স্টিল খোপ-থালা ও গোল্ড স্পট

Barbil and A Memorable Train Journey: এ বার দেবদূত নাগালে আসা মাত্র বাবা গোল্ড স্পটের একটি বোতল ওপরে চালান করতে বলল। অর্থাৎ আপার বার্থে তখন প্রকৃত অর্থেই চাঁদের হাট।

এই যে এখন এত বলি, লিখি— বরবিলে তখন আমার ছিল অনন্ত রোদ্দুর, আস্ত একটা ঠাকুরানি পাহাড়, নিমগাছ-ছায়া চরাচর, ক্রমে অদৃশ্যের মাত্রা ছোঁয়া রেললাইন ইত্যাদি। কই একটা খোপওলা স্টিলের থালা তো ছিল না? গরমে বা পুজোর ছুটিতে যখন কলকাতা আসতাম, দেখতাম মহার্ঘ সে বস্তু। কিন্তু ক্ষণিকের দেখার তো একটা সুনির্দিষ্ট টাইম লিমিট থাকে। বা স্লাইট ভুল বললাম, তার তো মাপ ধরে কোনও কার্যক্রমই থাকে না। ফলে অপূর্ণতা হেতু বিষাদ, ভরে তুলতে সক্ষম হয় আরও চওড়া বর্গফুট। ঠিক জানি না, ব্যথার খানিক উপশম না কি তার-সানাইয়ের আরও চড়া সুর নামত ফেরার ট্রেনে, মাঝে মাঝে। অর্থাৎ দ্বিপ্রহরকালীন রাহু-কেতু যে বারগুলোয় মিলে যেত, তখন। এক বার যেমন বড় ছড়িয়ে ফেলেছিলাম আমি।

ফিরছি বরবিল। নামব। চক্রধরপুর স্টেশন। সেখান থেকে চাইবাসায় সাধারণত একটা খাওয়ার হল্ট নেওয়া হত। সেবার প্রায় আমারই ওই খোপ থালায় খাওয়ার তাড়নায় কি না জানি না, বাবা-মা ঠিক করল, চাইবাসায় রঘুর হোটেল ক্যানসেল। ট্রেনেই খেয়ে নেওয়া হবে। এখন, স্লিপার ক্লাস নামে পেরিয়ে যাই যে কামরা, তা-ই তো আমাদের একমাত্র বৈতরণী পার, তখন। আমি সকালে উপরের বার্থ থেকে নেমে অনেকক্ষণ বসে ছিলাম নীচে, জানলায় তখন অজস্র হাওয়াশ্রমিক নিরন্তর খোদাই করে চলেছে মুহুর্মুহু লাল, নীল, সবুজ পাসিং শট, যেন চালে লেখা কত রামায়ণ। কখনও তাকিয়ে দেখেছি সেসব, ভেবেছি ওগুলো তাল গাছ, পুকুর, অজানা সব খেত-খামার। আসলে যে এক জায়গায় সাঁতরে সাঁতরে থিতু হতে চাওয়া আদিম কোনও কাঁথার বুনোট, এই এখন ধরতে পারি।

আরও পড়ুন: বিশ্বাসে মিলায়ে শোক, অঙ্কে বিয়োগফল

তখন ধরতে চাইতাম ঝুড়ির মধ্যে শালপাতা মোড়া দু’ভাগে বিভক্ত কমলা রঙা কুসুমওলা বিটনুনো সেদ্ধ ডিম বা একটা কাঠের ট্রে-তে ছড়ানো অনেক কিছুর মধ্যে জাস্ট আমার জন্যেই চুপিসাড়ে জেগে থাকা জেম্স-এর প্যাকেট কিংবা লোহার একটা প্রাচীন বটল ওপেনার দিয়ে সারি সারি বোতলের গায়ে বুলিয়ে একটা টি-রি-রি-রিং শব্দে ধূমায়িত গোল্ড স্পট বা…অনিঃশেষ এ সারণি। আমি যদ্দুর জানি, বায়নাবাজ ছিলাম না খুব একটা। কিন্তু তা বলে বায়না একেবারেই করিনি, এ আমার খুব বড় সমর্থক-ও বলতে পারবে না। এনিওয়ে, তো সেবার দূর হতে গুঞ্জরিত ওই টি-রি-রিং শব্দে যথারীতি আমার কান খাড়া, প্রাণ ঝলমল, চোখে মিনতি। কিন্তু ওই শেষ আশি/শুরু-নব্বইয়ের কলকাতা ময়দানে যেমন নিজের হাফ থেকে উঠে আসা অনবদ্য একটা ঝোড়ো মুভ শেষ অবধি ঠিক বিকাশ পাঁজিদের পায়ে পড়ে, ‘নাআআ হল নাআআ…’ হয়ে যেত, ঠিক সেরূপ বাবার চৌহদ্দিতে ঢোকার আগেই মুখ থুবড়ে পড়ে রইল আমার তখনও অবধি করা সলিটারি বায়নাখানি। অধরা এক জীবদ্দশার বোধ হয় এ ভাবেই হয় শুভ মহরৎ…

