উত্তাল সত্তরে যেভাবে দাপট দেখিয়েছিল সিপিএম-এর সশস্ত্র বাহিনী

CPIM Action Squad: যাদবপুরের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকজন নকশালপন্থী ছাত্র-যুব খুন হয় সিপিআইএম সশস্ত্র বাহিনীর হাতে।

ষাট-সত্তর দশক জুড়ে কলকাতা লাগোয়া উত্তর এবং দক্ষিণ শহরতলিতে কংগ্রেস, নকশাল এবং সিপিআইএম-এর মধ্যে যে সশস্ত্র লড়াই চলেছিল তা কোনও বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন এলাকাভিত্তিক সমীকরণের উপর দাঁড়িয়ে ছিল না। বরং বলা যায়, এলাকায় এলাকায় যে সংঘর্ষ দেখা গেছে তার নীল নকশা ছিল সুপরিকল্পিত। উঁচু মাথার সিদ্ধান্ত ছিল পেছনে, যা এক এক এলাকায় এক এক ভাবে ফুটে বেরিয়েছে।

ষাটের শেষ আর সত্তরের শুরুতে এই সশস্ত্র লড়াইয়ের রাজনৈতিক ভিত্তি বুঝতে গেলে একটু পিছিয়ে যেতে হবে। আপাতত আমরা মনোনিবেশ করব বৃহত্তর যাদবপুরের দিকে। পঞ্চাশের দশক। উদ্বাস্তুরা এসেছেন। এলাকার রাজনীতিতে একটা বদল আসছে। সেই এক সময় ছিল, যখন ধাপা থেকে গড়িয়া পর্যন্ত হাজার হাজার বিঘা জমির মালিক ছিলেন কয়েকজন জমিদার । যেমন নস্কর পরিবার, বিহারী মণ্ডল কিংবা বারুইপুরের রায়চৌধুরী এবং এরকম আরও ক'জন ছিলেন এই বিপুল জমির মালিক। এই জমিদারদের প্রভাবও ছিল বিপুল। জমি এবং জমিদারি রক্ষায় এদের এক একটি পরিবারের হাতে ছিল লেঠেল বাহিনী। জমিদাররা ছিলেন কংগ্রেস সমর্থক। জমিদারির পাশাপাশি লেঠেলদের তারা রাজনৈতিক কারণেও ব্যবহার করতে লাগলেন। বিশেষত বাম কৃষক আন্দোলন দানা বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে জমিদারদের লেঠেল বাহিনী সক্রিয় হয়ে উঠল বামেদের বিপক্ষে। বৃহত্তর যাদবপুর অঞ্চলে এমনই এক দুর্ধর্ষ লেঠেল আতঙ্কের অপর নাম হয়ে উঠল। নাম কানাই কুমির। কানাই কুমির, জীবন কুমির আর মাধাই কুমির— তিন ভাই। তিন ভাই-ই জমিদার পুষ্ট লেঠেল। তিন ভাই-ই এলাকায় ত্রাস। এর মধ্যে কানাই ছিল ভয়ংকর। লুঠ, সন্ত্রাস, মেয়েদের ওপর অত্যাচারের প্রশ্নে তিন ভাই-ই ছিল এক একজন মূর্তিমান আতঙ্ক।

বৃহত্তর যাদবপুরে বামপন্থীদের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন মাথা চাড়া দিলে কানাই কুমিরদের আক্রমণ বেড়ে গেল এলাকায়। উদ্বাস্তুদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল কানাইরা। সেদিন কুমিরদের বিরুদ্ধে পাল্টা লাঠি, চ্যালা কাঠ, শাবল ধরে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন ছিলেন দুই বন্ধু। দুই রাজনৈতিক কর্মী। হরিহর আত্মা। আশু মজুমদার আর কান্তি গাঙ্গুলি। কংগ্রেসি জমিদারদের বিরুদ্ধে এলাকার কৃষকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অন্য অনেক নেতাদের সঙ্গে কান্তি-আশু জুটি ছিল সদা তৎপর। জমি নিয়ে, জমিদারদের জমিতে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের মতো নানা ঘটনা নিয়ে বিবাদ আর লড়াই লেগেই থাকত। কানাই কুমির ছিল দুর্ধর্ষ দুষ্কৃতী। কুমির ভাইদের এতটাই দৌরাত্ম্য বেড়ে গিয়েছিল যে জমিদাররাও ত্রাহি ত্রাহি করছিল। এরই মধ্যে মাছের ভেড়ির দখল নিয়ে জমিদারদের সঙ্গে বিরোধ বাঁধল জীবন কুমিরের। শোনা কথা, জীবনের মৃত্যুর পেছনে জমিদারদেরই হাত ছিল। মাধাই কুমিরও মারা যায়। তার দেহ আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ এই মৃত্যুর জন্য সিপিআইএম অ্যাকশন স্কোয়াডকে দায়ী করে। বাকি থাকল কানাই। একবার জেল বন্দি হলো কানাই। কিন্তু জেল থেকে আদালতে যাওয়ার পথে প্রিজন ভ্যান ভেঙে পালিয়ে গেল। এসেই থানার ফাঁড়ি আক্রমণ করে বসল। পুলিশকে আক্রমণ করল কানাই বাহিনী। পরে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে ১৯৭৮ সালে পুলিশি এনকাউন্টারে মারা যায় কানাই কুমির। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভার সদস্য হায়দার আজিজ সফী তখন শীর্ষ পুলিশ কর্তা। কানাই কুমিরকে এনকাউন্টারের পেছনে তাঁর ভূমিকা ছিল।

