বইমেলার দিকে তাকিয়ে থাকি আমরা
Kolkata Book Fair 2024 : আমাদের প্রকাশনার জগতে আসাটা তো খুব মেপেবুঝে হয়নি। আমরা প্রথম বই ছাপাই টিউশনির টাকা জমিয়ে।
কলকাতা বইমেলা মানেই প্রকাশকদের হুড়োহুড়ি। প্রেসে প্রেসে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ, শেষ মুহূর্তের বাঁধাই, বাক্স প্যাঁটরায় ভরে নতুন বই চলে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বইমেলায়। নতুন পাঠকরা ঠিক কোন বই খুঁজছেন? নতুন লেখকরাই বা কোন বিষয়ে ভাবছেন? পাঠকের চাহিদা না লেখকের তাগিদ, প্রকাশকের কাছে কোনটি সবার আগে? এসমস্ত নিয়েই ইনস্ক্রিপ্টের সঙ্গে আলাপচারিতায় 'তবুও প্রয়াস' প্রকাশনার সেলিম মণ্ডল।
মধুরিমা- তবুও প্রয়াসের যাত্রা শুরু হয়েছিল খুব অন্যভাবেই। সেই শুরুর দিন থেকে আজ অবধি, বইমেলা এসে গেলে তাড়াহুড়োর কি বদল হয়েছে এতটুকুও? প্রস্তুতি কেমন এবার?
সেলিম- প্রতিবারই নাভিশ্বাস ওঠে! এবারও ঠিক একই রকম। প্রচণ্ড দ্রুত সব কাজকর্ম গোটানোর চেষ্টা চলছে। এবার কলেজস্ট্রিট পাড়ায় অবস্থা একটু খারাপ ছিল। পুজো বা অন্যান্য সময়ে যে পরিমাণে বই আমরা প্রকাশ করতে পারি, তা হয়নি। কোনও প্রকাশকই খুব বেশি পারেননি। বিক্রির বাজার একেবারেই ভালো না থাকায় কমবেশি সব প্রকাশনাই কম বই ছাপিয়েছে। বইমেলার বইয়ের পরিকল্পনা তো থাকেই, এবার সেই সঙ্গে আগে প্রকাশ না হওয়া বইগুলোর চাপও এসে জুড়েছে। তাই অন্যান্যবারের চেয়ে অবস্থা বেশিই কঠিন।
মধুরিমা- কলেজস্ট্রিট বা বই প্রকাশনার এমন কঠিন অবস্থা কেন?
সেলিম- শুধু কলেজস্ট্রিট কেন, প্রতিটা ব্যবসার অবস্থাই দেখতে গেলে শোচনীয়। আমার ধারণা, মানুষের হাতে টাকার জোগান কমেছে। কোভিড পরবর্তীকালে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামই হু হু করে বেড়েছে। সেখানে বই কেনার মতো টাকার জোগান খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না। সব কিছুর দাম বেড়েছে, খরচ বেড়েছে। পাতার দাম বাড়ছে, বাঁধাইয়ের খরচা বাড়ছে, জিএসটি যোগ হয়েছে এখন। ফলে প্রকাশককে লাভ তুলতে গেলে বইয়ের দাম বাড়াতেই হচ্ছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই একটা বই ৫০০ টাকা দিয়ে কিনতে এখনও অনেকেরই সমস্যা হয় এবং অনেকের মানসিকতাও তেমন নয় যে বইয়ের পিছনে এতটা টাকা ব্যয় করবেন।
এছাড়া প্রকাশনার সংখ্যাও বাড়ছে কিন্তু। ধরা যাক, কোনও নতুন লেখকের বই প্রকাশ হলো। সেই বইয়ের ক্রেতা সীমিতই থাকে প্রথমে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তো সব বই শেষ হয়ে যায় না। ধীরে ধীরে তা বিক্রি হয়ে যায় ঠিকই কিন্তু প্রকাশের পরে অনেকটা সময় লাগে। এবার একজন প্রকাশক একটি বই ছাপতে যে টাকা লগ্নি করছেন সেই টাকা শুরুতে হাতে আসছেও না। ফলে প্রকাশকের দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। পিওডি অর্থাৎ প্রিন্ট অন ডিমান্ডের খরচা বাড়ছে। তবে পরিস্থিতি প্রতিকূল হলেও হয়তো আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হবে।
আরও পড়ুন- লেখক কম, প্রকাশকে গিজগিজ করছে বাংলার বইবাজার : সুমন চট্টোপাধ্যায়
মধুরিমা- এবছর বইমেলায় তবুও প্রয়াসের মোট কতগুলি বই প্রকাশ হচ্ছে?
সেলিম- গোটা তিরিশেক বই তো আছেই...
মধুরিমা- এতগুলো বই একসঙ্গে বইমেলাতেই বেরোচ্ছে?
