নস্ত্রদামুসের বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিল! ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর এবার সুনামির সামনে জাপান?

Japan Earthquake: এখনও পর্যন্ত ৪৮ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে এই জাপান-বিপর্যয়ে। ধ্বংসস্তূপের তলায় চাপা পড়ে রয়েছেন এখনও অনেকে। ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নতুন বছরের শুরুটাই হল ভয়াবহতা দিয়ে। মিলে গেল নস্ত্রদামুসের ভবিষ্যদ্বানী? ২০১১-র স্মৃতি ফিরিয়ে জাপানে মাথাচাড়া দিল  ভূমিকম্প। বছরের প্রথম দিনেই ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল জাপান। কম্পনের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭.৫। ফুলে উঠল সমুদ্রের জল। অন্তত ৪৮ জনের মৃত্য়ুর খবর মিলেছে এখনও পর্যন্ত। ফের আরও এক সুনামির আশঙ্কায় কাঁপছে গোটা বিশ্ব।

সোমবার ভারতীয় সময় দুপুর ১২টা ৫৮ নাগাদ তীব্র কম্পনে কেঁপে ওঠে পশ্চিম জাপান। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল মধ্য জাপানের ইশিকাওয়া। তার পর থেকে পর পর অন্তত ১৫৫টি কম্পন নাড়িয়ে দিয়েছে জাপানকে। প্রতিটি আফটার শকের তীব্রতা ছিল রিখটার স্কেলে ৬ থেকে ৭। জাপানের আবহাওয়া দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সোমবার থেকে দ্বীপরাষ্ট্রে ১৫৫টির বেশি ভূমিকম্প আগাত করেছে। সমুদ্রের ঢেউ ফুঁসে উঠেছে। ৫ ফুট উচ্চতার ঢেউ আছড়ে পড়েছে উপকূলে। এক মিটার সমান উঁচু ঢেউ উঠতে শুরু হয়েছে ইশিকাওয়া এলাকার উপকূলে। দেশ জুড়ে জারি করা হয় সুনামি সতর্কতা। দ্রুত উপকূলীয় এলাকাগুলি থেকে সরিয়ে নেওয়া স্থানীয় মানুষদের। বিশেষত নোটো, টোয়ামার উপকূলবর্তী এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের বলা হয়েছে, উঁচু বাড়িতে বা অন্য এলাকায় আশ্রয় নিতে।

জাপানের রাজধানী টোকিও-সহ একাধিক শহরে পড়েছে ভূমিকম্পের প্রভাব। দেশ জুড়ে প্রায় ৩৩ হাজারের বেশি পরিবার বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে দেশের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। বিপর্যস্ত চিকিৎসা পরিষেবা। ইতিমধ্যেই বিপর্যস্তদের উদ্ধারে নেমেছে সেনা। কিন্তু রাস্তা বন্ধ থাকায় সেক্ষেত্রেও প্রতি পদে পদে বিপদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে উদ্ধারকারী দলের। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিয়ো কিশিদা ইতিমধ্যেই দেশবাসীকে সতর্ক করেছেন। ঘোষণা করা হয়েছে একাধিক সতর্কতা মূলক পদক্ষেপের। ভূমিকম্প-বিপর্যয়ের পরেই একটি বিবৃতি জারি করে প্রধানমন্ত্রী জানান, সুনামি নিয়ে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর সঠিক তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। সমুদ্র সংলগ্ন এলাকা থেকে বাসিন্দাদের যত দ্রুত সম্ভব সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে হবে। এই বিপর্যয়ের মুহুর্তে যে মানুষের জীবনহানি বাঁচানোকেই অগ্রাধিকার দেবে জাপান সরকার, তা পরিস্কার করে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: মরক্কোর ভূমিকম্প মনে করাচ্ছে যেসব দেশের কথা

এখনও পর্যন্ত ৪৮ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে এই জাপান-বিপর্যয়ে। ধ্বংসস্তূপের তলায় চাপা পড়ে রয়েছেন এখনও অনেকে। ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। গোটা বিপর্যয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওয়াজিমা বন্দর এলাকা। সেখান থেকে অন্তত সাত জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। উদ্ধারকাজ শুরু হলেও সেখানেও প্রতি পদে পদে বাধার মুখে পড়ছে উদ্ধারকারী দল। একাধিক বহুতল, বাড়ি ধ্বসে পড়েছে বালির ঘরের মতো। এদিকে ভূমিকম্পের পর পরই আবার বিধ্বংসী আগুন লেগে গিয়েছিল ওয়াজিমা সিটিতে। সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে শতাধিক দোকান ও বাড়ি। বেশিরভাগ সময়েই পর্যটকে ঠাসা থাকে ওই বাজার এলাকাটি। সেখানে আগুন লেগে প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