আরও পড়ুন- ভবানীপুরের ডন, কুঁদঘাটের বোম! দক্ষিণ কলকাতা কাঁপাতেন যে মস্তানরা

কিন্তু কানাই যতদিন জীবিত ছিল, বামেদের কাছে ছিল ত্রাস! কানাই এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসল ১৯৭৩ সালে। কালিকাপুর কৃষক সমিতির সম্পাদক নিতাই নস্করকে কালীপুজোর রাতে আমন্ত্রণ জানাল কানাই। যুদ্ধবিরতি নিয়ে কথা বলতেই পুজোয় আমন্ত্রণ। কিন্তু এমন ভয়ংকর পরিণতি হবে কে ভেবেছিল! কানাইয়ের ডেরায় নিতাই নস্কর পৌঁছন কিন্তু আর ফিরে আসেন না। কালীপুজোর রাতে খুন হন নিতাই নস্কর। কেউ কেউ বলে বেড়াতে থাকে, কালীপুজোয় নরবলি দিয়েছে কানাই কুমির। কালিকাপুর-ধাপা জুড়ে লড়াই আরও তীব্র হয়ে উঠল। সেদিন কানাই বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কৃষকদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আশু আর কান্তি নামের দুই যুবক।

এরপর প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে এই সব অঞ্চলে বামপন্থীরা ক্ষমতার স্বাদ পেল। আবার জমিদারদের সামাজিক প্রভাব জোরদার থাকায় এই সব অঞ্চল জুড়ে বাম আর কংগ্রেসি রাজনীতিতে তীব্র এক পরিবেশ তৈরি হলো। এর মধ্যে ঘটল নকশালবাড়িতে পুলিশের গুলিতে কৃষক হত্যা। এই ঘটনা গোটা রাজ্যের ছাত্র যুব সমাজে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করল। এই ঘটনা যাদবপুরের বিখ্যাত দুই বন্ধুর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাল। আশু মজুমদার হলেন শীর্ষ নকশালপন্থী আর কান্তি গাঙ্গুলি চালিয়ে গেলেন সিপিআইএমের হয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজ। তবে এই পর্যায়ে দুই বন্ধুর মধ্যে রাজনৈতিক আলোচনা হয়েছে। পরস্পরকে নিজেদের মতাদর্শে নিয়ে আসতে দুই বন্ধুর কেউই কসুর করেননি। তবু রাজনীতিই বিচ্ছেদের কারণ হয়ে দাঁড়াল।

যুবক কান্তি গাঙ্গুলি

বন্ধু নকশালপন্থী হয়ে যাওয়ার পর কান্তি গাঙ্গুলি একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। সেবার সারা ভারত কৃষক সভার সম্মেলন হচ্ছিল মাদুরাইতে। কান্তি গাঙ্গুলি এবং জয়ন্ত ভট্টাচার্য সম্মেলনে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, নকশালবাড়ির কৃষক হত্যা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করুক সংগঠন। যদিও সেই দাবি নাকচ করে দেওয়া হয়। ১৯৬৯ সালে যাদবপুর, হালতু, কসবা, গড়ফা আশুর নেতৃত্বে নকশাল ঘাঁটিতে পরিণত হয়। এই সময় গোটা রাজ্যে নকশালপন্থী রাজনীতি হু হু করে বাড়ছে। অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে বাংলা কংগ্রেস তৈরি হওয়ায় কংগ্রেস দুর্বল হয়েছে। তবে ছাত্র রাজনীতি সংগঠিত করে বাংলায় ঘুরে দাঁড়াতে চাইছেন ইন্দিরা গান্ধি। এই পরিস্থিতিতে ১৯৭০ সালে সিপিআইএম গারুলিয়া প্লেনাম সংগঠিত করে। ওই প্লেনাম থেকে 'পার্শিয়াল পার্টিজান ওয়ার'-এর ডাক দেওয়া হয়। এই ইতিহাস না বুঝলে ওই সময়ের আখ্যানে ফাঁক থেকে যাবে। সহজ কথায়, কংগ্রেস এবং নকশালদের সঙ্গে যুঝতে গেরিলা যুদ্ধের ডাক দেয় সিপিআইএম— এটাই পার্শিয়াল পার্টিজান ওয়ার। এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে সিপিআইএম উপদ্রুত এলাকায় সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলল। সিপিআইএমের ভাষায় প্রতিরোধ বাহিনী আর কংগ্রেস-নকশালদের বয়ানে ঘাতক বাহিনী। যাইহোক, একদিকে কংগ্রেস সংগঠন এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত মস্তান ও লুম্পেন বাহিনী, আরেকদিকে সশস্ত্র নকশাল বাহিনী! এবার আরও সংগঠিতভাবে মাঠে নামল সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনী। ফলে লড়াই জমে উঠল। সত্তর দশক সরগরম।