সেলিম- আসলে বহু বই আটকে ছিল গতবছর। ফলে সেইসব মিলিয়ে এই বইমেলায় চাপ বেড়ে গিয়েছে। প্রতিদিনই কাজ চলছে। শেষ অবধি জানি না কতগুলো বইমেলার মধ্যে এসে পৌঁছবে।
মধুরিমা- কী কী বই প্রকাশ পাচ্ছে এবার?
সেলিম- দর্শন বিষয়ক বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ পাচ্ছে। 'শব্দব্রহ্ম' বইটি প্রকাশ হবে বইমেলাতে। বদ্রিয়ারের উপর একটি বই আছে, শরীর ও যৌনতা বিষয়ক বই 'উৎসব' প্রকাশ পাচ্ছে। দু'টি কবিতা সংগ্রহ বেরোচ্ছে তবুও প্রয়াস থেকে, একটি বিজয় দে-র অন্যটি অমিতাভ মৈত্রর। এই বইমেলায় আমাদের সবচেয়ে নজরে থাকছে যে বইটি সেটি হলো, কৃত্তিবাসের যিনি প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক দীপক মজুমদার, তাঁর রচনা সমগ্র প্রকাশ পাচ্ছে। গঙ্গার উপরে একটি বই তৈরি হয়েছে। গঙ্গা নদীর ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি সবটা মিলে, চঞ্চল কুমার ঘোষ ও সমর ঘোষের সম্পাদনায় তৈরি হচ্ছে বইটি।
উপন্যাস বেরোচ্ছে একটি। রামপ্রসাদের উপর উপন্যাসটি লিখেছেন অনুপম মুখোপাধ্যায়। সৈকত রক্ষিতের তিনটি উপন্যাসের সংকলন বেরোচ্ছে। আমাদের পত্রিকার সংখ্যাও বইমেলাতেই প্রকাশ পাচ্ছে। ঋতুপর্ণ ঘোষ সংখ্যা বেরোচ্ছে এবার।
মধুরিমা- তবুও প্রয়াসের যাত্রা শুরু কবে?
সেলিম- ২০১৭ নাগাদ বলা যায়। তখন সামান্য কিছু বই বেরোত আমাদের। কবিতার বই-ই বেরোত। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তো ছিল, তার সঙ্গে কিছু চটি কবিতার বই প্রকাশ হতো।
মধুরিমা- এই প্রায় ৭ বছরের যাত্রাপথে কোন কোন বইগুলি সবচেয়ে বেশি সমাদৃত হয়েছে। মানে কোন বইগুলোই তবুও প্রয়াসের অলঙ্কার হয়ে উঠেছে?
সেলিম- বিক্রির নিরিখে?
মধুরিমা- না, পাঠকের পছন্দ, মানুষের ভালো লেগেছে যে যে বইগুলি, যেগুলি নিয়ে চর্চা হয়েছে...
সেলিম- রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অনেক ক'টি বই তবুও প্রয়াস থেকে প্রকাশ হয়েছে, দর্শনের বই। অত্যন্ত সহজ করে গূঢ় দর্শনের কথা বইগুলিতে উঠে এসেছে, আলোচিত হয়েছে। বদ্রিয়ার বইটাও ঠিক তেমনই। রামচন্দ্র প্রামাণিকের 'হাথক দর্পণ' বইটি অত্যন্ত সমাদৃত একটি বই। বইটির আরও সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়েছে আমাদের। লুৎফর রহমানের একটা গল্প সংকলন হয়েছিল। অমিতাভ মৈত্রের বইগুলিও খুব পছন্দ করেছেন পাঠকরা। অনুপম মুখোপাধ্যায়ের একটি ট্রিলজি প্রকাশ হচ্ছে তবুও প্রয়াস থেকে। প্রথমে 'খ্রিস্ট' বইটি প্রকাশ হয়, এবছর 'রামপ্রসাদ'। 'অস্তিত্ব ও আত্মহত্যা' বলে একটি বইটি, তাঁতিদের জীবন নিয়ে লেখা 'বয়ন' বলে একটি উপন্যাসও বেশ আলোচিত হয়।
মধুরিমা- দর্শন থেকে শুরু করে উপন্যাস, কবিতা, সবটাই আছে। প্রকাশনার ক্ষেত্রে তবুও প্রয়াসের কি কোনও নির্দিষ্ট অভিমুখ আছে? ঠিক কোন কোন বই খুঁজতে মানুষ তবুও প্রয়াসের কাছে আসবে?
সেলিম- একটু অন্য ধরনের লেখালেখি খুঁজতেই তবুও প্রয়াসের কাছে আসে মানুষ। দর্শন আর লোকসংস্কৃতি এই দু'টি বিষয় নিয়ে লেখা বইগুলি আমাদের একধরনের সম্পদ বলা যায়।
মধুরিমা- পাঠকের পছন্দই কি মাথায় থাকে মূলত নাকি বিষয়ের গুরুত্ব, বিষয়ের নির্বাচনটাই প্রাধান্য পায় এখানে?