সব মিলিয়ে বছরের শুরুটা একেবারেই ভালো হয়নি জাপানের। অথচ আর পাঁচটা দেশের মতোই নয়া উদ্যমের সঙ্গে বছরের প্রথম দিনটা শুরু করেছিলেন জাপানবাসীও। নতুন আশা, নতুন বছর যাতে ভালো কাটে সেই প্রার্থনা দিয়ে শুরু হয়েছিল বছরের প্রথম সকালটা। কিন্তু সম্ভবত প্রকৃতির পরিকল্পনা তেমনটা ছিল না। তাই বছরের প্রথম দিনেই তীব্র ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল জাপান। শিকা শহরের বাসিন্দা ৭৩ বছরের সুগামাসা মিহারা সেসময় দাঁড়িয়েছিলেন জলের লাইনে। এত ভয়ঙ্কর, এতটা তীব্র কাঁপুনি আগে কখনও অনুভব করেননি সুগামাসা। বাড়ি তছনছ হয়ে গিয়েছে ভয়াবহ ভূকম্পনে। তার পরেও যে তিনি বেঁচে রয়েছেন, আপাতত এটাই তাঁর কাছে সান্তনা। একাধিক বাড়িঘর ভেঙে পড়ার ছবি, ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফুঁসে উঠতে দেখা গিয়েছে সমুদ্রের জলকে। 

Japan Earthquake Tsunami  Death Count At 48, More Feared Dead

জাপান এমনিতেই ভূমিকম্পপ্রবণ। প্রায়শই এমন প্রকৃতির ভ্রূকূটির সামনে পড়ে জাপানের একাধিক শহর, এলাকা। তবে এ বারের ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল সেসবের থেকে অনেকটাই বেশির দিকে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, জাপানে এই ঘন ঘন ভয়ঙ্কর সব ভূমিকম্পের নেপথ্যে আদতে রয়েছে দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান। ভৌগোলিক দিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের রিং অব ফায়ারে রয়েছে জাপান। ওই অঞ্চলে প্রায় ৪৫২টি আগ্নেয়গিরি রয়েছে। মাঝেমধ্যেই জেগে ওঠে সেইসব সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। ভূপৃষ্ঠের অন্দরে সবসময়েই প্রবল শক্তি তৈরি হতে থাকে। অস্থির টেকটনিক প্লেটগুলো ধাক্কা মারে একে অপরকে। কখনও একটি প্লেট ঢুকে যায় অন্য প্লেটের ভেতরে। এর কারণেও ভূগর্ভে প্রচণ্ড তাপ ও শক্তি তৈরি হয়। এই কারণেও প্রশান্ত মহাসাগরের রিং অব ফায়ার জ়োনে যে সব দেশ রয়েছে যেমন জাপান, পলিনেশিয়ার টোঙ্গো, দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডর সবকটিই ভূমিকম্পপ্রবণ। পাশাপাশি ওই ধাক্কাধাক্কিতে যখন একটি টেকটনিক প্লেট অন্যটির নীচে চলে যায় তখন যে শূন্যস্থান তৈরি হয় তা ভরাতে সমুদ্রগর্ভে চার পাশ থেকে তীব্র গতিতে ছুটে আসে জলরাশি। ফলে সমুদ্রগর্ভে বিপুল চাপ তৈরি হয়। জলরাশির গতিবেগও বেড়ে যায়। নতুন করে শক্তি তৈরি হয়। এই শক্তি তখন তেড়েফুঁড়ে বেরনোর চেষ্টা করে। সমুদ্রগর্ভের তলদেশ থেকে সেই জলরাশি প্রচণ্ড গতিবেগে উঠে আসে ওপরের দিকে। আছড়ে পড়ে সমুদ্রোপকূলে, ভয়ঙ্কর তীব্র গতিবেগে। নিমেষে গ্রাস করে উপকূলবর্তী জনপদকে। ফলে ভূমিকম্প হলে বহু সময়ই সুনামির আশঙ্কা চেপে ধরে জাপানকে।

