সতীদাহ মেনে নিল রাষ্ট্র? কেন মুক্তি পেয়ে গেল 'সতী' রূপ কানওয়ারের অভিযুক্ত?
Roop Kanwar Satidaha: রূপ কানওয়ার কি স্বেচ্ছায় স্বামীর সঙ্গে সহমরণে গেছিলেন নাকি তাঁকে নেশাগ্রস্ত করে চিতায় টেনে আনা হয়েছিল?
সাঁইত্রিশ বছর আগে রূপ কানওয়ারকে সতীদাহের নামে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। তারপর সেই সতী রূপের জন্য মন্দির গড়া হয়েছে। নতুন লাল ওড়না, টাটকা নারকেল, পোড়া ধূপের গন্ধ এখনও রূপের সেই মন্দিরে তীব্রভাবে বাস্তব! রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং গুজরাত জুড়ে এমন রূপরাই তো তৈরি করে গেছেন 'সতী তীর্থযাত্রা'। যারা সতী হয়েছেন, তাঁদের মৃত্যুস্থল এই ভারতে আজও 'তীর্থ'! তাও গ্রামবাসীরা এখনও বলেন ‘মন্দির ওঁহি বানায়েঙ্গে’। তারা চান, এই সতীর জন্য আরও বড় মন্দির গড়া হোক। আর সবচেয়ে মজার বিষয়, রাজস্থানের একটি আদালত রূপের এই হত্যাকে মহিমান্বিত করার অপরাধে অভিযুক্ত শেষ ব্যক্তিদেরও জামিন দিয়ে দিয়েছে। এমনটা অবশ্য হয়েই থাকে এই দেশে।
বছরের পর বছর ধরে, রাজস্থানের আদালত একটি জিনিস পরিষ্কার করে দিয়েছে। আদালত প্রমাণ করে দিয়েছে কেউ ১৯-বছর-বয়সি রূপ কানওয়ারকে আগুনে পুড়িয়ে দেয়নি বা কেউ রূপের মৃত্যু উদযাপনও করেনি। রাজ্য সরকারও আদালতের এই মতামতকে চ্যালেঞ্জ করেনি। ফলস্বরূপ অভিযুক্ত শেষ ব্যক্তিও মামলা থেকে খালাস! জয়পুর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে রূপের দেওরালা গ্রামে রূপ এখন সতী মাতা। গ্রামবাসীদের কাছে রূপ একজন দেবী! পর্যটক-দর্শনার্থীদের কাছে আকর্ষণের স্থান। আর ভারতের কাছে এক লজ্জা!
রোদ ঝলসানো শেখাওয়াটি অঞ্চলে, দেওরালা গ্রামে রাজপুত এবং আগরওয়াল গোষ্ঠীর পুরনো হাভেলি আছে প্রচুর। ১৯৮৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর যে জায়গায় রূপকে তাঁর মৃত স্বামীর সঙ্গে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সেটি আজও রাজপুত গর্বের এক প্রতীক। গ্রামের পুরোহিতরা বলেন, যেহেতু এই সতীদাহ, ১৯৮৭ সালের আইনের আগে হয়েছিল তাই এই জায়গায় একটি মন্দির তৈরি করা উচিত। জনগণের বিশ্বাস নাকি মিশে আছে রূপ হত্যার এই জায়গার সঙ্গে। আর সতী রূপ কানওয়ারের মন্দির তৈরি হলে গ্রামের জন্য আর্থিকভাবেও তা উপকারী। গ্রামে ভিড় হবে, পর্যটক মানেই টাকা, টাকা মানেই উন্নয়ন।
আরও পড়ুন- নির্লিপ্ত মুখে চিতায় ঝাঁপ, বাংলার শেষ সতীদাহের ঘটনা অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেবে
যেসব মহিলা গোষ্ঠী সতীদাহ প্রথা এবং রূপকে পুড়িয়ে মারাকে গৌরব হিসেবে দেখার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, তাদের কাছে দোষীদের খালাস করে দেওয়াটা বিশ্বাসঘাতকতার সামিল! রাজস্থানের মাটিতে কীভাবে কুসংস্কার, অযৌক্তিক বিশ্বাস আইনকেও প্রভাবিত করে রেখেছে এই ঘটনা তো সেসবেরই প্রমাণ। রূপ কানওয়ারের মৃত্যুর ঘটনা তখন ভারতবর্ষকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এই ঘটনার জেরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হরিদেব যোশী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৮৭ সালে একটি নতুন আইন আনা হয় যাতে সতীদাহ তো বটেই, সতীদাহের গৌরবকেও অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। তাতে কীই বা এসে যায়! ২০২৪ সালে এসে রূপের মামলাটির নিষ্পত্তি হলো। কীভাবে হলো? কেউ দোষীই না। এই ২০২৪-এর ভারতে সতীদাহকে মান্যতা দিয়ে দিল আদালতও!