উপদ্রুত অঞ্চল চিহ্নিত করার কাজ শুরু হলো। অতি স্পর্শকাতর এলাকা হিসেবে বেলঘড়িয়া, দমদম, পানিহাটি, সোদপুর, যাদবপুর, টালিগঞ্জ, সোনারপুরকে চিহ্নিত করলো পার্টি। এই এলাকাগুলিতে বাহিনী গড়ার কাজ শুরু হলো। সেই সময় যাদবপুরে সিপিআইএমের একটিই লোকাল কমিটি ছিল। হালতু থেকে পুঁটিয়ারি, এই দীর্ঘ এলাকা ছিল সেই লোকাল কমিটির আওতায়। এই এলাকা রাজনৈতিকভাবে ছিল অতি স্পর্শকাতর। পুঁটিয়ারির দিকে প্রভাব ছিল কংগ্রেসি ডন ননী দত্তের। প্রথম জীবনে ননী দত্তর চ্যালা, পরবর্তীকালে বিখ্যাত নকশাল স্কোয়াড কমান্ডার ননী আইচও সক্রিয় ছিলেন এই সব অঞ্চলে। টালিগঞ্জে মস্তানদের অভিভাবক ছিলেন ফ্যাতন গোস্বামী, যার হাত ধরে ইনু মিত্তির, ভানু বোস, গোপাল পাঁঠারা দক্ষিণের কাণ্ডকারখানায় অংশ নিতেন, নজর রাখতেন। পাশেই বিজয়গড়ে ছিলেন কংগ্রেসের নিখিল বসু রায়। বাঘাযতীন শাসন করত কানা অজিত, দুলু চন্দরা। আর রেল লাইন পেরোলেই কানাই কুমিরের এলাকা। আর ছিলেন নকশাল নেতা আশু মজুমদার। মেধা, সংগঠন, অস্ত্রশক্তি সবেতেই জোরালো। এই প্রতিপক্ষের মুখে দাঁড়িয়ে বাহিনী গড়ল সিপিআইএম। সশস্ত্র বাহিনী। এই বাহিনীর জন্য চারজন কমান্ডার নিযুক্ত হলেন। কান্তি গাঙ্গুলি, পল্টু ভট্টাচার্য , সঞ্জয় পুততুণ্ড এবং পরিমল সেনগুপ্ত। এই চার কমান্ডারের নেতৃত্বে চারটি বাহিনী।

বাহিনী মানে বাহিনীই। ভোরবেলা উঠতে হতো বাহিনীর সদস্যদের। চলত গেরিলা কায়দায় লড়াইয়ের ট্রেনিং। ট্রেনিং দিতেন এক অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্তা। অবশ্যই পার্টির লোক। এই বাহিনীর কার্যকলাপ গোটাটাই জানতেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। রাজ্যস্তরে এই বিষয়গুলো নজরদারি করতেন সুভাষ চক্রবর্তী, লক্ষণ ভট্টাচার্য , রাধিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার পার্টির তরফে বাহিনীর অভিভাবক ছিলেন শান্তিময় ঘোষ ওরফে বাচ্চুদা।

আরও পড়ুন- মস্তান থেকে মন্ত্রী! দাঁড়িয়ে থেকে গোটা বাজার লুঠ করিয়েছিলেন রাজ্যের এই মন্ত্রী

প্রাথমিকভাবে লড়াই চলত উদ্বাস্তু অঞ্চলে চ্যালা কাঠ নিয়ে। লাঠি, বোমা, বাঁশ এই নিয়ে বাহিনী বাহিনীতে লড়াই হতো। যেকোনও বাহিনীরই অস্ত্র ছিল এই সব। মধ্য কলকাতায় আবার পঞ্চাশের দশকে মারপিটের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো সোডার বোতল। কলেজে কলেজে মারপিটে খুব জনপ্রিয় ছিল এই বস্তু। সোডার বোতল বিকট আওয়াজ করে ফাটতো রাস্তায়। বোতলের ভাঙা কাচ বুকে বিঁধে মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে বহু লোকের। মধ্য কলকাতা বেলেঘাটায় আরও একটা জনপ্রিয় অস্ত্র ছিল, সোর্ড। ছিল নানা কিসিমের চাকু, ছোরা। রাইফেল, স্টেনগান, পিস্তল থাকত নামকরা ডনদের কাছে। ওসব প্রতিদিনের ব্যবহার্য ছিল না মোটেই। কিন্তু নকশাল অভ্যুত্থান শুধু তাত্ত্বিক রাজনীতির ক্ষেত্রেই না, অস্ত্রের চরিত্রেও বদল আনল। সিপিএম, কংগ্রেস নির্বিশেষে এই বদলে সামিল হলো। দৈনন্দিন লড়াইয়েও অস্ত্রের ব্যবহারে পরিবর্তন এল। সিপিআইএমের বাহিনীতেও নতুন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার শুরু হলো সংগঠিত ভাবে। এই সব অস্ত্র কংগ্রেস, নকশালও ব্যবহার করেছে । সেই সময় যেসব অস্ত্র ব্যবহার চালু হলো তা মোটের ওপর এইরকম:

