হাসিনা আদৌ পদত্যাগ করেছিলেন? কেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে সরাতে চাইছে মানুষ?
Mohammed Shahabuddin Bangladesh: রাষ্ট্রপতি নাকি শুধুমাত্র শুনেছিলেন হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। সাহাবুদ্দিনের কাছে নাকি পদত্যাগের কোনও প্রমাণ্য নথি নেই।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের তিন মাস হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের সম্মতিতে এখন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। সে সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষে থাকা ছাত্রনেতারা জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে তাঁরা মহম্মদ ইউনূসকে চান। ইউনূসও সেই প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন। সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দু'জন কেন্দ্রীয় সম্বনয়ক হঠাৎ দাবি জানিয়েছেন, মহম্মদ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অপসারণ করতে হবে। ক্ষমতা হস্তান্তরের পর দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন আনার দাবি সম্বনয়কদের নতুন নয়। অতীতেও নানা পদে পরিবর্তন এনেছেন তাঁরা। অন্যদিকে, বাংলাদেশের অনেক রাষ্ট্রপতিরই বিদায় রাজনৈতিক ঝড়ঝাপটার মধ্যে দিয়ে হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, দেশের রাষ্ট্রপতি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন, নয়তো বা তাঁকে পদ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। অনেক সময় আবার ক্ষমতায় থাকা দলের সঙ্গে মত বিরোধের কারণে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরে যেতে হয়েছে। এখন কেন মহম্মদ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অপসারণের দাবি উঠছে?
১৩ অক্টোবর সম্বনয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের এই দাবির কথা জানান। আব্দুল্লাহর পোস্টের কয়েক ঘণ্টা পরই আবার সম্বনয়ক সারজিস আলমও তাঁর ফেসবুক থেকে একই দাবির কথা জানিয়েছিলেন। তার পর থেকেই এই বিষয়টি নিয়ে জোর চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। দু'জনেই পাঁচ দফা দাবির কথা উল্লেখ করেছিলেন। উল্লিখিত আরও চারটি দাবি হল-
১) আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিতকরণ
২) নতুন সংবিধান গঠন
৩) আওয়ামী দুর্নীতিবাজ আমলাদের পরিবর্তন
৪) হাসিনার আমলে করা সব অবৈধ চুক্তি বাতিল
আরও পড়ুন- হাসিনার দেশে কাদের গুম করে রাখা হতো কুঠুরিতে! কী এই রহস্যময় আয়নাঘর?
উল্লেখ্য, ৫ অগাস্ট হাসিনা দেশ ছাড়ার পর জাতীয় উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন। সে দিনই ভাষণে বলেছিলেন, শেখ হাসিনা তাঁর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং সাহাবুদ্দিন তা গ্রহণও করেছেন। এই ঘটনার তিনমাস পর সম্প্রতি তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি শুধুমাত্র শুনেছিলেন হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। সাহাবুদ্দিনের কাছে নাকি পদত্যাগের কোনও প্রমাণ্য নথি নেই। দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, রাষ্ট্রপতি তাঁকে বলেছেন, "শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোনও দালিলিক প্রমাণ তাঁর হাতে নেই"।
এরপরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এবং আইনি উপদেষ্টা আসিফ নজরুল রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ তোলেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ একাধিক স্থানে মিছিল-সমাবেশ করে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি করেন তাঁরা। তবে প্রশ্ন উঠছে, কেন এতদিন পর এই দাবি তোলা হচ্ছে? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সম্বনয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বিবিসি-কে বলেছেন, অতীতেও এই দাবি উঠেছে, তবে এখন তা জোরালো।
রাষ্ট্রপতির বক্তব্য নিয়ে সমাজমাধ্যম থেকে গণমাধ্যমে বিতর্ক শুরু হলে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বাসভবন 'বঙ্গভবন' বিবৃতি দিয়ে জানায়, "প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে প্রচার চালানো হয়েছে, তা জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সুস্পষ্ট বক্তব্য হল, ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতার ওপর যত ধরনের প্রশ্ন জনমনে উদ্রেক হয়েছে, সেগুলোর উত্তর আপিল বিভাগের আদেশে প্রতিফলিত হয়েছে।"
সাক্ষাৎকারে সাহাবুদ্দিনের মন্তব্যের পর সোমবার আইনি উপদেষ্টা ডঃ আসিফ নজরুল রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে শপথভঙ্গের অভিযোগ তোলেন। এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা রাষ্ট্রপতিকে 'ফ্যাসিবাদের দোসর' বলে তাঁর পদত্যাগের দাবি তোলেন। এই দাবিতে মঙ্গলবার বিকালে শহিদ মিনারের সামনে সমাবেশ ও বঙ্গভবন ঘেরাও হয়। তখন রাষ্ট্রপতিকে পদ ছাড়তে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল। বৃহস্পতিবার ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সংবাদমাধ্যমকে জানান, সাহাবুদ্দিনের থাকা না থাকার বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটি মনে করে, শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন যে মিথ্যাচার করেছেন তারপর কোনওভাবেই সেই পদে তিনি থাকতে পারেন না। দলের দাবি, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির পথ থেকে সরে যেতে হবে রাষ্ট্রপতিকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সম্বনয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বিবিসি-কে বলেছেন, "একটি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হয়েছে। তাই, ফ্যাসিস্ট হাসিনার নির্ধারিত রাষ্ট্রপতি থাকলে তা যে কোনও সময় রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে।" তাঁর কথায়, "এই কারণে আমরা মনে করি, ওঁকে সহজ প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে সসম্মানে কীভাবে বিদায় দেওয়া যায়, সেদিক নিয়ে ভাবা উচিত। তিনি ফ্যাসিজমের একটি সিম্বল। সেই সিম্বলটা থাকা উচিত নয়।"