রূপ কানওয়ার কি স্বেচ্ছায় স্বামীর সঙ্গে সহমরণে গেছিলেন না কি তাঁকে নেশাগ্রস্ত করে চিতায় টেনে আনা হয়েছিল? সেই ১৮২৯ সাল থেকে ভারতে সতীদাহ নিষিদ্ধ। তারপরেও এই ১৯৮৭ সালে, খুব বেশিকাল আগেও না, সতীদাহ হয়েছিল ভারতে। ২০০০-এর পরেও হয়েছে। উদযাপন হয়েছিল রূপ কানওয়ারের খুন! রূপের মৃত্যুর এক বছর পরে, 'রূপ কানওয়ার সতী কি জয়' স্লোগান দিয়ে একটি অনুষ্ঠানে উৎসব করার সময় সতীদাহকে মহিমান্বিত করার অপরাধে ৪৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তারপর বড়ি বড়ি দেশো মে যেরম ছোটি ছোটি ঘটনা ঘটে! আদালতে মামলা গড়াতে গড়াতে স্তিমিত হয়ে যায় আন্দোলন। ১৯৯৬ সালেই রূপের শ্বশুর এবং দেওরসহ ৩২ জনকে হত্যার মামলা থেকে খালাস করা হয়েছিল। ওই ৪৫ জনের মধ্যে ২৫ জনকে ২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে মুক্তি দেওয়া হয়। ২০২৪ সালের অক্টোবরে শেষ ৮ জনকেও ছেড়ে দেওয়া হলো। এই বিচারের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে আরও ৮ জন মারা যায় এবং চারজন পলাতক। অর্থাৎ রূপ কানওয়ারের মামলা শেষ! আদালতে কোনও মুলতুবি ফাইল নেই। আদালত বলেছে, কেউ রূপকে চিতায় ধাক্কা দেয়নি, পুড়িয়ে দেয়নি, কেউ রূপের মৃত্যুকে গৌরবান্বিত করেনি।
প্রতি বছর ভাদ্র মাসের পূর্ণিমায় রাজস্থান এবং গুজরাত থেকে শয়ে শয়ে মানুষ রূপ কানওয়ারের সতীদাহের বার্ষিকী পালন করতে এখানে আসেন। ভোজন চলে। একটি হত্যার উদপযাপনে নেমে পড়ে ভারতবর্ষের বহু মানুষ। এমনকী রূপের বোনও! গত বছর, রূপ কানওয়ারের বোন স্থানীয় এক মন্দিরে বিশেষ অনুষ্ঠান করে ১২ জন ব্রাহ্মণ দম্পতিকে খাইয়েছিলেন। দিদি তো সতী, দিদি তো এখন দেবী, সতী মা! রূপের ভাইও মনে করেন সতীদাহ করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।
রূপ কানওয়ারের ভাই গোপাল সিং রাঠোর। ১৯৮৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বরের সেই দিন, যখন বোনকে পোড়ানো হচ্ছে, সেই মুহূর্তটিকে গর্বের বলে মনে করেন আজও। দ্য প্রিন্টকে একটি সাক্ষাৎকারে গোপাল বলেছিলেন, “রান্না করার সময় যদি আপনি কোনও গরম কড়াইয়ের ছ্যাঁকা খান তাতেই কত ব্যথা লাগে। ও চিতার উপর বসেছিল!” রূপের নাকি ছোট থেকেই ভারী বিশ্বাস এসবে। “ছোটবেলাতেও ও সতী মন্দিরে যেত,” বলেছেন গোপাল। সেই দিন যখন দিদিকে চিতায় জ্যান্ত পোড়ানো হচ্ছে, গোপাল বলছেন, “আমি যখন পৌঁছলাম, মহিলারা চিতার চারপাশে পরিক্রমা করছিলেন। আমাদের বলা হয়েছিল রূপ স্বেচ্ছায় সতী হয়েছে এবং আমি ওর জন্য খুব গর্বিত।”
