মাতৃদুগ্ধেও প্লাস্টিক! রোজ যাচ্ছে শিশুর পেটে! ভয়াবহ তথ্য এবার সামনে
Plastic Pollution in India: বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ১৯২ টি উপকূলীয় দেশ থেকে প্লাস্টিক গিয়ে জমা হয়েছে সমুদ্রে যার পরিমাণ ৪.৮ থেকে ১২.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন!
পাহাড় না সমুদ্র? এই পছন্দের প্রশ্নের উত্তর ভিন্ন। কারও পাহাড়, কারও আবার সমুদ্র। তবে অন্য গ্রহ থেকে পৃথিবীকে দেখলে মনে হয় এ যেন সমুদ্রেরই দেশ। পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রায় ৭০ শতাংশই মহাসাগর। ভারতেরই প্রায় ৭০০০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে রয়েছে উপকূল রেখার বিস্তার। এছাড়াও রয়েছে ১০০০ টি সমুদ্র তীরবর্তী দ্বীপ। আর এই বিশাল সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রেখেছে প্রায় এক মিলিয়নেরও বেশি প্রজাতির প্রাণী। যার মধ্যে এখনও পর্যন্ত প্রশান্ত মহাসাগরে সব থেকে বেশি পরিমাণ প্রজাতির প্রাণীর খোঁজ পাওয়া গেছে বলে জানা যায়। তবে, যেমনভাবে সৃষ্টির মধ্যে ধ্বংসের বীজ বপন হয় তেমনই যার মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের সঞ্চার হয়েছিল সেই সামুদ্রিক ইকোসিস্টেমও আজ প্রায় নিঃশেষ হওয়ার পথে। এর কারণ কী?
একটি সমীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক নষ্ট হয় যার মধ্যে ১১ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক এসে জমা হয় সমুদ্রে। সর্বমোট যে পরিমাণ প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার হয়, তার প্রায় ১০ থেকে ৩৫ শতাংশই একক ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বা Single use Plastic। প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারের ফলে দূষণের ঝুঁকি অল্প কমলেও সেই হার মাত্র ৯ শতাংশ।
গবেষকদের অনুমান, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে মাছের থেকেও বেশি পরিমাণ প্লাস্টিক পাওয়া যেতে পারে। প্লাস্টিক সহজে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে পারে না বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি ছোট হয়ে গুটিয়ে যায়। যার ফলে অনেক সময় মাছেরা খাবার ভেবে প্লাস্টিক খেয়ে ফেলে। পরবর্তীতে সেই মাছ যখন মানুষের পেটে যায় তা উপকারের পরিবর্তে অপকার করে অধিক। এছাড়াও, প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে বিভিন্ন ক্ষতিকারক ভারী ধাতু সমুদ্রের জলে মেশে যা মানবজীবনসহ প্রাণী বৈচিত্র্যকেও নষ্ট করে দেয়।
আরও পড়ুন- আর কিছুদিনেই পরিত্যক্ত নগরী হতে চলেছে রাজধানী দিল্লি! বিষের বাষ্পে যে ইঙ্গিত
২০১৫ সালে ‘জ্যামবেক এট আল’ সমুদ্রে প্লাস্টিকের প্রবেশ এবং দূষণ নিয়ে একটি সমীক্ষা করে। সেই সমীক্ষায় দেখা যায়, বেশির ভাগ প্লাস্টিক স্থানীয় এলাকা থেকেই সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ১৯২ টি উপকূলীয় দেশ থেকে প্লাস্টিক গিয়ে জমা হয়েছে সমুদ্রে যার পরিমাণ ৪.৮ থেকে ১২.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন! আসলে কোন দেশ থেকে কতটা পরিমাণ পরিত্যক্ত প্লাস্টিক এসে সমুদ্র জমা হয়েছে তা বোঝা যায় মূলত সেই দেশের জনসংখ্যার ভিত্তিতে। অনুমান করা হচ্ছে, সঠিক ব্যবস্থা নিয়ে এই প্লাস্টিক দূষণ যদি বন্ধ করা না যায় তাহলে ২০২৫ সালের মধ্যে সমুদ্রে দূষণের মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়াবে।
তিন দশক ধরে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত সংস্থা ‘আর্থ সিস্টেম সায়েন্স অর্গানাইজেশন’ বর্তমানে যেটি ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর ওশান রিসার্চ’ নামে পরিচিত, তারা একটি সমীক্ষায় দেখায় যে ভারতবর্ষে সামুদ্রিক প্লাস্টিক দূষণের প্রায় ৮% শতাংশ শুধুমাত্র ৩ টি শহরকে কেন্দ্র করে। যার মধ্যে রয়েছে আমাদের সাধের তিলোত্তমাও! কলকাতা, দিল্লি, আহমেদাবাদ এই দূষণকে বাড়াচ্ছে চরমে। দেশে প্লাস্টিক নির্মাণের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩৯.৮ শতাংশ এবং বর্তমানে শুধুমাত্র ভারতবর্ষেই প্রায় ৯.৪৬ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক নষ্ট হয় প্রতিবছর। পাঁচ বছর আগে যার পরিমাণ ছিল ৫.৭ মিলিয়ন টন।
