কৃষককে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার সময়, নৈতিকতা কোথায় যায়?
Kangana Ranaut Slapped: বিগত দশ বছরে নিপীড়কের চাবুক খাওয়া আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
একটি চোখের উপর আঘাতের প্রতিশোধে, আরেকটি চোখের উপর হামলার ফল হবে জগৎময় অন্ধত্ব
একদা মহাত্মা গান্ধি এমনই কিছু বাক্য দুটো মহাযুদ্ধ, দাঙ্গার স্মৃতি, দেশান্তরের অভিজ্ঞতায় ডুবে থাকা ভারতীয় উপমহাদেশকে উপহার দিয়েছিলেন। কখনও না শেষ হওয়া হিংসা-প্রতিহিংসার চক্রকে প্রতিহত করতে সেদিন এই উপদেশেরই ছিল সময়ানুগ প্রয়োজন। চণ্ডীগড় বিমানবন্দরে প্রবল সুরক্ষাবেষ্টনীর মাঝখান থেকে সিআইএসএফ (সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স)- এর কনস্টেবল কুলবিন্দর কৌর যখন ক্রোধান্বিত হয়ে ধেয়ে আসেন সদ্য নির্বাচিত লোকসভার সাংসদ, অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওয়াতের দিকে এবং সটান থাপ্পড় কষান তাঁর গালে, তখন আবারও জনতার দরবারে ঘটে যাওয়া হিংসার বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত এক 'সহিংস' প্রতিরোধ কতটা 'নৈতিক' সেই আলোচনা শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে কারণ, বিগত দশ বছরে নিপীড়কের চাবুক খাওয়া আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। নিপীড়িতের প্রত্যুত্তরকে আমারা স্বেচ্ছায় বিস্মরণযোগ্য ঘটনায় পর্যবসিত করেছি। তাই, এই থাপ্পড় আমাদের অবাক করে দিচ্ছে। যারা নিশ্চুপ থেকেছেন বুলডোজার দিয়ে বস্তি উজাড় করার সময়, কৃষকের দেহ লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার সময়, তাদের গাল এই এক থাপ্পড়েই ক্রমশ লাল, আরও তীব্র লাল হয়ে উঠছে।
দেহ এবং দেহজ প্রতিরোধের সঙ্গে পৌরুষপ্রবণ শরীরের ধারণা জড়িয়ে আছে বহুকাল ধরেই। ১৮৯৬, যে বছর ভদ্রবিত্ত বাঙালি পুরুষের শৌর্য, বীরত্বের 'ধর্মীয়' প্রতিভূ স্বামী বিবেকানন্দ ইংল্যান্ডের আস্তানা ছেড়ে ফিরলেন ভারতে, সঙ্গে আনলেন তার বিলাতি ভক্তকুলকে। সে বছরই, 'বাঁকুড়া দর্পণ' নাম্নী একটি পত্রিকা জানাচ্ছে, স্থানীয় ছেলেদের স্কুলে শারীরশিক্ষার কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ক্রিকেট ও ফুটবল। প্রতিবেদকের মতে যদিও এই ক্রীড়াগুলি 'নেটিভ' ছাত্রদের জন্য তেমন মানানসই নয়। কিছুদিন পরেই, আরও কুলীন পত্রিকা 'বঙ্গবাসী' জানাল, ভারতভূমির বাসিন্দারা এতটা 'অপৌরুষেয়' আগে ছিল না। প্রতিটি গ্রামে ছিল কুস্তির আখড়া, লাঠিখেলার স্থান। এই প্রশিক্ষণ গ্রামের যুবকদের ডাকাতদলের সঙ্গে লড়তে সাহায্য করত। প্রতিবেদক আরও বলছেন, পূর্ববর্তী মুসলমান শাসকরা বেশি 'বুদ্ধিমান' না হওয়ায়, সকল মানুষেরই অস্ত্র রাখার অধিকার ছিল। সেই অধিকারের বশেই তারা ছিলেন প্রকৃত 'পুরুষ', জমিজমা, বংশের নারীদের প্রকৃত রক্ষক। কিন্তু প্রতিবেদকের মতে, ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার ফলে এই 'পৌরুষপ্রবণ' দেহ লুপ্ত হলো এবং অন্যের হাতের 'কমনীয়' পুতুলে পরিণত হল বাঙালি যুবা।
আরও পড়ুন- যে চড় ভুলবেন না কোনওদিনও! কঙ্গনাকে থাপ্পড় মারা সিআইএসএফ কনস্টেবল আসলে কে?
ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড ইন্ডিয়া অফিস কালেকশন রের্কডসের মহাফেজখানা থেকে নেটিভ নিউজপেপার রির্পোট ফাইলের দস্তাবেজ ঘেঁটে, ঔপনিবেশিক ভারতের এই 'দেহ' ও 'পৌরুষে'-র অবশ্যম্ভাবী মেলবন্ধনকে চিহ্নিত করেছেন শতদ্রু সেন তাঁর 'স্কুলস, অ্যাথলেটস অ্যান্ড কনফ্রন্টেশন: দ্য স্টুডেন্ট বডি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া' নিবন্ধে। অথচ, এই অবধারণাগুলির সাম্প্রতিক বাঁকবদল লক্ষ্যণীয়। শেষ দশ বছরে, ভারতের রাজনৈতিক আবহাওয়ায় মহিলাবিদ্বেষের পারদ যত তীব্র হয়েছে, ততই নিজের সমাজ-নির্ধারিত লিঙ্গ-অভিপ্রায়কে ছিন্ন করে মহিলারাই গড়েছেন দেহজ প্রতিরোধ। মুষ্টিবদ্ধ প্রতিরোধী যুবকের, কাস্তে হাতে ঘর্মাক্ত পুরুষ কৃষকের চিরাচরিত আইকনোগ্রাফি বদলে দিয়েছেন শাহিনবাগের দাদিরা, কৃষক আন্দোলনের সময় নিয়োজিত প্রাণ জাঠ মহিলা চাষিরা। ভিক্টোরিয় পৌরুষের বিদেশি-দেশি প্রবক্তাদের সমস্ত নির্মিতি ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। নারীবাদী ঐতিহাসিক চারু দত্ত তাঁর ১৮৫৭-র সিপাহী বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী 'বীরাঙ্গনা'দের অবদান বিষয়ে লিখিত নিবন্ধে দেখিয়েছেন, এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন দলিত পরিবারের মানুষ। নাপিত, ধোপা, কুর্মি, কুমোর, মুচি প্রভৃতি পারম্পরিক পেশাদাররা ছিলেন এই ভীষণ লড়াইয়ের সামনের সারিতে। যদিও, যত্রতত্র পাওয়া যাবে না এদের 'বীরগাথা', লিখিত ঐতিহাসিক বয়ানে এঁরা অনুপস্থিত, দলিতবর্গের মানুষের কৌমস্মৃতির মৌখিকতায় এদের স্মৃতি আজও উজ্জ্বল। কোরি জনজাতির ঝালকারি বাঈ, লোধি জনজাতির অবন্তী বাঈ, গুর্জ্জরি জনজাতির আশা দেবী, এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের প্রধানতম 'যোদ্ধা'। জেনারেল ক্যাম্পবেলের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ ফৌজ যখন লখনউয়ের সিকন্দার বাগে হামলা চালায় তখন এই মহিলারাই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
সদ্য শেষ হওয়া লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলেও দেখা যাচ্ছে উচ্চবর্ণ অধ্যুষিত শহর এবং নিম্নবর্গীয় গ্রামাঞ্চলের মধ্যে আড়াআড়ি রাজনৈতিক বিভাজন ঘটে গিয়েছে। যেখানে 'গোবলয়' নামে খ্যাত ভৌগোলিক অঞ্চলের জনতা, সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী অবস্থান নিচ্ছে, সেখানে ভারতের প্রায় প্রতিটি বড় মেট্রোপলিটন শহর (কলকাতার মতো ব্যতিক্রমও রয়েছে), যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের বসতি, সেখানেই নারীবিদ্বেষী-মুসলমানবিদ্বেষী সমাজ কাঠামোর পক্ষে ভোটদান চলেছে। ভদ্রবিত্তের শাসকশ্রেণির সঙ্গে যোগসাজশে ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার এই প্রবণতাও দীর্ঘকালীন। আবার, সেই শাসকের সময় ঘনালে নিপীড়িতের কাছ থেকে পাল্টা থাপ্পড় খাওয়ার ভীতিও, তাকে অজানা সন্ত্রাসের মতো, ঘুমের অন্তর্লীন স্বপ্নে তাড়া করে বেড়ায়। তাই তো সিপাহী বিদ্রোহের দমনে সে 'মঙ্গল'বার্তা খুঁজে পায়। রজনীকান্ত গুপ্ত তাঁর সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাসে লেখেন,
"তাহারা (সেপাইরা) এই অবধি বুঝিতে পারিল, যেই হউক, কোম্পানির বিরুদ্ধচারী হইলে, তাহাকে হৃতসর্বস্ব, হৃতমান ও হৃত-জীবন হইতে হইবে। ব্রিটিশ দণ্ডনীতি, জাতিবিচার, শ্রেণীবিচার ও প্রণালী বিচার না করিয়া সকলকেই অন্যায়ের ফল ভোগ করিবে। এই ধারণা ও বিশ্বাস পরিণামে অনেক মঙ্গলের কারণ হইয়াছিল।"
আরও পড়ুন- ভোটে জিতেও মিলল না ছাড়! মহিলা জওয়ানের হাতে সপাটে চড় খেলেন কঙ্গনা