খবরাখবর নিয়ে দেখা গেছে, স্বেচ্ছায় নয়। তিন গ্রামবাসী সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, রূপ কানওয়ারকে সতী হতে বাধ্য করা হবে বলে সন্দেহ ছিলই। একটি ধানের মড়াইয়ের আড়ালে লুকিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল রূপ। কিন্তু ধরা পড়ে যায়। জোর করে টেনে নিয়ে গিয়ে চিতার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল রূপকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, শ্মশানে যাওয়ার পথে রূপকে হোঁচট খেতেও দেখেছেন তারা। পুলিশও সন্দেহ করেছিল মাল সিংয়ের ডাক্তার রূপকে বিশেষ ওষুধের ইনজেকশন দিয়েছিলেন।
রূপের পক্ষাঘাতগ্রস্ত দেওর ভূপিন্দর সিং শেখাওয়াত রূপ আর তাঁর স্বামী মাল সিংয়ের মন্দিরের দেখভাল করেন। পরিবারের বাকিরা থাকেন জয়পুরে। ভূপিন্দর ভালো করে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। তবুও বলে যান আজও, যেখানে রূপের চিতা ছিল সেখানে একটি মন্দির তৈরি করতে হবে।
রূপের এই মন্দিরে তাঁর বিয়ের ফটো রাখা। স্বামীর পাশে গোলাপি লেহেঙ্গায় সজ্জিত ১৯ বছরের তরুণী। একা রূপ কানওয়ারের কোনও ছবি নেই। না থাকারই তো কথা! পতির পূণ্যে সতীর পূণ্য! সে সতী, গৃহে গৃহে পূজিতা স্ত্রী। অথচ এই দেবী হয়ে যাওয়া রূপ কানওয়ারকে যৌতুক হিসাবে ৪০ ভরি সোনা, ৩০,০০০ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট, একটি রঙিন টিভি, রান্নার জিনিসপত্র এবং ফ্রিজ দিতে হয়েছিল। স্বামী মাল সিং তো অসুস্থ ছিলেন। বিয়ের মাত্র সাত মাস পর মারা যান তিনি। কোনও উত্তরাধিকারীও জন্মায়নি তাঁদের। চাইলে এই পণের সম্পত্তি নিয়ে মায়ের ঘরে ফিরে যেতেই পারতেন রূপ। কিন্তু রূপকে তো সতী হতে হবে। পুড়ে মরতে হবে। স্বামীর ঘর ছেড়ে মায়ের ঘরে তো মেয়েরা ফেরে না আজও তেমন ব্যাপকভাবে।
আরও পড়ুন- এই ঘাটেই সহমরণে যেতেন মহিলারা! কলকাতার বুকে আজও দগদগে ঘা সতীদাহ ঘাট!