সেলিম- আমাদের নির্দিষ্ট বিষয় ভেবেই যে কাজ হয় এমন না। ভালো পাণ্ডুলিপি পেলে কাজ হয়। আমরা, মানে আমাদের দল যে ধরনের লেখালেখি পছন্দ করে, যেমন ধরা যাক রমেশবাবুর লেখাগুলি, তা আগে আমরা পছন্দ করেছি, আমাদের ভালো লেগেছে, প্রকাশের পরে তা পাঠকদেরও ভালো লেগেছে। আমাদের প্রকাশনার জগতে আসাটা তো খুব মেপেবুঝে হয়নি। আমরা প্রথম বই ছাপাই টিউশনির টাকা জমিয়ে। তারপর এসব করতে করতেই এমন ঢুকে গেছি বিষয়ে যে প্রকাশনাটিকে ধীরে ধীরে বড়ভাবে ভাবা হয়েছে। আমাদের নির্বাচনের উপরেই আমাদের প্রকাশনার বেড়ে ওঠা।
মধুরিমা- বইমেলার বিক্রির উপরেই কি নির্ভর করতে হয়? না কি সারাবছরই একটা চাহিদা থাকে?
সেলিম- বইমেলায় বড় অঙ্কের ব্যবসা হয়। সেটা আমাদের প্রকাশনা চালানোর ক্ষেত্রে অনেকটা সুবিধার হয়। প্রতিটি প্রকাশনাই তাই কলকাতা বইমেলার অপেক্ষা করে। একটা ভালো বই হয়তো ৫০ থেকে ৬০ কপি কেবল বইমেলাতেই বিক্রি হয়ে গেল। বছরের অন্য সময় দেখা গেল মাসে দুটো, তিন মাসে দুটো- এমন। কলকাতা বইমেলা বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা। আমাদের কলেজস্ট্রিটে নিজস্ব কাউন্টার আছে, বইমেলা লক্ষ্য থাকে অবশ্যই কিন্তু আমাদের সারাবছরই বই বেরোয়।
মধুরিমা- পেপারব্যাকের বই কি বেশি হয় না হার্ডকভার এখনও?
সেলিম- পেপারব্যাক সামান্য। সমস্যা হচ্ছে বাঙালি লেখকদের পেপারব্যাকের প্রতি অনীহা আছে। হার্ডকভার এখনও জনপ্রিয়!
মধুরিমা- পাঠকদেরও কি অনীহা তাতে? সারা বিশ্বে ভালো ভালো কাজ হচ্ছে পেপারব্যাকে...
সেলিম- পাঠকদের অনীহা যে নেই তা নয়, বইয়ের তাকে পেপারব্যাকের বই হারিয়ে যায়, হার্ড কভার খুঁজে পেতে সুবিধা মনে করেন অনেকে। পেপারব্যাক বই কিন্তু টেকে বেশি, কুরিয়ার করে পাঠাতেও সুবিধা হয়। কলকাতাতে বছর কয়েক আগে পেপারব্যাক নিয়ে খুব হইচই হয়। এখন মিলিয়ে মিশিয়েই চলছে। কিছু কিছু বই যদি মনে হয় পেপারব্যাক হলেই ভালো হবে, সেটাই করা হয়।
আরও পড়ুন- প্রকাশনা নিয়ে স্বপ্ন দেখবে তরুণ-তরুণীরা? বইমেলা যে পথ দেখাল
মধুরিমা- বহু প্রকাশনার নিজস্ব লেখক গোষ্ঠী তৈরি হয়। এমন অনেক লেখক আছেন যারা মূলত ওই প্রকাশনাতেই লেখেন। তবুও প্রয়াসের কি এমন কোনও গোষ্ঠী বা লেখক আছেন?
সেলিম- অমিতাভ মৈত্রর সব লেখাই আমরা ছাপি, কবিতা সংগ্রহ ১ বেরিয়েছে, ২ এবার বেরোবে। গদ্য সংগ্রহও ১ বেরিয়েছে, দ্বিতীয় বেরোবে। দীপক মজুমদারের রচনা সমগ্রের দুই খণ্ড আপাতত বেরোচ্ছে আমাদের প্রকাশনা থেকেই। তাঁর লেখা আর অন্যত্র সেভাবে পাওয়া যায় না সেভাবে। রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বই আমরাই ছাপি।
মধুরিমা- বইমেলা ছাড়া অন্য সময়ে তবুও প্রয়াসের বই পাওয়া যাবে কোথা থেকে?
সেলিম- আমাদের নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে tobuoproyas.com। তাছাড়া কলেজস্ট্রিটে আমদের লালন বলে একটি দোকানে কাউন্টার আছে। সব বই সেখানে পাওয়া যাবে। আর হোয়াটস্যাপ তো আছেই।