরগুলো বৈচিত্র্যহীন হয়ে উঠছে। তার কারণ হচ্ছে প্রকৃতি থেকে সরে আসা। প্রকৃতি থেকে যত সরব, তত বোরডমে ভুগব। আগে মানুষ থাকত প্রকৃতিতে, এখন মানুষ চলে এল বোরডমে; সেখান থেকে আবার মন-মাথা ভালো রাখার জন্য যাচ্ছি প্রকৃতির মাঝে। নতুন করে ভাবব, মাথা ফাঁকা হবে; কিছু না হলে চুপচাপ বসে থাকব গাছের নিচে, সেই সুযোগ শহরে নেই-ই। কিন্তু কবির জন্য তো কয়েকটা ড্যাফোডিল ফুটতে হবে? কিছু মহুয়াফুল তো ফুটতে হবে? আরেকটা সত্যি হচ্ছে, মাথাটা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। মাথার একটা নিজস্ব নিয়ম, অ্যালগোরিদম আছে। মাথা কিন্তু ভয়ঙ্কর জিনিস, সে আবার নিজেকে আরও উন্নত করতে পারে, বদলাতে পারে যাতে পুরনো অ্যালগোরিদম ভেঙে দেওয়া যায়। এখন মাথা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় মানুষ অত্যন্ত ঘরকুনো হয়ে পড়ছে। বাইরে বেরিয়ে সে কিছু দেখছে না, কিছু শুনছে না। তবে এই অবস্থাটা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। এটাও বদলাবে, ডায়ালেক্টিক্সের মূল কথা সেটাই— কোনও কিছুই দীর্ঘদিন ধরে একভাবে চলতে পারে না।
প্র: সকলের হাতে স্মার্টফোন যবে এল, তাতে দেদার ডেটা এল, আগের তুলনায় শর্ট ফিল্ম তৈরির প্রবণতাও বাড়ল। অভিযোগ শুনি, এপার বাংলার ছবি অনেক বেশি কলকাতা-কেন্দ্রিক। মাধ্যম তো এখন আর বাধা নয়, কেউ চাইলে স্মার্টফোনেই ছবি বানাতে পারেন। তা সত্ত্বেও, পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-নদীয়া-মেদিনীপুরের কথা কেন আসছে না সিনেমায়। এমনকী, সেই অঞ্চলের মানুষ কলকাতায় এসে এখানকার মতোই ছবি বানাচ্ছেন!
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়: আসলে তাঁরা যে সিনেমাটা বানালেন, তা দেখানোর জায়গা কলকাতার বাইরে ভীষণ কম, আরও কমে আসছে দিনদিন। ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড মানুষের সামনে নতুন সম্ভাবনা উন্মুক্ত করেছে। ফোনে সিনেমা তৈরি হয়, বাড়িতে সাউন্ড বা এডিট করার মতো পরিকাঠামোও আছে। কিন্তু বিষয়বস্তু তো তৈরি হবে জীবনবোধ থেকে? একজন মানুষ, তিনি কলকাতারই হন বা গ্রামগঞ্জের— তাঁকে তো মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, জীবনবোধ তৈরি করতে হয়। বনফুলের গল্প নিয়ে কাজ করছি, এত গল্প তিনি পাচ্ছেন কোথায়? মানুষের সঙ্গে মিশেই। মানুষের সঙ্গে না মিশলে আমি ফর্মে যতই নতুনত্ব আনি না কেন, বিষয় হবে একঘেয়ে।
প্র: কলকাতার বাইরে গিয়েও যে কাজ হয়, সেগুলো আমরা কলকাতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখি...
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়: একেবারেই। চোখকে আত্মস্থ করার একটা বিষয় আছে— যে কোনও সত্যিকে আত্মস্থ করার একটা বিষয় আছে। আমি যদি ইরানের ছবির উদাহরণ দিই, তাঁরা কিন্তু মানুষের কাছে গিয়ে তাঁদের জীবন থেকে গল্প নিয়ে ছবি করছেন, ঘরে বসে গল্প ভাবার চেষ্টা করছেন না। সাধারণ গল্পই মানুষকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। সারা পৃথিবীতে যে কালজয়ী ছবি হয়েছে, সবই এভাবেই উঠে এসেছে। বিভূতিভূষণ বা তারাশঙ্কর এমনি এমনি লেখেননি। প্রত্যেকটা উপন্যাসে লেখা আছে কোন চরিত্রটা কাকে ভেবে লেখা। চরিত্রের শেকড় আছে সাধারণ মানুষের মধ্যেই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’— সব ক্ষেত্রেই।
প্র: বাংলা সিনেমাকে আগামী পাঁচ বছরে কোথায়, কীভাবে দেখেন?
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়: রাইট ব্রাদার্স প্লেন আবিষ্কার করলেন। আর একজন মানুষ প্যারাশ্যুট আবিষ্কার করলেন। পৃথিবীর যে কোনও পরিস্থিতিকে এই দুটো দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা যায়। রাইট ব্রাদার্সের উড়তে চাওয়ার ইচ্ছে আর প্লেন ভেঙে পড়ে গেলে কী হবে, তা আঁচ করে সতর্কতা নেওয়া। আমি রাইট ব্রাদার্সের চোখ থেকে দুনিয়া দেখি। যুক্তি দিতে পারব না, কিন্তু বিশ্বাসের জায়গা থেকে বলতে পারি: বাংলা ছবি তার পুরনো মর্যাদার জায়গায় সসম্মানে ফিরবে।