রূপ মরে গেছেন, যেমন অজস্র মহিলা মরেন, খুন হন। কিন্তু মন্দির তো গড়তেই হবে! হাজার হাজার দর্শনার্থী আসবে গ্রামে, স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। কুটির শিল্প গড়ে উঠবে মন্দিরগুলির চারপাশে। সিকর, ঝুনঝুনু এবং নিম কা থানা সহ রাজস্থানের এই শেখাওয়াটি অঞ্চল সতী বেল্ট হিসেবে পরিচিত, এখানে ১০০ টিরও বেশি সতী মন্দির রয়েছে। সবচেয়ে বড় এবং প্রাচীনতম মন্দিরটি হচ্ছে ঝুনঝুনুর রানি সতী মন্দির। স্বাধীনতার পর থেকে, এই মন্দিরের ২০০ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে কমপক্ষে ২৮ জন বিধবাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে চিতায়! সতীপুজোর বিরুদ্ধে ১৯৯৬ সালে দায়ের করা একটি রিট পিটিশন এখনও রাজস্থান হাইকোর্টে বিচারাধীন।
দেওরালার ৫ থেকে ২০ কিলোমিটারের মধ্যে বেশ কয়েকটি সতী মন্দির রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ওম কানওয়ার সতী মাতা মন্দির। ১৯৮০ সালে ১৬ বছর বয়সি ওমকে চিতায় পুড়িয়ে মারা হয়েছিল৷ কাছেই দেবীপুরায় আছে 'জীবন্ত সতী' মন্দির। এটি এমন একজন মহিলাকে উত্সর্গীকৃত যাকে পুলিশ উদ্ধার করেছিল ঠিকই কিন্তু প্রাণে বাঁচলেও জীবনের বাকি দিনগুলি নির্জনে কাটিয়েছিলেন তিনি৷ রাজস্থান এবং উত্তরপ্রদেশের ইউটিউবাররা সতী মন্দিরের ভার্চুয়াল ট্যুরের অফার দেয় এখন। সেই সব পুরোহিতদের সাক্ষাৎকার নেয় যারা এই প্রথাকে গৌরবের বলে মনে করে আজও।
রামমোহন সেই কোনকালে আইন আনলেন লড়াই করে, এতকাল পরেও সতী হয়ে মরা 'মহৎ মৃত্যু’। রাজপুত মহিলাদের আত্মসম্মান রক্ষায় জহর ব্রতর পরেই দ্বিতীয় স্থানে আছে সতীদাহ প্রথা। সতীদাহে মেয়ের মৃত্যু মহিলাদের জন্য তেমনই বীরত্বপূর্ণ, যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে কোনও পুরুষের মৃত্যু। কেউ কেউ এমনও বিশ্বাস করেন যে সতীদাহ একজন নারীকে রাজপুত পুরুষ হিসেবে পুনর্জন্মের সম্মান দেয়।
২০০২ সালে, মধ্যপ্রদেশের পান্না জেলার তামোলি পাটনা গ্রামে একটি সতীদাহের ঘটনার খবর মেলে। তিন বছর পরে, উত্তরপ্রদেশের বান্দায় আরেকটি ঘটনা ঘটে। ২০০৬ সালে, মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলে আরও দুটি সতীদাহের ঘটনা প্রকাশ্যে আসে যাতে একজন মহিলা অল্পের জন্য বেঁচে যান, অন্যজন মারা যান। এত লড়াইয়ের পরেও সতী হতে হয় মেয়েদের। এত বেটি বাঁচাওয়ের পরেও সতী হতে হয়। আর যারা হতে চান না, যারা এর বিরুদ্ধে লড়েন, তাঁদের গোঁড়া পুরুষরা বলেন, 'বাজারি অউরতে'। এই কুসংস্কার বাঁচাতে গঠিত সতী ধর্ম রক্ষা সমিতি জয়পুরে প্রায় ৭০,০০০ পুরুষের এক সমাবেশের আয়োজন করেছিল। তলোয়ার হাতে সেই পুরুষরা বলেছিলেন, “আমাদের বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করবেন না।" মন্দিরের দাবি কখনই ম্লান হয়নি। এখন শেষ অভিযুক্তও মুক্তি পেয়েছে, দলে মন্দিরের দাবি নতুন করে গতি পেয়েছে। এই ভারতবর্ষে এমন লজ্জাকে আজও উদযাপন করা হয়। গৌরী লঙ্কেশের হত্যাকারীরা ছাড়া পায়। বিলকিস বানোর ধর্ষকরা মুক্তি পায়, এমন ঘটেই থাকে।