Japan Earthquake Tsunami  Death Count At 48, More Feared Dead

ভূমিকম্প কোনও নতুন বিষয় নয় জাপানে। গত তিরিশ বছরের একের পর এক এমন ছোট-বড় একাধিক ভূমিকম্প দেখে আসছে জাপানবাসী। ১৯৯৫ সালের ১৬ জানুয়ারি মধ্য জাপানে আঘাত হেনেছিল ভয়ঙ্কর একটি ভূমিকম্প। যার তীব্রতা ছিল রিখটার স্কেলে ৭.৩। সেই কম্পনের জেরে সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস হয়ে যায় পশ্চিমের বন্দর শহর কোবে। গত ৫০ বছরে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প ছিল সেটি। অন্তত ৬,৪০০-রও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল সেবার। ২০০৪ সালে টোকিও থেকে ২৫০ কিলোমিটার উত্তরে নিগাতা অঞ্চলে আঘাত করে ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্প। সেবার অন্তত ৬৫ জন নিহত হন। জখম হয় অন্তত ৩ হাজার মানুষ। ২০১১ সালের বিপর্যয়ের স্মৃতি তো বোধহয় বিশ্ববাসীর কাছে আজও উজ্জ্বল। ২০১১ সালের ১১ মার্চ উত্তর-পূর্ব জাপানে ৯.০ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত করে। আছড়ে পড়ে সুনামি। প্রায় ২০ হাজার মানুষের মৃত্য়ু হয়েছিল। সেই ভূমিকম্প ও সুনামির ফলে বিরাট পারমাণবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল জাপান। ফুকুসিমার একটি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছ'টি চুল্লির দুটিতে বিস্ফোরণ ঘটে। হলে যায় তিনটি রিয়্যাক্টর। লাগে আগুন। চেরনোবিলের পর সম্ভবত সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিপর্যয় ছিল ফুকুসিমার এই দুর্ঘটনা। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে জাপানের দক্ষিণে কুমামোতো দ্বীপে আঘাত হানে আরও একটি ভূমিকম্প। কম্পনের মাত্রা ছিল ৬.১। সেই বিপর্যয়ে মারা গিয়েছিল ২২০ জন। ২০১৮ সালের জুনে জাপানের ওসাকা শহরে ৬.১ ম্যাগনিচিউডের একটি ভূমিকম্প আঘাত করে। চার জনের মৃত্যু হয়েছিল। জখম হন শতাধিক। ওই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে উত্তর জাপানের হোক্কাইদো দ্বীপে আরও একটি ভূমিকম্প হয়। কম্পনের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৬.৭। অন্তত ৭ জনের মৃত্যু হয়। ভূমিকম্পের জেরে নেমেছিল ধস। প্রায় ৫.৩ মিলিয়ন বাসিন্দা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ২০২১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে আরও ৭.৩ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে পূর্ব জাপানেক ফুকুসিমা উপকূলে। অসংখ্য মানুষ জখম হয়েছিলেন। বিদ্যুৎ-সঙ্কটে পড়ে বিরাট এলাকা। ২০২২ সালের মার্চ মাসে ফের আরও একটি ৭.৩ মাত্রার ভূমিকম্প ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুকুসিমা উপকূলে। অন্তত ২ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছিল। বেশ কয়েকটি এলাকায় ফুঁসে ওঠে সমুদ্রের জল। জারি করা হয় সুনামির সতর্কতা।

সেই সব ভূমিকম্পের রেশ কাটতে না কাটতেই ফের আরও একটি বড়সড় ভূমিকম্পের মুখে পড়ল জাপান। তা-ও আবার বছরের একেবারে প্রথম দিনেই। জাপানের দ্রুত সেরে ওঠার প্রার্থনা করছে গোটা দেশ। এরই মধ্যে আবার জাপানে এক সপ্তাহ কাটিয়ে সদ্য দেশে ফিরেছেন দক্ষিনী সুপারস্টার জুনিয়র এনটিআর। জাপান থেকে দেশে ফিরেই ভূমিকম্পের খবর গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছে আরআরআর-তারকা। মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্সে জাপানের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন তিনি। ইতিমধ্যেই প্রায় এক হাজার সেনা পাঠানো হয়েছে নোটো উপদ্বীপের ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে। যত দ্রুত সম্ভব উদ্ধারকাজ চালানোর সমস্ত রকম চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

আরও পড়ুন:একটানা দু’মিনিট ধরে কাঁপল রাজধানী, কেন আফগানিস্তানের ভূমিকম্পের জের বইছে ভারতও?

আশ্চর্য ভাবে নস্ত্রদামুসের ভবিষ্যদ্বাণী যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছে জাপানে। এই প্রথম নয়, এর আগেও তাঁর বহু কথাই মিলেছে। ফরাসি এই চিকিৎসক নস্ত্রদামুসের লেস প্রফেটিস বইটি প্রকাশ পায়ে ১৫৫৫ সালে। যেখানে হিটলারের উত্থান, ১১ সেপ্টেম্বরের নিউ ইয়র্ক হামলার মতো বহু ঘটনারই উল্লেখ ছিল বলে জানা যায়। যা মিলে গিয়েছে অক্ষরে অক্ষরে। এমনকী কোভিড অতিমারি নিয়েও আগেই সতর্ক করেছিলেন তিনি। তাঁর সেই বইতেই নাকি ২০২৪ সালের গোড়ায় জাপানের এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আভাস ছিল বলে মনে করছেন অনেকে। তবে কি তার সেই কথাই ফলল শেষ পর্যন্ত। কবে এই বিপর্যয়ের আতঙ্ক ভুলে ফের স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে জাপান? যদিও সুনামি সতর্কতা তুলে নেওয়া হয়েছে জাপানে। তবে মানুষকে সতর্ক থাকার অনুরোধ করা হয়েছে।  নতুন বছরের শুরুটা এমন বিপর্যয় দিয়ে শুরু হওয়াটাকে ভালো ভাবে দেখছেন না অনেকেই। এমনিতেই দু-দুটি বড় যুদ্ধ-সহ একাধিক রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে শেষ হয়েছে ২০২৩ সালটা। আর কী কী অপেক্ষা করছে ২০২৪-এর জন্য। আপাতত সেটাই উদ্বেগে রাখছে বিশ্ববাসীকে।

More Articles