বিজ্ঞানীদের মতে, প্লাস্টিকজাত সামগ্রীর কারণে বর্তমানে প্রায় ২৬৭ প্রজাতি ক্ষতিগ্রস্ত। সামুদ্রিক কাছিমের অন্তত ৮৬%, সামুদ্রিক পাখির ৪৪% এবং সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর অন্তত ৪৩% প্লাস্টিক দূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাজারে খাদ্য লবণের প্রায় বেশির ভাগই আসে বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় জমি থেকে। আর এই সকল এলাকায় প্রচুর পরিমাণে সামুদ্রিক প্লাস্টিক দূষণের কারণে মাইক্রোপ্লাস্টিক বর্তমানে লবণের সঙ্গে মিশে গেছে। বিজ্ঞানীরা এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, সামুদ্রিক লবণে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা বা মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি বাংলাদেশে সবথেকে বেশি। যার ফলে প্রতিবছরই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বহু মানুষ।
আরও পড়ুন- কোভিডের টিকাতেই ছিল মৃত্যুফাঁদ! বিস্ফোরক যে তথ্য আসছে প্রকাশ্যে
কী এই পলিথিন বা প্লাস্টিক?
প্রধানত পলিথিন বা প্লাস্টিকের মূল উপাদান হলো ইথিলিন যা সাধারণত কোল গ্যাসে ৫ শতাংশের মতো থাকে। এছাড়া পেট্রোলিয়াম থেকে যে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপন্ন হয় সেখানেও কিছুটা পরিমাণ থাকে। ইথিলিনকে পলিমারাইজ় করেই সাদা রঙের কঠিন পদার্থ অর্থাৎ পলিথিন তৈরি করা হয়। এই উপাদান থেকেই তৈরি হয় ঘরের বিভিন্ন জিনিসপত্র যেমন চেয়ার, টেবিল, জলের বোতল ইত্যাদি। তবে প্লাস্টিক যেহেতু সহজে নষ্ট হয় না তাই যতদিন না পর্যন্ত এটি রিসাইক্লিং করা হয় ততদিন তা পরিবেশের মধ্যেই থেকে যায়। এছাড়াও ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিকে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ থাকে যা নদী বা সমুদ্রের জলের সঙ্গে মিশে ভয়ঙ্কর জল দূষণ ঘটায়।
এবছর ২৮ জুন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক জানিয়েছে, “ভারত একবার ব্যবহার যোগ্য প্লাস্টিকের জিনিসগুলি তৈরি, আমদানি, মজুদ, বিতরণ, বিক্রয় এবং ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। চলতি বছর ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে ভারত সরকারের উদ্যোগে ৭৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলরেখা সংলগ্ন ৭৫টি সমুদ্র সৈকত ৭৫ দিন ধরে পরিষ্কার করার কাজ চালানো হয়। ১৭ সেপ্টেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক উপকূলীয় পরিচ্ছন্নতা দিবস’ বা ‘ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিনআপ ডে’ হিসেবেও পালন করা হয়। এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল সমুদ্র উপকূল থেকে ১৫০০ টন আবর্জনা পরিষ্কার করা যা সামুদ্রিক জীব এবং স্থানীয় মানুষকে সুষ্ঠু জীবন প্রদান করতে সক্ষম হবে।
২০০২ সালে বাংলাদেশ প্রথম প্লাস্টিক প্রয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এরপর একে একে ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ড, ২০২০ সালে চিন এই প্রক্রিয়া শুরু করে। বর্তমানে প্রায় ৮০ টিরও বেশি দেশ প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।
প্লাস্টিক ব্যবহার এবং এর দূষণের ফলে একটি বড় অংশের প্রাণী গোষ্ঠী যে ধীরে ধীরে বিলুপ্তর পথে যাচ্ছে তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কখনও মরা তিমির পেট থেকে ১০০ কেজি প্লাস্টিক পাওয়া গেছে আবার কখনও বা কচ্ছপের পেট থেকে ১০৪ টি প্লাস্টিকের টুকরো পাওয়া গেছে। বাদ পড়েনি মাতৃদুগ্ধও! এমতাবস্থায় সমুদ্র তথা পরিবেশকে সজীব রাখার মূল কারিগর যে মানুষকেই হতে হবে তা নিয়ে দ্বিমত নেই।