মেয়েদের জন্য আর নিরাপদ শহর নয় বেঙ্গালুরু! কেন বাড়ছে ভয়ঙ্কর হত্যার ঘটনা?

Unsafe City Bengaluru: দিল্লিকে ভারতের ধর্ষণের রাজধানী বলা হয় কিন্তু মেয়েদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দিল্লি এবং বেঙ্গালুরু তেমন আলাদা কিছু নয়

শ্রদ্ধা ওয়ালকারকে মনে আছে? প্রেমিক ৩৫ টুকরো করে প্রেমিকাকে কেটে দিল্লিতে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে কিছুদিন আগেই। কেটে টুকরো টুকরো করা দেহ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রেফ্রিজারেটর। খুন হয়েছেন এক যুবতী, মহালক্ষ্মী। তবে এবার দিল্লি নয়, বেঙ্গালুরু। নির্ভয়ার আগে থেকেই দিল্লি মেয়েদের খুব একটা নিরাপত্তা দিতে পারেনি। নির্ভয়ার পরে মহিলারা আর দিল্লিকে নিরাপদ বলে ভাবেনই না! তবে বেঙ্গালুরু বরাবরই ছিল এগিয়ে। মহিলারা গভীর রাত অব্দি কাজ করেছেন, ফিরেছেন, আড্ডা মেরেছেন, একা থেকেছেন। বেঙ্গালুরু ভারতের মধ্যে মেয়েদের জন্য নিরাপদতম শহরের একটি ছিল। বেঙ্গালুরুতে এই মুহূর্তে সারা ভারতের নানা রাজ্যের মানুষের বাস। কিন্তু এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠল কেন এই শহর? বিশেষ করে মেয়েদের জন্য?

২০২২ সালের মে মাসে শ্রদ্ধা ওয়াকারকে তার লিভ-ইন পার্টনার আফতাব পুনাওয়ালা খুন করে মৃতদেহ ৩৫ টুকরো করে কেটেছিলেন, মুখ পুড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং কাটা অংশগুলিকে একটি ফ্রিজে রেখেছিলেন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বেঙ্গালুরুতে প্রেমিক তথা লিভ-ইন পার্টনারের হাতে খুন হন আরেক যুবতী। ২০২১ সালে বেঙ্গালুরুতে একটি অ্যাড-টেক কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছিলেন দিল্লির ওই যুবতী। তারপর ২০২৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মহালক্ষ্মীর দেহ মেলে। ফ্রিজে রাখা কাটা কাটা দেহ। বেঙ্গালুরুতে প্রেম এবং বিশ্বাসঘাতকতার সঙ্গে সম্পর্কিত খুনের ঘটনা এত বাড়ল কেন?

গত কয়েক দশক ধরেই ভারতের সিলিকন ভ্যালি বেঙ্গালুরু কমবয়সি চকুরিজীবী মহিলাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ শহরের মধ্যে একটি ছিল। বিশ্বব্যাপী এক সমীক্ষায় দেখা গেছে বসবাসের জন্য সেরা ভারতীয় শহর হিসাবে তালিকায় স্থান পেয়েছিল বেঙ্গালুরু, ২০১১ সালের কথা। এখন, প্রশাসন পুলিশ নিরাপত্তা নিয়েই চিন্তিত। গত তিন বছরে বেঙ্গালুরুর এই নিরাপত্তার খ্যাতি চরম ধাক্কা খেয়েছে। এই শহরে প্রাণবন্ত যুব সম্প্রদায়ের বাস। পরিযায়ী চাকুরিজীবীদের জনসংখ্যার যত বাড়ছে, শহরের চরিত্র বদলে যাচ্ছে। লিভ-ইন বাড়ছে, বাড়ছে অপরাধও।

আরও পড়ুন- ফ্ল্যাটের ফ্রিজে তরুণীর টুকরো টুকরো দেহ! শ্রদ্ধাকাণ্ডের ছায়া বেঙ্গালুরুতেও?

