কার ভুলে এত বড় অঘটন? এবার সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা দুর্ঘটনার রিপোর্ট
Kanchenjunga Express Accident: উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য সুরক্ষা কমিশনার (চিফ কমিশনার অব রেলওয়ে সেফটি) জনককুমার গর্গ রেল বোর্ডের কাছে জমা দিয়েছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার প্রাথমিক রিপোর্ট।
জুনের মাঝামাঝি ভয়াবহ দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। শিয়ালদহের দিকে আসার সময় মালগাড়ির ধাক্কায় দুটি কামরা লাইনচ্যুত হয়ে গিয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের। একটি কামরা উঠে গিয়েছিল লাইনের উপরে, দ্বিতীয়টি যায় দুমড়েমুচড়ে। দুর্ঘটনায় অন্তত দশ জনের মৃত্যুর খবর মেলে। জখম হন অন্তত ৫০। সেই ঘটনার দায় মালগাড়ির লোকো পাইলটের উপরেই ঠেলেছিল রেল কর্তৃপক্ষ। সিগন্যালিংয়ের সমস্যা ও চালকের গাফিলতিকেই দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে দেগে দেওয়া হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতেই সামনে আসতে থাকে ভারতীয় রেলের একের পর এক গাফিলতির কথা। সম্প্রতি সামনে এসেছে সেই দুর্ঘটনার প্রাথমিক রিপোর্ট। আর যা সামনে আসতেই অস্বস্তিতে পড়েছে রেল কর্তৃপক্ষ।
রেলের সামগ্রিক পরিচালন ব্যবস্থাতেই যে গলদ, সেই ইঙ্গিত গোটা রিপোর্ট জুড়েই, জানা যাচ্ছে তেমনটাই। উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য সুরক্ষা কমিশনার (চিফ কমিশনার অব রেলওয়ে সেফটি) জনককুমার গর্গ রেল বোর্ডের কাছে জমা দিয়েছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার প্রাথমিক রিপোর্ট। যা সামনে আসার পর কার্যত বেআব্রু হয়ে গিয়েছে ভারতীয় রেল। একের পর এক দুর্ঘটনা প্রায় প্রতি বছরই ঘটে। কখনও করমণ্ডল এক্সপ্রেস, তো কখনও বিহারের কাছে আনন্দ-বিহার কামাক্ষ্যা এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা। প্রতিটা দুর্ঘটনার পরেই প্রশ্ন উঠেছে ভারতীয় রেলের অব্যবস্থা ও গাফিলতি নিয়ে। তবে তার পরেও তেমন কোনও পদক্ষেপ করতে দেখা যায়নি রেলকর্তৃপক্ষকে। এই কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, সুরক্ষাকবচ ব্যবহার করা হয়নি ট্রেনে। তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে রেলের সাফাই, কবচ বসানোর জন্য যে বিপুল খরচ, তা টানতে নাকি অপারগ রেল। অথচ বন্দে ভারতের মতো ট্রেনগুলির পিছনে রাশি রাশি টাকা খরচ করা হয় প্রতি সপ্তাহে। কিন্তু সাধারণ দূরপাল্লার ট্রেনগুলি চালানোর ক্ষেত্রে চরম অব্যবস্থা দেখা যায় প্রায় প্রতিদিনই।
আরও পড়ুন: কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের ‘সুরক্ষা কবচ’ কোথায়? এত বড় দুর্ঘটনার দায় কার?