এখন এ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে যে, যদি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাপে রাষ্ট্রপতির অপসারণ হয় তাহলে তা কোন প্রক্রিয়ায় হবে? সে ক্ষেত্রে আইনজীবীরা যুক্তি দিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি যদি নিজের ইচ্ছায় পদত্যাগ করতে চান তাহলে সংসদের প্রয়োজন নেই। তাহলে সংবিধান অনুযায়ী, সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির অপসারণ করানো যায়। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের আইনগত বৈধতা নিয়েই যে প্রশ্ন রয়েছে সে যুক্তিও দিচ্ছেন তাঁরা। কারণ এখন দেশে সংসদই নেই। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন বা মৃত্যুর কারণে পদ খালি হয় তবে সেই স্থান পূরণ করেন স্পিকার। বাংলাদেশের বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্পিকারও নেই। ফলত, রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর কোনও বৈধ পন্থা় নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক শেখ হাজিজুর রহমান কার্জন বিবিসি-কে বলেছেন, "সংবিধান স্থগিত করা হয়নি। কিন্তু আবার সেটি পুরোপুরি অনুসরণও করা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে একটি লিগ্যাল অ্যানার্কি বা আইনি নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে। এর ফলে হয়তো অনেক কিছুই করতে হচ্ছে, যা নিয়ম মেনে হবে না।" অধ্যাপকের কথায়, রাষ্ট্রপতি নিজেই এই সরকারের শপথ করিয়েছেন। সরকার তাঁকে সংসদ ছাড়া সরিয়ে দিলে এখন হয়তো বিষয়টা নিয়ে কথা হবে না কিন্তু পরে আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
আরও পড়ুন- ১১ মাস জেলও খেটেছেন! তবু কেন বাংলাদেশের জনগণের মন রাখতে ব্যর্থ শেখ হাসিনা?
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও প্রাক্তন সাংসদ হারুনুর রশীদ ডিডাব্লু-কে বলেন, "আমরা রাষ্ট্রপতিকে স্বপদে বাহাল রাখায় কোনও সংকট দেখছি না। বরং আমার দল মনে করে, তিনি পদত্যাগ করলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে। কারণ, স্পিকার পদত্যাগ করেছেন। ডেপুটি স্পিকার কারাগারে। সংসদ নেই। তাহলে তিনি কোথায় পদত্যাগ করবেন? তিনি পদত্যাগ করলে সংকট হবে।" তিনি আরও বলেন, "জুলাই-অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে একটি জাতীয় ঐক্য হয়েছে। এখন রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নিলে তা সব রাজনৈতিক দলসহ সব পক্ষের সঙ্গে ঐক্যমতের ভিত্তিতেই করতে হবে। এর বাইরে কোনও সিদ্ধান্ত নিলে তা সব রাজনৈতিক দলসহ সব পক্ষের সঙ্গে ঐক্যমতের ভিত্তিতেই করতে হবে। এর বাইরে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। আর এখনও পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি স্বেচ্ছায় সরে যেতে চাননি।"
রাষ্ট্রপতির অপসারণের বিষয়টি নিয়ে অন্তবর্তী সরকারের উপর চাপ তৈরি হয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার এই বিষয়টি নিয়ে তাড়াহুড়োর মধ্যে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চায় না বলেই মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল। শনিবার রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সাহাবুদ্দিনকে সরানো নিয়ে ঐক্যমত তৈরি করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর-সহ দলটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। বিএনপির চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে এই বৈঠক হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতারা ও নাগরিক কমিটি রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবিতে অনড় থাকতে অন্তর্বর্তী সরকারের উপর চাপ বাড়াতে চাইছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বৈঠক শেষে 'প্রথম আলো'-কে বলেছেন, "আমরা যা বুঝতে পারলাম, রাষ্ট্রপতিকে সরানো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। কিন্তু পরবর্তী প্রক্রিয়া, দেশে যাতে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে; সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে সরানো বা সংবিধান পরিবর্তনের আলোচনা কীভাবে এগোনো যায়, সেটি নিয়ে আরও আলোচনার অবকাশ আছে। সেজন্য হয়তো আমাদের আরও সময় নিতে হবে; কিন্তু আলোচনার অগ্রগতি ইতিবাচক।"
উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে এখনও অনেকেই পদত্যাগ করেছেন। এখন সময় বলবে, জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন পদত্যাগ করবেন? নাকি নিজের ইচ্ছেতে পদত্যাগ করবেন? নাকি তিনিই রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকবেন?