কলকাতার বাতাসে বিষ! উদাসীন থেকে কত বড় বিপদ ডেকে আনছে শহরবাসী
বাতাসে PM 2.5 ধূলিকণার নিরিখে কলকাতা গোটা বিশ্বে এই মুহূর্তে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। প্রথম স্থানেও কোনও চমক নেই। শিল্ড দেশের বাইরে যায়নি। প্রথম স্থান অধিকার করেছে রাজধানী দিল্লি।
তিলোত্তমা কলকাতা। কলকাতা দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী, সেই সঙ্গে ক্রিকেট এবং ফুটবলপাগল এই শহর। ভীষণভাবে রাজনৈতিকও। এখন তো আবার রাজনীতির বাইরে আর কোনওকিছুতেই কলকাতার মন নেই। রাজনীতি, বা আরও স্পষ্ট করে বললে রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতি। কিছুদিন পরেই আবার পুজোও এসে যাচ্ছে। বাঙালি এবং কলকাতা ভীষণ ব্যস্ত করে পড়বে। সবই ঠিক আছে, কিন্তু এই ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেই একটা চিন্তার কারণ থেকে যাচ্ছে, বা বলা ভালো, চিন্তার কারণ আরও গভীর হচ্ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে। কলকাতাবাসীর ফুসফুস একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে তারা সেদিকে আর ঠিক নজর দিতে পারছে না। এইবার কি দেবেন?
কিন্তু কেন? নজর দেওয়ার মতো কোনও ঘটনা ঘটেছে নাকি? হ্যাঁ, ঘটেছে। যদিও নতুন কিছু নয়। কিছু বছর আগেও এই মুকুট আমাদের শহরের মাথায় ছিল। আবার ফিরে এসেছে। বাতাসে PM 2.5 ধূলিকণার নিরিখে কলকাতা গোটা বিশ্বে এই মুহূর্তে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। প্রথম স্থানেও কোনও চমক নেই। শিল্ড দেশের বাইরে যায়নি। প্রথম স্থান অধিকার করেছে রাজধানী দিল্লি।
Global Air report on Air Quality and Health in Cities-এর নতুন রিপোর্ট অনুযায়ী আমাদের শ্বাসযন্ত্রের জন্য সবথেকে ক্ষতিকারক অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা PM 2.5 দিল্লি এবং কলকাতার বাতাসে সবথেকে বেশি পাওয়া গেছে। ১৪তম স্থানে আছে দিল্লী। দিল্লির বাতাসে প্রতি কিউবিক মিটারে পাওয়া গেছে ১১০ মাইক্রোগ্রাম PM 2.5। কলকাতার বাতাসে যার পরিমাণ ৮৪ মাইক্রোগ্রাম। WHO-এর নির্ধারিত নিরাপদ PM 2.5-এর মাত্রা কত জানেন? পাঁচ মাইক্রোগ্রাম। এই রিপোর্টে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের সংস্পর্শে আসার নিরিখে যদিও দেশের কোনও শহর প্রথমে নেই। সেই তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে সাংহাই।
আরও পড়ুন: দিল্লিবাসীর নাভিশ্বাস! পরিবেশ ধ্বংসের পরিণাম ফলছে, বাসের অযোগ্য হবে রাজধানী?
এবার একটু পরিসংখ্যানে আসা যাক। অস্বাস্থ্যকর বায়ু বা দূষিত বায়ু ফুসফুসে প্রবেশ করার কারণে গোটা বিশ্বে গড়ে চল্লিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। এই চল্লিশ লক্ষর মধ্যে দশ লক্ষই ভারতীয়। আমাদের দেশে দূষণ এতটাই বেশি এবং সরকার তা কমাতে এতটাই ব্যর্থ যে, WHO-র নির্ধারণ করা মাত্রাকে (পাঁচ মাইক্রোগ্রাম) মানা সম্ভব হয়নি এই দেশে। তা বাড়িয়ে করা হয়েছে চল্লিশ মাইক্রোগ্রাম। কিন্তু তাতেও বিশেষ লাভ কিছু হয়নি। মানুষের প্রাণ তাতে বাঁচানো যায়নি। পাশ করার নম্বর একটু এদিকওদিক করে হয়েতো নিজেদের সান্ত্বনা দিতে সুবিধা হয়েছে Central Pollution Control Board-এর কর্তাদের।
বিভিন্নভাবে নাগরিকদের স্বাস্থ্যহানি হওয়া সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত কোনও সরকারকেই সদর্থক কোনও ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্যবিদ থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী সবাই বারবার বলছেন যে, দূষিত বায়ু থেকে শ্বাসজনিত রোগ থেকে শুরু করে ক্যানসার, হৃদযন্ত্রের সমস্যা- সবকিছু হতে পারে; এবং যদি একটু সময় নিয়ে নিজেদের কাজ করেন সরকারি অধিকর্তারা, তাহলে শুধুমাত্র সরকারি হাসপাতালের আপৎকালীন ওয়ার্ডে গেলেই তাঁরা বুঝবেন যে, বায়ুদূষণের কারণে কত মানুষ ভুগছেন। হয়তো সেই সংখ্যার সিংহভাগ আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষ বলেই এই মুহূর্তে গা করছেন না তাঁরা।
কিন্তু আর কত দিন? আপনারা রাস্তায় বেরিয়ে খেয়াল করেন কি না জানা নেই, তবে এখনও কলকাতার রাস্তায় ভূরি ভূরি ট্যাক্সি, বাস, লরি নিশ্চয়ই দেখতে পাবেন, যারা সম্পূর্ণভাবে কালো ধোঁয়া ছাড়ে, তার পরিমাণ এতটাই থাকে যে, শুধু স্বাসকষ্ট হয়, তা নয়, তার সঙ্গে দৃশ্যমানতাও কমে যায় কিছু সেকেন্ডের জন্য। খুব সহজেই বলে দেওয়া যায় যে, ওগুলো পনেরো বছরের পুরনো বাহন। আইন অনুযায়ী যার রাস্তায় নামারই কথা নয়। কিন্তু আইন বলবৎ কে করবে? যাদের করার কথা, তারা তো দর্শকের ভূমিকা পালন করে। কিছু চালকের জরিমানা হয়, ব্যস। যদিও তারা গ্রিন বেঞ্চের সামনে দাবি রাখেন যে, তারা কাজ করছেন, কিন্তু সেই দাবি রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিশ্রুতির মতোই ফাঁপা।
তাছাড়াও সার্বিকভাবে কলকাতার বায়ুকে দূষণমুক্ত করার ছিটেঁফোঁটা পরিকল্পনাও যদি সরকারের থাকত, তাহলে তারা রাস্তাঘাটে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে, যানপরিপল্পনা হতো অনেক উন্নত। যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা নির্মাণকাজে নজরদারি চলত, যেখানে-সেখানে গাছ কাটা, পুকুর বোজানো বন্ধ হতো। সেই সঙ্গে নজরদারি থাকত কলকারখানাগুলির ওপরেও, যারা ব্যাপক হারে দূষণ ছড়ায়। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মানুষকে সচেতন করার কাজ, যা কোনওভাবেই করা হয় না।
সবশেষে বলা দরকার, সাধারণ মানুষের কথা। তাঁরা বিষাক্ত বায়ু সেবন করছেন, কষ্ট পাচ্ছেন, কিন্তু তাঁর পরেও যদি সেই বিষয়ে উদাসীন থেকে অন্যান্য বিষয়েই নিজেদের সময় ব্যয় করেন, সেক্ষেত্রে অবস্থার উন্নতি হওয়া বেশ কঠিন।