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার পর সিগন্যালিং ব্যবস্থার সমস্যাকেই দুষেছিল রেল কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি মালগাড়ির লোকো পাইলটের গাফিলতির দিকেও আঙুল তোলা হয়। অথচ এ কথা সত্যি যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্রামের সুযোগটুকু দেওয়া হয় মালগাড়ির চালকদের। রেলের নিয়ম ভেঙেই দিনের পর দিন ডিউটি করতে বাধ্য করা হয় তাঁদের। যার ফলে শারীরিক ক্লান্তি অনেকসময়ই দুর্ঘটনা ডেকে আনা। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস সংক্রান্ত সাম্প্রতিক এই তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থায় ট্রেন চলাচল পরিচালনা করার মতো উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব ছিল ট্রেনচালক, ট্রেন ম্যানেজার এবং স্টেশন মাস্টারের। মালগাড়ির চালক নির্দিষ্ট গতিতে গাড়ি ছুটিয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে আগেই প্রশ্ন উঠেছিল। রিপোর্টও বলছে, মালগাড়ির চালককে দেওয়া কাগুজে অনুমতিপত্রে (মেমো) নির্দিষ্ট গতির কথা উল্লেখই করা হয়নি। এমনকি, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা খারাপ থাকলে যে পদ্ধতিতে ট্রেন চলানো উচিত, তা মানা হয়নি। এই ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট যে ফর্মে ট্রেন চালানোর অনুমতি দেওয়া হয় চালক এবং ট্রেন ম্যানেজার (গার্ড)-দের, রাঙাপানির স্টেশন মাস্টার তা দেননি বলেই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। সঠিক নিয়ম না-জানার কারণেই এমনটা হয়েছে বলে সুরক্ষা কমিশনার তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন।
গত ১৭ জুন উত্তরবঙ্গের চটেরহাট এবং রাঙাপানি স্টেশনের মাঝে মালগাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের। যে লাইন দিয়ে ওই এক্সপ্রেস ট্রেনটি চলছিল, একই লাইনে চলার অনুমতি পাওয়া একটি মালগাড়ি পিছন থেকে এসে সজোরে ধাক্কা মারে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে। ধাক্কার জেরে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের একাধিক কামরা উঠে পড়ে মালগাড়ির ইঞ্জিনের উপর। লাইনচ্যুত হয় মালগাড়ির কামরাও। ঘটনায় মৃত্যু হয় কাঞ্চনজঙ্ঘার গার্ড এবং মালগাড়ির চালকেরও। এর পরেই রেলের তরফে এই দুর্ঘটনার তদন্তভার দেওয়া হয় উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য সুরক্ষা কমিশনারকে। সেই রিপোর্টই সামনে এসেছে এবার।
দুর্ঘটনার পরে পরেই জানা যায়, রাঙাপানি এবং চটেরহাট স্টেশনের মধ্যবর্তী অংশে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বন্ধ থাকায় ‘কাগুজে সিগন্যাল’ দিয়ে চালানো হচ্ছিল ট্রেন। সুরক্ষা কমিশনারের সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাঙাপানি স্টেশনের স্টেশনমাস্টার দু’টি ট্রেনের চালক এবং গার্ডকে কাগুজে সিগন্যাল হিসাবে ‘টি৩৬৯ (৩বি) এবং ‘টিএ-৯১২’ ফর্ম দিয়েছিলেন। সেখানে চালকদের লাল সিগন্যালকে ‘অন’ হিসাবে মান্যতা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলেও ট্রেনের সর্বোচ্চ গতিবেগ কত রাখতে হবে, তা ঠিকমতো উল্লেখ করা হয়নি। এখানেই শেষ নয়। রিপোর্টে এ-ও জানানো হয়েছে, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে সামনে দেখে আপৎকালীন ব্রেক কষেছিলেন মালগাড়িটির চালক। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মালগাড়ির গতিবেগ নামিয়ে এনেছিলেন ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটারে। তার পরেও দুর্ঘটনা এড়ানো যায়নি। কারণ, দু’টি ট্রেনের মধ্যে ব্যবধানিক দূরত্ব ছিল একেবারেই কম।
উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য সুরক্ষা কমিশনার তাঁর রিপোর্টে জানিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে ‘টিএ-৯১২’ ফর্ম নয়, নিয়ম অনুযায়ী ‘টিডি-৯১২’ ফর্ম দেওয়া উচিত ছিল। স্টেশন মাস্টারের ভূমিকা নিয়েও রিপোর্টে উঠে গিয়েছে প্রশ্ন। জনককুমার ওই রিপোর্টে আরও লিখেছেন, ‘টিএ-৯১২’ ফর্মে গার্ডের কোনও স্বাক্ষর ছিল না। তাঁর মতে, স্টেশন মাস্টার ওই স্বাক্ষর সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছেন। রিপোর্টে এ-ও জানানো হয়েছে, ‘কাগুজে অনুমতি’ পেয়ে ঘণ্টায় ১৫ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চালিয়েছিলেন কাঞ্চনজঙ্ঘার চালক। প্রতিটি লাল সিগন্যালের সামনে ১ মিনিট করে ট্রেন দাঁড়ও করিয়েছিলেন তিনি। তার পরে তিনি এগিয়ে ছিলেন নিয়ম মেনেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একই অনুমতিপত্র পেয়ে মালগাড়ির চালক হঠাৎ কেন অতিরিক্ত গতিতে ট্রেন চালালেন? রিপোর্টে বলা হয়েছে, মালগাড়ির চালক রাঙাপানির স্টার্টার সিগন্যাল ১৫ কিলোমিটার গতিবেগে এবং অ্যাডভান্স স্ট্যার্টার সিগন্যাল ৩৮ কিলোমিটার গতিবেগে পেরিয়েছিলেন। সেই গতিবেগই পরে ৪৭ এবং ৭৮ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় নিয়ে যান তিনি। দুর্ঘটনা যখন ঘটে, তখন মালগাড়ির গতিবেগ ছিল ৪০ কিলোমিটার। রিপোর্টের এই জায়গায় এসে সুরক্ষা কমিশনার স্পষ্ট লিখেছেন, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থায় কী ভাবে ট্রেন চালানো উচিত, তা নিয়ে কাটিহার বিভাগের এই অংশের রেলকর্মীদের মধ্যে যথেষ্ট প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। এক এক জন স্টেশন মাস্টার এক এক নিয়মে ট্রেন চলাচল পরিচালনা করেন। সকলে এক নিয়ম মানেন না। ট্রেন চলাচল পরিচালনার ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাব অত্যন্ত স্পষ্ট বলেই মনে করেছেন রেলের মুখ্য সুরক্ষা কমিশনার।
একই সঙ্গে রেলের একাধিক অব্যবস্থা ও গাফিলতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে। তদন্তে উঠে এসেছে, মালগাড়ির চালক ও গার্ডের কাছে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য কোনও ‘ওয়াকিটকি’র ব্যবস্থা করেনি রেল। তবে রেলের দেওয়া মোবাইল ফোন ছিল। রিপোর্টে কমিশনারের দাবি, মালগাড়ির চালক এবং গার্ডের মধ্যে শেষ কথা হয়েছে দুর্ঘটনার অন্তত আধ ঘণ্টা আগে। সেটাও দু’বার। তবে কী নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়েছিল, সে ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি। এমনকি, রাঙাপানি স্টেশনে প্রায় ৩০ মিনিট মালগাড়িটি দাঁড়িয়ে থাকলেও কেন স্টেশন মাস্টারকে ফোন করে দাঁড় করিয়ে রাখার কারণ জিজ্ঞেস করেননি গার্ড, সে প্রশ্নও তুলেছেন সুরক্ষা কমিশনার।
আরও পড়ুন: বিভীষিকাময় রেলসফর! দেশের যে দুর্ঘটনাগুলি আজও ভোলা যায়নি
দুর্ঘটনার পরেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল যাত্রীবাহী ট্রেন ও মালগাড়ির চালকদের যথাযথ বিশ্রাম পাওয়া নিয়ে। যদিও সুরক্ষা কমিশনারের রিপোর্ট বলছে, কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং মালগাড়ি— দুই ট্রেনের চালকই যথেষ্ট বিশ্রাম পেয়েছিলেন। কাঞ্চনজঙ্ঘার চালক ৪০ ঘণ্টার বিশ্রাম পেয়েছিলেন। আর মালগাড়ির চালক পেয়েছিলেন ৩০ ঘণ্টার বিশ্রাম। ‘ব্রেথ অ্যানালাইজ়ার’ এবং রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট বলছে, দুই চালকের কেউই দুর্ঘটনার সময় মত্ত অবস্থায় ছিলেন না। ফলে তাদের গাফিলতির থেকেও সমন্বয়ের অভাবকেই দুর্ঘটনার জন্য বেশি করে দুষেছেন সুরক্ষা কমিশনার। একই সঙ্গে রেলের বিভাগীয় সকল কার্যালয় এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের আধিকারিকদের দিকেও আঙুল তোলা হয়েছে সুরক্ষা কমিশনারের রিপোর্টে। স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থায় কী ভাবে ট্রেন চালাতে হবে, কী ভাবে সিগন্যাল খারাপ থাকলে ট্রেন চালাতে হবে, তা নিয়ে কেন প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে কর্মীদের, প্রশ্ন তোলা হয়েছে তা নিয়েও। এমনকী স্টেশন সুপার এবং ম্যানেজারেরও এই নিয়ে প্রশিক্ষণের অভাব ছিল বলেও প্রাথমিক রিপোর্টে জানিয়েছেন সুরক্ষা কমিশনার। গত ৫ বছরে শুধুমাত্র সিগন্যাল বিকল হওয়ার কারণে কতগুলি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার হিসেবও দেওয়া হয়েছে এই রিপোর্টে।
প্রশ্ন উঠেছে, এই রিপোর্ট সামনে আসার পরেও কি নড়েচড়ে বসবে ভারতীয় রেল? নাকি এই গয়ংগচ্ছ ভাবই রেল চালানোর ক্ষেত্রে চালিয়ে যাবে রেলকর্তৃপক্ষ? টাকা খরচ করে টিকিট কেটে এভাবেই কি মৃত্যু কিনবেন ভারতীয় রেলের যাত্রীরা? দুর্ঘটনা রুখতে কী ব্যবস্থা নেবে ভারতীয় রেল? প্রশ্ন থেকেই যায়।