কিন্তু মায়া বড় বিষম বস্তু। ফলে প্রায় দুপুর নাগাদ আমি ফের যখন ওপরের বার্থ-নিবাসী, এবং খোপ থালায় হচ্ছে আমার স্বপ্নপুরণ, ঠিক তখনই ফের ভেসে এলো সেই অমোঘ রিনরিন। আমি ঘর পোড়া গরু ততক্ষণে, ফলে অতীব মন দিয়ে খোপ কাটা হাতের চাঁদ নিয়েই এ জীবন পেরিয়ে চলেছি। এখন ভুলে গেছি, সে বেলা ঠিক কী ছিল ওই খোপ কাটা থালায়! কিন্তু মনে আছে পরে বাড়িতে শুনেছি মায়ের মৃদু গঞ্জনা— ওগুলো বাড়িতে দিলে তো মুখে রচে না আর খোপ কাটা থালায় দিয়েছে বলে সে কী হাপুসহুপুস করে খাওয়া, বাবা গো! হাপুসহুপুস করে বোধহয় সে দিন সত্যিই খাচ্ছিলাম খোপ কাটা থালায় খাওয়ার আনন্দে কিন্তু অল্পক্ষণ পর যে কাণ্ডটি ঘটিয়েছিলাম, তাতে হাপুস নয়নে কাঁদার অবস্থা হয়েছিল ঠিক আমার বার্থের নীচে যে ভদ্রলোক বসেছিলেন, তাঁর। মা আর বাবার মুখ ঠিক দেখিনি বা দেখার সাহস করিনি, তাই মনে নেই— অভিব্যক্তি।

নাথিং মাচ। ওই যে বললাম খানিক আগে, মায়া বিষম বস্তু। আনন্দে আত্মহারা হয়ে খেতে খেতে যেই না আমি ওই বোতলে বটল ওপেনার দিয়ে আওয়াজ করার শব্দ পাই, চোখ চলে যায় সেদিকে। বাবা সেটা লক্ষ্য করে। মনে রাখতে হবে, কিছু আগে ঠিক একই বায়না আমার খারিজ হয়েছে পত্রপাঠ। এ বার দেবদূত নাগালে আসা মাত্র বাবা গোল্ড স্পটের একটি বোতল ওপরে চালান করতে বলল। অর্থাৎ আপার বার্থে তখন প্রকৃত অর্থেই চাঁদের হাট। অত্যুৎসাহের থিম সং যেমনটা হয়, তেমনটাই বাজল অতঃপর। একটা নিখুঁত প্যারাবোলা মেনে ওপর থেকে সহসা বর্ষিত হল বমি, সেই নীচের ভদ্রলোক লক্ষ্য করে। মুহূর্তেই ছত্রখান সভা, দমকল-প্রস্তুতি, আমার পেট উথলে আরও বিহ্বলতা— আর এ সবের মধ্যে অবাক পৃথিবীর মতো গোটা কিস্সাটি দেখে গিয়েছিল, ঘাবড়ে যাওয়া স্টিল খোপের থালাখানি।

