এই পুকুরের পাড়েই আজও প্রেম করে মানুষ! কলকাতা জানেই না এই পুকুরের নাম...
Birji Talao: সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল গির্জার কাছেই ছিল সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি। রবীন্দ্রনাথ সেই বাড়িতে আসা যাওয়া করতেন।
ভূতের ভবিষ্যৎ সিনেমায় সব্যসাচী চক্রবর্তী অভিনীত বিপ্লব দাশগুপ্ত এবং পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত অয়ন সেনগুপ্তের কথোপকথনে উঠে এসেছিল ভূত সমাজের দুর্দশার কথা। ভূতদের সম্পর্কে মানুষ বড়ই উদাসীন। তাই তাদের দুর্দশা সম্পর্কে রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, কারওই খুব একটা মাথাব্যথা নেই। তবে কলকাতার বিভিন্ন বিখ্যাত অথবা অখ্যাত মানুষের ভূত অথবা মরণোত্তর দশা সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ থাকলেও খোদ কলকাতার ভূত অথবা অতীত সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষ খুবই উদাসীন। তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো কলকাতার এক বিখ্যাত কিন্তু বর্তমানে নামহীন পুকুর। সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল গির্জার পিছনে নন্দনের প্রায় গা ঘেঁষে রয়েছে একটি পুকুর। মানুষ অন্ধকারে তার ধার ঘেঁষে প্রেমালাপ করেন, সুখ দুঃখের কথা আওড়ান, পুকুরকে স্বচক্ষে দেখতে পেলেও তার পরিচয় জানার খুব একটা চেষ্টা করেন না। এমনকী পুকুরের নাম লেখা একখানি সাইনবোর্ডও ভাগ্যে জোটে না। গুগল ম্যাপেও এই পুকুরের নামের জায়গাটা ফাঁকা। এ যেন মানুষকে যেমন খুশি শূন্যস্থান পূরণ করার অনুমতি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে আসা মানুষের কাছে নামহীন, পরিচয়হীন পুকুর হিসাবে থেকে যাওয়া এই জলাশয়ের এককালে নাম ছিল বির্জী তালাও। বর্তমানে মানুষের চোখে নেহাতই সামান্য এই পুকুরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। সেই দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী এই পুকুর দেখেছে প্রাচীন উপজাতি, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার হরিণ শিকার, ব্রিটিশ শাসন, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল গির্জার নির্মাণ, রবীন্দ্রনাথ এবং তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর অভিনয়, স্বাধীনতা।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, জলাশয়ের এইরকম নাম হয়েছিল কেন? তার উত্তর লুকিয়ে রয়েছে ইংরেজ শাসনের পূর্বের প্রাচীন কলকাতায়। তখন কলকাতা বলতে ছিল কিছু জঙ্গলে ঘেরা গ্রাম। এমন এক সময়ে বর্তমান বাংলা, বিহার, ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ার পূর্বে বির্জী উপজাতির কিছু মানুষ এই এলাকায় বসবাস করেছিল। বির্জী উপজাতির নাম অনুসারেই এই পুকুরের নাম হয়েছিল বির্জী তালাও। কথিত আছে, সিরাজ-উদ-দৌলার শাসনের সময়ে এই জলাশয়ের কাছেই তৈরি হয়েছিল হরিণ শিকার বাড়ি। চারিদিকে জঙ্গলে ঘেরা এলাকার মধ্যে মিষ্টি জলের পুকুরের কাছেই শিকার বাড়ি তৈরি করার যথার্থ কারণ সহজেই বোঝা যায়। ১৭৯২ সালের আপজনের তৈরি ম্যাপে বির্জী তালাওয়ের নাম পাওয়া যায়। যদিও তখন তার নাম লেখা হয়েছিল বির্জী টোলা। পরবর্তীকালে, ১৮২৫ সালে লটারি কমিটির প্রকাশিত ম্যাপে বির্জী তালাও নামটা পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন- নীলদর্পণের সঙ্গে জড়িয়ে কলকাতার রাস্তা! জেমস লং সরণির নামকরণ হয়েছিল কার নামে?