১। ওয়ান শর্টার, যা স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন লেদ মেশিনে তৈরি হতো । বিভিন্ন লেদ কারখানায় গভীর রাতে তৈরি হতো এই অস্ত্র।

২। বিভিন্ন ধরনের বোমা। ছোট জর্দার কৌটোয়, বড় কৌটোয় বোমা তৈরি হতো। এছাড়া ছিল সিগারেটের প্যাকেটে বোমা। বোমা তখন হস্তশিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

৩। মুক্তিযুদ্ধের সময় অরক্ষিত বর্ডার পেরিয়ে নিয়ে আসা হতো অস্ত্র। টমী গান, ছোট কামান, থ্রি-টু রাইফেল, ফোর-ফাইভ রিভলবার।

৪। মলোটভ ককটেল। কাঁচের বোতলে পেট্রোল ভরে বিশেষ রাসায়নিক দিয়ে তৈরি হতো ককটেল। ছোড়ার আগে ঝাঁকিয়ে শক্ত জায়গা লক্ষ্য করে ছুঁড়লেই ফেটে গিয়ে আগুন লেগে যেত। সিআরপিএফের জিপ লক্ষ্য করে এইসব বস্তু ছোড়ার একটা রেওয়াজ ছিল। সহজেই আগুন লেগে যেত জিপে। এসব জিনিস সিপিআইএম এবং নকশালপন্থীরাই বেশি ব্যবহার করত।

৫। এক অকথিত ইতিহাস লোকমুখে আজও বেঁচে আছে। বিষয়টি বিতর্কিতও বটে। প্রকাশ্যে এটা নিয়ে কেউ মুখ খুলবে না, তবে গোপনে গোপনে জানে অনেকেই। এই সময় ভারত সরকারের অধীন যন্ত্রাংশ নির্মাণের জন্য বহু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ছিল। এই সব সংস্থায় জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন ছিল বামেদের। শোনা যায়, ইউনিয়নের মদতে এইসব আধুনিক কারখানায় আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি হতো। যা গোপনে বহু হাত ঘুরে এসে পৌঁছত 'পার্টিজান ওয়ার'-এর যোদ্ধাদের হাতে।

যাইহোক, সিপিআইএমের বাহিনীর মধ্যে সারা রাজ্যে দু'টি নাম সেই সময় মুখে মুখে ফিরতে লাগল। এক, বেলঘড়িয়ার ননী সাহা এবং যাদবপুরের কামারপাড়ার খোকা দাস। এই দুই নাম প্রতিপক্ষের কাছে ত্রাসের অপর নাম হয়ে ওঠে। কামার পাড়ায় সিআরপিএফের গাড়ি পর্যন্ত ঢুকত না। কারণ ওদের কাছে খবর ছিল, খোকা দাসের কাছে কামান আছে। এই কামান ধরাও পড়েছিল। সেই সময়কার সংবাদপত্রে এই সংবাদ ছাপাও হয়েছিল। তবে খোকা দাসের সংগ্রহে ছিল আরও ভয়ঙ্কর বস্তু। তার নিজের টিমের লোকদের দিয়ে বানানো বড় আমুলের কৌটয় তৈরি বোমা। ওপর থেকে যদি পড়ে আর দেখতে হবে না। পাঁচ-ছ'টা স্পট ডেথ কনফার্ম! খোকা দাস পরবর্তীকালে পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হয় কিন্তু সত্তরের দশকে সিপিএমের হয়ে লড়াইয়ে প্রথম নাম ছিল খোকা দাস। খোকা দাস ছিল পল্টু ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন বাহিনীতে। ওই বাহিনীতে আরও গুরুত্বপূর্ণ নাম ছিল শিবু রায় চৌধুরী, মোহিত বর্মন। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই খোকা তার নিজস্ব ক্যারিশমায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

সেই সময় লায়েলকা মাঠ ছিল যেন যুদ্ধক্ষেত্র। বিজয়গড় দশ নম্বর মহল্লা দখল নেওয়ার পর নিখিলের নেতৃত্বে কংগ্রেস হয়ে উঠল অপ্রতিরোধ্য। পাশের রিজেন্ট এস্টেট তখন ফাঁকা জমি। পাশেই লায়েলকা। এ পাড়টা কংগ্রেসের অবাধ ক্ষেত্রভূমি হয়ে দাঁড়াল। লায়েলকা দখল নিতে পারলেই ওপারে সিপিএম বেল্টগুলো দখল নেওয়া যায়। এই লক্ষ্যে নিখিল বাহিনী ছক কষছে। আর পাশে বাঘাযতীনে নিখিলের বড় ভরসা কানা অজিত এবং দুলু চন্দরা, যারা পাশ থেকে সাহায্য করবে। এই পরিস্থিতিতে বাম শিবিরের পক্ষে পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল খোকা দাস। সত্তরের ওই অশান্ত সময় লায়েলকা মাঠের এক প্রান্তে নিখিল বাহিনী, আর অন্য প্রান্তে খোকা বাহিনী। সকাল থেকে শুরু হতো বোমাবাজি । বোমার শব্দে চারপাশের লোক বুঝত লড়াই শুরু হয়ে গেছে। সেই সময় বিজয়গড়ের জাগরণী ক্লাবে সিআরপিএফ ক্যাম্প তৈরি হলো। স্বভাবতই উজ্জীবিত কংগ্রেস শিবির। লায়েলকা মাঠের লড়াই আরও বেড়ে গেল। ১৯৭৩ সাল নাগাদ লায়েলকার মাঠে এনকাউন্টারে প্রাণ হারাল বিজয়গড়ের খোকা চক্রবর্তী। সিপিআইএম অ্যাকশন স্কোয়াডের এক উজ্জ্বল নাম। পার্টির তরফে খোকার কাছে ফিলার পাঠানো হচ্ছিল। "এলাকায় বিপদ বাড়ছে। এবার এলাকা ছাড়ো।" কিন্তু নিজের জায়গা ছাড়তে রাজি হয়নি খোকা চক্রবর্তী। নিজের এলাকাতেই খুন হয়ে গেল। খোকা খুন হতেই বিজয়গড়ে সিপিআইএমের প্রতিরোধ অনেকটাই আলগা হয়ে গেল।

খোকা চক্রবর্তী চলে গেলেও খোকা দাস স্বমহিমায় ক্যারিশমা দেখিয়ে চলল। একটা কথা মনে রাখতে হবে, খোকা দাস ছিলেন সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনীর তদানীন্তন কমান্ডার ইন চিফ কান্তি গাঙ্গুলির ডান হাত। বিভিন্ন অ্যাকশনে খোকার ওপরেই ভরসা রাখতেন কান্তি। এই সময়ই সিআরপিএফের বন্দুক চুরি গেল। কেউ কেউ বলল, এর পেছনে রয়েছে খোকা দাস। কেউ কেউ আবার এই ঘটনার জন্য নকশালপন্থীদেরই দায়ী করে। তবে ঘটনাটা সেই আমলে আলোড়ন ফেলেছিল।

আরও পড়ুন- যৌনকর্মী, বেপরোয়া প্রেমিকা! কে ছিলেন কলকাতার প্রথম মহিলা মস্তান নির্মলা দাসী?

শান্তিময় ঘোষ (বাচ্চুদা)

যাদবপুর স্টেশন লাগোয়া অঞ্চল তখন ধু ধু মাঠ। লাল রঙের যাদবপুর স্টেশন দাঁড়িয়ে আছে। সিআরপিএফ জওয়ানরা দেখলেন, একদল যুবক মাঠে ফুটবল খেলতে এসেছে। সিআরপিএফ জওয়ানরা নিশ্চিন্তে স্টেশনে বসে। শান্ত পরিবেশ। কয়েকজন পাশে আগ্নেয়াস্ত্র হেলান দিয়ে রেখে বসে আছেন। হঠাৎই ফুটবল পায়ে নাচাতে নাচাতে ফৌজিদের একেবারে কাছে চলে এল যুবকের দল। সিআরপিএফ জওয়ানরা ভাবছেন, বল এদিকে চলে এসেছে তাই বলের গতিতে খেলোয়াড়রাও তাদের সামনে এসে গেছে। আসলে কী ঘটতে চলেছে আঁচই করতে পারেননি তারা। সবুজ প্রান্তর, জোলো বাতাস আর ফুটবল খেলায় মজে ছিল ওদের মন। ঠিক তখনই অতর্কিতে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা রাইফেলগুলো ছিনিয়ে নিয়ে স্টেশনের বাইরে লাফিয়ে নামল খেলোয়াড়ের ছদ্মবেশে থাকা যুব বাহিনী। বন্দুক উঁচিয়ে তাড়া করল আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা। ততক্ষণে সবুজের বিরাট ক্যানভাসে হোগলা বনে কোথায় যেন ডুব দিয়েছে দুর্ধর্ষ সব যুবকের দল। খবর রটে গেল, চিরুনি তল্লাশির জন্য খ্যাত বা কুখ্যাত সিআরপিএফের বন্দুক খোয়া গেছে।