বেঙ্গালুরু ক্রাইম ব্রাঞ্চের তথ্য অনুসারে, এই বছরের প্রথম আট মাসেই, কর্ণাটকে ৭০২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। যাদের মধ্যে ২৩ জনকে তাদের প্রেমিক বা লিভ-ইন পার্টনাররা হত্যা করেছে। ক্রাইম ব্রাঞ্চ আরও জানাচ্ছে, ২০২৩ সালে, রাজ্যে প্রেমিকদের হাতে খুনের ৪১টি ঘটনা ঘটেছিল। ২০২২ সালে এমন ঘটনা ছিল ২০টি। গোঁড়া রাজনীতিবিদরা হামেশাই বলে থাকেন, এসব ঘটনার জন্য মহিলাদের উচ্ছৃঙ্খলতা, ‘ওয়েস্টার্ন কালচার', মেয়েদের চাকরি করাই দায়ী।

এমন ঘটনার সাম্প্রতিকতম শিকার মহালক্ষ্মী। সেপ্টেম্বরে তাঁর এক প্রতিবেশী ফ্ল্যাট থেকে দুর্গন্ধ পেয়ে পুলিশে জানান। পুলিশ এসে দেখে যুবতীর টুকরো টুকরো দেহ ফ্রিজে রাখা। তাঁর প্রেমিক ওড়িশায় নিজের গ্রামে পালিয়ে যায়, যেখানে সে আত্মহত্যা করে মারাও যায়।

২০২৩ সালে যে যুবতীর মৃত্যু ঘটে তাঁর আর মহালক্ষ্মীর ঘটনার মধ্যে মিল হচ্ছে, দুই মহিলাই আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী এবং ৩০-এর মধ্যে বয়স। আর তারা বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা নন। এরা দু'জনেই তাঁদের সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে চাননি। ওই একই বছরে প্রেসার কুকার দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় এক মহিলাকে; অন্য আরেকজনকে কলেজ ক্যাম্পাসে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়। এই অপরাধগুলিতে মিশে আছে প্রতিশোধ, প্রত্যাখ্যান এবং হতাশা।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার এবং সেক্সুয়ালিটির সহকারী অধ্যাপক শ্যানন ফিলিপ বলছেন, “দিল্লিকে ভারতের ধর্ষণের রাজধানী বলা হয় কিন্তু মেয়েদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দিল্লি এবং বেঙ্গালুরু তেমন আলাদা কিছু নয়। বেঙ্গালুরুর সামাজিক কাঠামোতেও মহিলাদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অপরাধগুলি নিজের জায়গা তৈরি করে নিচ্ছে। এই অপরাধগুলি প্রেম বা আবেগ বিষয়ক নয়, টক্সিক ম্যাসকুলিনিটিই এর কারণ।"

ইন্দিরানগর এবং চার্চ স্ট্রিট সহ বেঙ্গালুরুর অন্যতম জনপ্রিয় পার্টি হাব কোরামঙ্গলার কয়েক কিলোমিটার দূরেই আছে পেয়িং গেস্ট থাকার জায়গা। ২৪ বছর বয়সি কৃতি কুমারীকে জুলাই মাসে খুন করা হয়েছিল এখানেই। “এই ঘটনার পর, আমি আমার ঘনিষ্ঠ মহিলা বন্ধুদের ছাড়া অন্য কাউকে বিশ্বাস করি না,” দু প্রিন্টকে বলেছেন "অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়াড়ার ২২ বছরের কলেজ ছাত্রী অভিরামি কুমারী। মিডিয়া স্টাডিজে স্নাতকোত্তর করার জন্য দুই বছর আগে বেঙ্গালুরুতে আসেন তিনি। কৃতিকে খুন করেছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুর প্রাক্তন প্রেমিক! ওই প্রেমিকের অভিযোগ ছিল, তাদের সম্পর্কের তিক্ততার জন্য কৃতিই দায়ী।

আরও পড়ুন-যৌনাঙ্গে রড, দেহ ৩৫ টুকরো! অপরাধীকে নৃশংসতা শেখায় আসলে কারা?