অর্থাৎ, লাগাতার ঔপনিবেশিক লুঠের যৌক্তিকতা হিসাবে, সেক্যুলার আইনকাঠামোর 'ন্যায্যতা'-কে মঙ্গলসূচক হিসাবে স্থাপন করা হলো। ঠিক যেভাবে এখনও বহু ভদ্রবিত্তদের চোখে শ্রমিক-ধর্মঘট খুব খারাপ, ঠিক যে অর্থে এখনও কঙ্গনা রানাওয়াত নিজেও কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে খালিস্তানপন্থীদের সম্পর্ক নিয়ে মিথ্যা প্রোপাগান্ডার বয়ান আউড়ে চলেছেন। আসলে, আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের 'হার্ডওয়্যার' সশস্ত্র সেপাইরা যে উর্দির আড়ালে এক বহমান কৃষকচেতনা, একথা উত্তর-পশ্চিম ভারতের জনপদ সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই তারাই অস্বীকার করবেন এবং প্রসঙ্গটিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে, ভারতীয় সেনাবাহিনী ভারতের জনগণের সঙ্গেই দীর্ঘকালীন যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে কিনা, সেই কূটপ্রশ্নে। সেই প্রশ্নের সারবত্তা আছে কী নেই, তা কুলবিন্দর-কঙ্গনা প্রসঙ্গের উপজীব্য নয়। এখানে প্রশ্নটি প্রতিরোধের, সম্পূর্ণ দেহ দিয়ে রুখে দাঁড়ানোর, এতদিন ধরে বলে আসা অপমানসূচক বাক্য, নিপীড়নের ভঙ্গিগুলির বিরুদ্ধে। যে কারণে, কার্ল মার্ক্স থেকে বিনায়ক দামোদর সাভারকর, সম্পূর্ণ উল্টো মতাদর্শিক মেরুর দুই ব্যক্তি একযোগে সিপাহী বিদ্রোহকে, 'ভারতের প্রথম স্বাধীনতার লড়াই' বা প্রকৃত 'জনযুদ্ধে'-র আখ্যা দিচ্ছেন। রজনীকান্ত গুপ্তের ভাষায়, 'অধিকাংশ সময়ে তাহারা স্বজাতির, স্বধর্ম্মের ও স্বজ্ঞাতির বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হয়' বটে কিন্তু নিজের আন্দোলনরত কৃষক-মায়ের মুখ যখন তার চোখে ভেসে ওঠে, ভেসে ওঠে সেই সেলিব্রিটির বয়ান, যে তার মায়ের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করার ঔদ্ধত্য দেখায়, সেও তার 'স্ব'র খুঁজে পায়, সেও ব্যারিকেডের উল্টোদিকে চলে আসে, হয়ে ওঠে মহাভারতের প্রতিরোধী জনতার মুখাবয়ব।
১৪ জুন, ১৮৫৭ ছিল এমন এক রবিবার, যখন উপনিবেশের ভিত্তিপ্রস্তর যে শহরে গাঁথা হয়েছিল, সেই কলকাতার ভদ্রদের আর তাদের মালিক ইংরেজদের চোখে ছিল ভয়াল সন্ত্রাসের ছায়া। ইতিহাস একে 'প্যানিক সানডে' নামে মনে রেখেছে। হাওয়ায় উড়তে থাকা পরাজয়ের গুজব, তৎকালীন শাসকশ্রেণির ও তার মোসাহেবদের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিল। এর রেশ গিয়ে পৌঁছয় সুপ্রিম কোর্টে, যখন ২২ জুলাই, ১৮৫৭-তে ইংরেজ বিচারকরা সুপারিশ করেন, কলকাতা এবং তৎসংলগ্ন 'নেটিভ'-দের এলাকায় এলাকায় নিরস্ত্রীকরণ করাতে হবে। ৪ জুন, ২০২৪-ও তেমনই হয়ে উঠল স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলির মধ্যে একটি। যখন, নির্বাচনের ফল ঘোষণা যত এগিয়েছে তত বুকে কাঁপন ধরেছে তাঁদের, যারা এ দেশে ঘৃণার বসতি বানাতে চেয়েছিলেন। চকচকে নিউজ স্টুডিওর ক্যাঁচরম্যাঁচর, উস্কানিমূলক কলরব পর্যবসিত হয়েছে শ্মশানের নীরবতায়। মহাত্মা গান্ধির প্রতি, সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধা জানিয়ে একথা বলার, বাপু, আমরা অকৃতি, অধম, আমরা রাজু হিরানির ছবির চরিত্র, মুন্নাভাই ও সার্কিট, যুগপৎ ক্রুদ্ধ ও ফাজিল। আপনার কথা মেনে, এক গালে চড় খেয়েও বাড়িয়ে দিয়েছি আরেক গাল। কিন্তু সে গালে থাপ্পড় খেয়ে বুঝেছি আপনি তো বলেননি দ্বিতীয় থাপ্পড়ের পর কী করণীয়। তাই, নিখোঁজ বন্ধু নাজিবের কথা ভেবে, মৃত কমরেড রোহিতের কথা ভেবে, কয়েকশো কৃষকের শাহদাতকে মনে রেখে, আমরা ভারতের জনগণ, আপাতত ওদের দুই গালে দিচ্ছি কষিয়ে, থাপ্পড়।