সিআরপিএফের ওপর একটা বড় হামলার ঘটনা ঘটেছিল সেই একই সময়ে। সেই হামলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সিপিআইএম অ্যাকশন স্কোয়াডের নাম। যাদবপুর রেল স্টেশন থেকে বাঘাযতীন স্টেশন যেতে বাঁ পাশ জুড়ে ছিল সবুজ প্রান্তর, হোগলা বন। এই হোগলা বন তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র বাহিনীর দখলে। এই প্রান্তিক অঞ্চলেই এক গভীর রাতে আশ্রয় নিয়েছেন কান্তি গাঙ্গুলি, খোকা দাস সহ তিন যুবক। এদিকে, ভোর রাতে মাঠে প্রাতঃকৃত্য করতে বেরিয়ে গ্রামের এক কৃষক দেখেন কুয়াশা ভেদ করে বন্দুক উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে সিআরপিএফ। কান্তি গাঙ্গুলি তখনও গ্রামের ভেতরে। এদিকে রেল লাইন ধরে কর্ডন করছে আধা সামরিক বাহিনী। গ্রামের লোকেরা এসে ঘুমন্ত কান্তিকে জাগায়। চারিদিকে তখন বুটের শব্দ। কীভাবে পালাবেন? কোন পথে? গোল করে গোটা এলাকা ঘিরে ফেলেছে সিআরপিএফ। গ্রামের মেয়েরা শীতের সকালে বাবুদের বাড়ি কাজ করতে যায় দল বেঁধে। তাদেরই একজন কান্তি গাঙ্গুলিকে একটা শাড়ি দিল। বলল, পরে নাও। কান্তি গাঙ্গুলির তখন রোগাটে চেহারা। মেয়েদের দেওয়া শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ঘোমটা টেনে দিলেন। চাদর মুড়িয়ে কান্তি গাঙ্গুলি ভিড়ে গেলেন কাজের মাসিদের দঙ্গলে। কুয়াশার মাঠ পেরিয়ে কাজের মাসিরা চলেছেন। সিআরপিএফ তাদের বাধা দিল না। সন্দেহও করল না। মেয়েদের দলে ভিড়ে কর্ডন পেরিয়ে বেরিয়ে গেলেন কান্তি। বাঘাযতীন পেরিয়ে চলে এলেন। এদিকে, খোকা দাস ওই কর্ডনের মধ্যে পড়ে। চিরুনি তল্লাশি শুরু হলো বলে। খোকা দাস সিপিআইএম অ্যাকশন স্কোয়াডের সম্পদ! কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর রটে গেল, বাঘ বন্দি হয়ে গেছে।

এরপর যে ঘটনাটি ঘটে তা যে কোনও অ্যাকশন মুভিকে হার মানাবে। খোকা দাসকে বাঁচাতে মরিয়া অ্যাকশন স্কোয়াডের সদস্যরা বোমা নিয়ে যাদবপুর থেকে ডাউন ট্রেনে ওঠে। ট্রেন ছাড়ে নির্দিষ্ট সময়ে। ট্রেন গতি নিতেই, দরজায় হাতল ধরে ঝুলে পড়ে শুরু হলো অ্যাকশন। রেল লাইন ধরে বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সিআরপিএফকে লক্ষ্য করে বোমা মারতে শুরু করে সিপিআইএম বাহিনী। এক একটা কামরা থেকে ধেয়ে আসে মুহুর্মুহু বোমা। হঠাৎ আক্রমণে হতচকিত আধা সামরিক বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আলগা হয়ে যায় কর্ডন। সুযোগ বুঝে গ্রাম থেকে বেরিয়ে যায় খোকা দাস ও অন্যান্য সহযোদ্ধারা। খোকা দাসকে বাঁচানো এতটাই জরুরি মনে হয়েছিল সিপিআইএম অ্যাকশন স্কোয়াডের। কামারপাড়ার খোকা দাস। সত্তরের যাদবপুরে সিপিআইএমের ভরসা আর কংগ্রেস-নকশালদের চোখে ত্রাসের আরেক নাম খোকা দাস!

এই খোকা দাসের বিরুদ্ধে নৃশংস হত্যার অভিযোগ তুলে এসেছে কংগ্রেস এবং নকশালপন্থীরা। খোকা দাসের কাণ্ড কারখানা নিয়ে পার্টিতেও সমালোচনা হয়েছে সেই অশান্ত সত্তরেই। একবার ট্রেনের ভেন্ডার বোঝাই ইলিশ মাছ লুঠের অভিযোগ ওঠে খোকা বাহিনীর বিরুদ্ধে। আর সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনায় দলের মধ্যেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল খোকা। দলেরই এক কর্মীকে হত্যার গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল খোকার বিরুদ্ধে। খোকা দাস ছাড়াও সেই সময় যাদবপুরে সিপিআইএম অ্যাকশন স্কোয়াডে আরও কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ নাম ছিল।

এই সময় জুড়ে যাদবপুরের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকজন নকশালপন্থী ছাত্র-যুব খুন হয় সিপিআইএম সশস্ত্র বাহিনীর হাতে। এর মধ্যে বাঘাযতীন জেকে স্টোর্সের বাড়ির ছেলে পলু, পরিমল দে একজন (কানা অজিত পর্বে এই ঘটনাটি বিস্তৃতভাবে দেওয়া আছে)। অন্যজন রজত ঘটক নামের এক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া। এই হত্যাকাণ্ডের পর গণ বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছিল সিপিআইএমকে। এলাকায় ভালো ছাত্র বলে পরিচিত রজত ঘটক নামের এই যুবক যে নকশালদের বড় সমর্থক একথা বুঝতে বাকি ছিল না কারও। তেমন একটা মেলামেশা রজত করতেন না কিন্তু নানা ঘটনা পরম্পরায় রজতের উপর নজর যায় সিপিআইএম বাহিনীর। একদিন বাড়ি থেকে রজতকে উঠিয়ে নিয়ে যায় তারা। এরপর বেধড়ক মার, মাথায় জোরালো আঘাতের জেরে ইন্টারনাল হ্যামারেজ হয়ে মারা যায় রজত। এই ঘটনা জনমানসে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সিপিআইএমকে বলতে হয়েছিল, তারা আদতে মারতে চায়নি রজতকে। এটা দুর্ঘটনা মাত্র। রজতের মৃত্যু সিপিআইএম সম্পর্কে নেতিবাচক ছবি তৈরি করেছিল এলাকার মানুষের মনে। এই সময় কংগ্রেস মস্তানরা সিআরপিএফকে পথ দেখাত। সেই সময় কংগ্রেস-সিআরপিএফ যৌথ আক্রমণে এই এলাকায় খুন হন বাপি সিনহা, বাবলু সিনহা নামে দুই ভাই। দুই ভাই-ই সিপিআইএম কর্মী হিসেবে এলাকায় পরিচিত ছিল।

আরও পড়ুন- এলাকার ত্রাস হয়েও কচুরির দোকান দিতে হয়েছিল মস্তান কানা অজিতকে

এসবের মধ্যেই সিআরপিএফের সক্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। সশস্ত্র সেই বধ্যভূমি শাসন করতে নতুন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা শুরু করল তারা। প্রবীণদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল চিরুনি তল্লাশির সেই সব দিন। ঘর থেকে হিড়হিড় করে যুবকদের বের করে আনার দিনগুলো। আধা সামরিক বাহিনী লক্ষ্য করছিল, রাত গভীর হলেই বাম, অতি বাম সশস্ত্র যুবকরা ঘরে ফিরে আসে। বিপুল অন্ধকারে তাদের যাতায়াত ঠাহর করা যায় না। এই সমস্যা মোকাবিলায় সিআরপিএফ ফ্ল্যাশ বম্ব, চলতি কথায় আলো বোমা ফাটাতে শুরু করে। আকাশের দিকে তাক করে ওই বোমা ফাটালে প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে একটা নির্দিষ্ট জায়গা আলো হয়ে থাকত। সেই সুযোগে বাড়ি বাড়ি ঢুকে চলত তল্লাশি অভিযান।

এই একই ধরনের তল্লাশি অভিযান যাদবপুর, টালিগঞ্জের সর্বত্র চলেছে। ধূসর সময় জুড়ে নানা সমীকরণ চলছিল এই বিস্তীর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে। একদিকে ননী আইচ কিংবা পণ্ডিত  দাসের মতো ছোট-বড় নকশাল সংগঠকরা সিপিআইএম বিদ্বেষের জায়গা থেকে স্থানীয় স্তরে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করে চলছিলেন। সিপিআইএম এদের কংশাল বলে চিহ্নিত করছিল। ঠিক তখনই যাদবপুরের অপর প্রান্তে এক অন্য সমীকরণ দেখা দিচ্ছিল। সৌজন্যে সেই দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। রাজনীতি যাদের বিচ্ছেদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই আশু মজুমদার আর কান্তি গাঙ্গুলি। এখন যুদ্ধক্ষেত্রের দুই প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীর দুই সেনাপতি।

নকশালপন্থীরা গড়ফা, সন্তোষপুর, হালতু জুড়ে সিপিআইএমের বাড়ি আক্রমণ করে। আক্রমণের জেরে ঘরছাড়া হন সিপিআইএম সমর্থকরা। এই সময় সিপিআইএম বাহিনীর কমান্ডার কান্তি গাঙ্গুলি জানতে পারলেন স্থানীয় এক সিপিএম কর্মী শংকর দত্তকে তুলে নিয়ে গেছে আশু বাহিনী। সম্ভাব্য বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করে কান্তি জানতে পারলেন গোপন সেই ডেরার কথা। পরিত্যক্ত এক স্কুলবাড়িতে শংকর দত্তকে যেখানে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখানে পৌঁছন কান্তি, অতি সন্তর্পণে। দু'পক্ষই সশস্ত্র। যে কোনও সময় যা কিছু ঘটতে পারে। কান্তি গাঙ্গুলি দেখলেন শংকরকে বেঁধে গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিচ্ছে আশু। দূরে দাঁড়িয়ে তার অনুগামীরা। ভাঙা স্কুলের দেওয়ালের এপারে আশু, ওপারে কান্তি। এতক্ষণ আশু মজুমদার এবং তার বাহিনী খেয়ালই করেনি কখন যে পজিশন নিয়ে ফেলেছেন কান্তি গাঙ্গুলি। আশু ব্যস্ত শংকরকে নিয়ে। হঠাৎই তার এক অনুগামী দেখে কান্তিকে, কয়েক হাত দূরেই। ঘটনার আকস্মিকতায় চিৎকার করে ওঠে ওই নকশালি গেরিলা, "আশু দা.."