এই মুহূর্তের প্রেম ও যৌনতা নানা ডেটিং অ্যাপ নির্ভরও হয়ে উঠছে। বিশেষ করে এই মহানগরগুলিতে। বাম্বলেই দেখা হয়েছিল ওয়াকার ও পুনাওয়ালার। ডেটিংয়ের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ পুরুষই মহিলার বাড়ি আসতে চান, বিশেষ করে সেই মহিলা যদি একা থাকেন। পরিচিত প্রেমিক বা বন্ধু যেখানে খুন করতে পারে, সেখানে একজন অপরিচিত পুরুষকে বিশ্বাস কীভাবেই বা করা যায়! ফলস্বরূপ, অনেকেই লিভ-ইন পার্টনার বা বয়ফ্রেন্ডদের হাতে খুন হওয়ার ঘটনার পর থেকে সমস্ত ডেটিং অ্যাপ আনইনস্টল করেছেন৷

বৈষ্ণব আর পদ্মাদেবীর বন্ধুত্ব কলেজ থেকে। সেখান থেকে লিভ ইন। সেখান থেকে বিয়ের দিকে যাচ্ছিল সম্পর্ক। গত বছরের অগাস্টে প্রেশার কুকার দিয়ে পদ্মাদেবীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে বৈষ্ণবকে গ্রেফতার করা হয়। বৈষ্ণবের বাড়ি কোল্লাম, পদ্মাদেবীর তিরুবনন্তপুরমে। দুই বছর আগে তারা কাজের জন্য বেঙ্গালুরুতে আসেন এবং একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন। তারপরেই কিছুকাল বাদে খুন। এই কমবয়সি প্রেমিক প্রেমিকারা রাগের কারণে এক সেকেন্ডের মধ্যে বড় কিছু ঘটিয়ে ফেলেন। ভুল বোঝাবুঝি থেকে ধরে নেন যে তাদের সঙ্গে প্রতারণা হচ্ছে। এই যুগলরা নিজেদের সঙ্গীকে খুব বেশিদিন না জেনেই লিভ-ইন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। পুলিশরাও লিভ-ইন কাপলদের হত্যার মামলা নিয়ে আগে থেকেই যেন মাথায় একটি ধারণা করে নেন। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকেই মহিলার উপরই দোষ চাপিয়ে দেন, নীতি পুলিশি শুরু করে দেন। বহু রাজনীতিবিদদের পথে হেঁটেই তারাও বলতে থাকেন পশ্চিমি মূল্যবোধের কারণেই শিক্ষিত এবং চাকুরিজীবী মহিলারা বেশি 'স্বাধীনতা পেয়ে গেছেন'। সেই কারণেই ইউনিফর্ম সিভিল কোড (ইউসিসি) অ্যাক্ট বাস্তব হয়ে যাচ্ছে দেশে। উত্তরাখণ্ড দেখিয়েছে কীভাবে এই আইনে লিভ-ইন দম্পতিদের আরও আইনি বেড়াজালে বাঁধতে পারে।

কয়েক বছর আগে গোয়ার সাংবাদিক জেরার্ড ডি সুজা তাঁর বই ক্রাইমস অফ প্যাশন: হোয়েন ডিজায়ার টার্নস ডেডলি-র জন্য গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন বেঙ্গালুরুতে এই জাতীয় অপরাধ নেই। মুম্বইয়ের নীরজ গ্রোভার-মারিয়া সুসাইরাজ কাণ্ড, দিল্লির প্রিয়দর্শিনী মাট্টু-সন্তোষ কুমার সিং কাণ্ড এবং গোয়ার স্যামসন ডি'সুজা-স্কারলেট কিলিং কেস তিনি তাঁর বইতে লেখেন। ১১টি প্যাশন কিলিং-এর ঘটনা চেয়েছিলেন তিনি যা গত ২০ বছরে এই দেশে ঘটেছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তাঁর গবেষণাকালে, অর্থাৎ ২০২০-২১ সালে বেঙ্গালুরুতে এমন ঘটনা একটিও ঘটেনি। মহালক্ষ্মীর হত্যার পর বেঙ্গালুরু শহরে পুরুষ বন্ধু বা সহকর্মীকে বিশ্বাস করে একা থাকা মেয়েদের পরিবারগুলিও চিন্তায়। কেন এত অসহিষ্ণুতা, এত নির্ভীকভাবে খুন করে চলেছেন এমন মানুষরা যাদের হয়তো আগে থেকে অপরাধের কোনও ইতিহাসও নেই। নিরাপদ শহর বেঙ্গালুরু কি ক্রমেই মহিলাদের মৃত্যুপুরীই হয়ে উঠছে?

More Articles