ঊনবিংশ শতকেই বির্জী তালাওয়ের সঙ্গে জড়িয়ে যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল গির্জার কাছেই ছিল সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি। রবীন্দ্রনাথ সেই বাড়িতে আসা যাওয়া করতেন। সেই সময়ে এই বির্জী তালাওয়ের নিকটেই রাজা ও রানি নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল। সেই নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে বিক্রমের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন এবং তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবী নারায়ণীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সম্ভবত এই একবারই মৃণালিনী দেবী নাটকে অভিনয় করেছিলেন।
১৯৯৬ সাল অবধি খাতায় কলমে বির্জী তালাওয়ের পরিচয় ছিল। কলকাতার অ্যাটলাস অনুযায়ী তখনও সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল গির্জার পিছনে নন্দনের প্রায় গা ঘেঁষে রয়েছে একটি পুকুর যার নাম বির্জী তালাও। তারপর আর নেই। নতুন শতাব্দীর সঙ্গে অ্যাটলাসের পাতায় সে হয়ে গেল নামহীন, পরিচয় হীন, নেহাতই ছাপোষা এক পুকুর। নতুন শতাব্দীর সঙ্গে এল গুগল ম্যাপ। প্রযুক্তি মানুষকে বোঝাল, রাস্তা না চিনলেও চিন্তা নেই। সেই মানুষকে সব জায়গায় সঠিকভাবে পৌঁছে দেব। সে মানুষকে বিভিন্ন জায়গার সঠিক নাম বলবে। যদিও বির্জী তালাও গুগল ম্যাপের কাছেও হয়ে রইল বেনামী পুকুর। এ যেন এমন এক গুরুত্বহীন পুকুর যাকে যেকোনও দিন বুঁজিয়ে ফেলে দাঁড়িয়ে পড়বে কোনও ফ্ল্যাটবাড়ি। অবশ্য প্রযুক্তির কীই বা দোষ! বির্জী তালাওকে ভুলে গিয়েছে মানুষই। বির্জী তালাওয়ের মতোই মানুষ ভুলে যায় নিকটবর্তী আরও একটি পুকুরের গল্প, যে গল্পে লুকিয়ে আছে এক বৈষম্যের আখ্যান।
আরও পড়ুন- নুনের বাজার থেকে নাম হলো শ্যামবাজার! শোভাবাজারের শোভা আসলে কে?
পার্ক স্ট্রিটের কাছেই একটি রাস্তার নাম ছিল কিড স্ট্রিট। রাস্তার নাম বর্তমানে পরিবর্তিত হলেও বহু মানুষ আজও সেই রাস্তাকে কিড স্ট্রিট বলেই চেনে। এই রাস্তায় থাকা এক পুকুরের কারণেই পুরনো কলকাতায় রাস্তার নাম মানুষের মুখে হয়ে গিয়েছিল ঝিঞ্ঝিরী তালাওয়ের রাস্তা। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর কাউন্সিল ছিলেন পিটার স্পিক। তার বাড়ির পাশেই খনন করা হয়েছিল একটি পুকুর। যদিও কিছু ইংরেজ মোটেই চাননি যে, কোনও ভারতীয় সেই পুকুরে স্নান করুক। তাই তারা পুকুরের চারপাশে এমন ঝাঁঝরির ব্যবস্থা করে যার ফলে পুকুরের মালিকের অনুপস্থিতিতে অথবা বিনা অনুমতিতে কেউ পুকুরে স্নান করতে অথবা পুকুরের জল ব্যবহার করতে পারত না। বর্তমানে সেই ঝাঁঝরি অথবা সেই নাম কোনওটাই নেই। ৭৫ বছর পেরিয়েছে স্বাধীন দেশের, প্রযুক্তি ঘিরে ফেলেছে মানুষকে, ইতিহাসের গন্ধ মুছতে শুরু করেছে খোদ মানুষই। এই পুকুরগুলিও মানুষের চোখের সামনে থেকেও অজানা অচেনাই থাকছে। শিকড়ের প্রতি এই অনীহার বশে যদি একদন এই পুকুর চাপা দিয়ে কাঠামো খাড়া হয়ে যায়, কলকাতার প্রাচীনত্বের এক চাঙড় খসে পড়ে, তখন পরিবেশ ধ্বংসের বুলি আউড়ে কি শান্তি পাবে মানুষ?
তথ্য ঋণ : টাইমস অব ইন্ডিয়া, ডাঃ উপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস, কাহো, গল্প হলেও সত্যি (ইউটিউব )