এক চিৎকারে ভেঙে যায় যাবতীয় নীরবতা। দু'পক্ষেরই হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্রগুলি গর্জে ওঠার অপেক্ষায়। আশুর চোখে চোখ রেখে কান্তি গাঙ্গুলি জিজ্ঞেস করেন,

- "এগুলো কী হচ্ছে, এগুলো শ্রেণি সংগ্রাম?"

বন্ধুর দিকে তাকিয়ে আছেন আশু মজুমদার। অন্তত এক ডজন আগ্নেয়াস্ত্র পরস্পরের দিকে তাক করা। ট্রিগারে আঙুল ঠেকানো তবু ফেটে পড়ছে না। দুই পক্ষই জানে রাজনীতি দুই বন্ধুকে বিচ্ছিন্ন করেছে কিন্তু বন্ধুত্বের স্মৃতি মুছতে পারেনি। বন্ধু হত্যার দায় কেউ নেবে না। না আশু, না কান্তি। সেদিন এক বড় রক্তপাত ঘটতে পারত। ঘটেনি।

এরকমই আরেকদিন যাদবপুর স্টেশনের কার শেডে সিপিএমের বাহিনীকে ঘিরে ফেলে নকশালরা কিন্তু রক্তপাত ঘটেনি। এসব গল্প শুনে এখন মনে হতেই, এমন তো হয়ই! আলাদা কী? কিন্তু সত্তরের রক্তাক্ত উত্তাল দশকে এমন বন্ধুকৃত্য করার জায়গা ছিল না। যাদবপুরের একটা অংশে এটা সম্ভব হয়েছিল এত হানাহানির মধ্যেও। এই নিয়ে কান্তি গাঙ্গুলিকে কম সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি পার্টির মধ্যে। আশু মজুমদার তার এলাকায় বা জেলায় তার দলের শীর্ষ নেতা হলেও কান্তির দলে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন, যাদের সাফ বক্তব্য ছিল, আশু মজুমদারকে হাতের কাছে পেলে কোনওভাবে ছাড়া হবে না।

একবার আশুর বাহিনীকে ঘিরে ফেলেছিল সিপিআইএম বাহিনী। পুরো আশু বাহিনীকে ঘিরে নিয়ে আসা হয় সন্তোষপুরে। ঘটনার দিন কান্তি গাঙ্গুলি চত্বরে ছিলেন না কিন্তু তাঁর নেটওয়ার্ক এতটাই শক্তিশালী ছিল যে কান্তি খবর পেয়ে গেলেন আশু বাহিনী সমেত ধরা পড়েছে। কান্তি গাঙ্গুলি পার্টির স্থানীয় নেতৃত্বকে জানালেন, একজনেরও গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। শুধু তাই নয় প্রত্যেককে সকালের খাবার খাওয়ানোর নির্দেশও দিলেন। এই ঘটনায় সমালোচনার ঝড় উঠল পার্টি জুড়ে। আগেই বহুবার আশুকে হাতের কাছে পেয়েও কেন ছেড়ে দিয়েছেন, সেই জন্য 'কাওয়ার্ড' তকমা জুটেছিল। এবার সমালোচনা আরও তীব্র হলো। কিন্তু রণাঙ্গনে দাঁড়িয়েও বন্ধুত্বের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি কান্তি বা আশু কেউই।

তবে এই ঘটনা এক বিচ্ছিন্ন উদাহরণ হলেও টালিগঞ্জ, যাদবপুর জুড়ে নকশালদের সঙ্গে সিপিআইএমের কোনও পর্যায়ে সমঝোতা হতে দেখা যায়নি। বরং বহু নকশাল নেতার কাছেই কংগ্রেসকে নিয়ে চলা শ্রেয় বলেই মনে হয়েছিল। তাদের আশা ছিল কংগ্রেসিদের বোঝানো সহজ হবে, যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে। ফলস্বরূপ, ননী আইচ নিয়ে নরম ছিলেন কুঁদঘাটের বোম। এমনকী কংগ্রেসমনস্ক ননী দত্তও বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সাহায্য করতেন নকশাল নেতা ননী আইচকে। আবার চাষিপাড়ায় সিপিআইএমের আক্রমণে কোণঠাসা নকশাল নেতা পণ্ডিত দাসকে খোদ আশু মজুমদার পরামর্শ দিয়েছিলেন, বিজয়গড়ের কংগ্রেসি মস্তান নিখিলের শেল্টারে চলে যেতে। নিখিল বাহিনীর সঙ্গে মিলে একসঙ্গে সিপিআইএমের বিরুদ্ধে পরবর্তীকালে অ্যাকশনেও নেমেছেন পণ্ডিত দাস কিন্তু তিনি কখনই কংগ্রেসমনস্ক ছিলেন না। তবু লড়াইয়ের ময়দানে সিপিএম বিদ্বেষ থেকেই কংগ্রেসের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন পণ্ডিত। এসবের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আশু আর কান্তির বন্ধুত্বের গল্প নিঃসন্দেহে অমলিন। এক সময় আশু মজুমদার মারা যান, পুলিশের কাস্টডিতে। যাদবপুরের রাজনীতির একটা অধ্যায় শেষ হয় আশুর মৃত্যুর দিয়েই।

More Articles