হাতে চাঁদ পাওয়া বা না-পাওয়া সম্বন্ধে সেই থেকে আমি অধিক সতর্ক। ইনফ্যাক্ট বলা চলে, ঘোরতর অবিশ্বাসীও। অবস্থা এই পর্যায়ে যে সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ডরাই না আর। তা নিশ্চিত ভাবেই ডাকাবুকো নেচারের চিহ্নক নয়। বোঝায়, খোপে এঁটে উঠতে পারা একটা প্রতিনিয়তের দান চালা, একটা দিনান্তে লিস্ট মিলিয়ে দেখে নেওয়া, নাম উঠেছে কি না। হ্যাঁ, সেটা অলটুগেদার আলাদা ইস্যু, যে আপনি লিস্টে নাম নিয়ে আদৌ ভাবিত কি না। এ ধ্যানগম্ভীর লিস্ট বা ভাবনা তো তখন আমার থেকে আলোকবর্ষ দূরে কিন্তু লিস্টে নামের প্রতি আমার শ্যেন দৃষ্টি। বিশেষত যে যে বার আমরা চাইবাসায় নেমে সেই রঘুর হোটেলে থামতাম। বেসিকালি ভাতের হোটেল, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন আর ঢোকার মুখে দেওয়ালে একটা টিনের লম্বা পাতে সেঁটে সেঁটে কী কী পাওয়া যাচ্ছে, তার লিস্ট। সবুজ সানমাইকাওলা টেবিলগুলো, আলো-হাওয়া ভাল খেলে আর খোপ থালা না দিলেও আমার একটা বিশেষ আকর্ষণ থাকত, প্লাস্টিকের থালায় ভাত বেড়ে দেওয়ার কায়দায়। ফ্ল্যাট করে ভাত দিত ওরা, পুরো থালাটা কভার করত। সঙ্গে আরও অনেক কিছুই মা-বাবা নিত, কিন্তু তটরেখায় যে ভাবে হয়তো অজান্তেই মৎসকন্যারা শুয়ে থাকে, ঠিক সে ভাবেই বাটির সব লক্ষ্মণরেখা ছাড়িয়ে একা পারশে মাছের লেজ যে তেজ দর্শাত, তা এখনও ভুলিনি। আমি কিন্তু মাছতুতো নই, ফলে ওটা পারশে না হয়ে শান্ত একটি কামট হলেও আমার কিছু যায়-আসত না। আমায় ফ্যাসিনেট করত ওই দেওয়ার কায়দা। ওই আলাদা করে একটা বাটিতে লঙ্কা, পেঁয়াজ, একটু নুন। শেষে মিছরি।

আরও পড়ুন: ছোট টাউনের আশ্চর্য সেই হাওয়া

টেবিলে রঘু দিতেন আর একটা বাচ্চা ছেলে ছিল, নাম কী আজও জানি না, সে দিত। রঘুদের গ্রামেরই। একদিন রঘুর হোটেলে গিয়ে দেখা গেল, অন্য একটা ছেলে নুন-লঙ্কা দিচ্ছে, আগের জন নেই। হাত-টাত ধুয়ে বাবা এসে বসেছে, রঘু ভাত আর অন্যান্য সব দিয়ে গেলেন। বাবা জিজ্ঞেস করল— রঘু দেখলাম, ওই নতুন সব খোপ-খোপ থালা কিনে এনেছ, তো এ বার থেকে তুমিও ট্রেনের মত ওতে দেবে না কি খেতে? রঘু কোনও দিন উল্টো দিকে চেয়ারে বসতেন না, সে দিন অনুমতি নিয়ে বসলেন। কিচ্ছু বললেন না মুখে, স্রেফ মাথাটা নিচু করে নাড়লেন, মানে না। আমরা ততক্ষণে খেতে শুরু করেছি। কৌতূহলী হয়ে মা তাকিয়ে রঘুর দিকে, কারণ জানতে। কেনা আছে, তা-ও দেবে না কেন? রঘু উঠে যেতে যেতে অস্ফুটে উড়িয়া, বাংলা মিশিয়ে বলেছিলেন, বুধাইকে কথা দেওয়া ছিল ও প্রথম ওই খোপ থালায় খাবে। সে রাতে কাজ শেষ হওয়ার পর নাকি ওর তর সইছিল না, কখন খেতে বসবে, দৌড়ে পাশের কুয়ো থেকে জল তুলে স্নান করতে গিয়েছিল।

পিচ্ছিল ছিল…

এ ভাবেই তো কতশত’র রাখাল সাজা হয় না আর!

More Articles