বেলেঘাটা থেকে এন্টালি, হেদুয়া থেকে জোড়াবাগান, কীভাবে এল কলকাতার এসব এলাকার নাম

কলকাতার বিভিন্ন এলাকার নামের সঙ্গে তাদের নামকরণের বিচিত্র কারণ খুঁজতে গেলেই আমরা অনেক অজানা গল্প জানতে পারি।

 

জোড়াবাগানে কার বাগান ছিল, বেলেঘাটায় ঘাট নেই কেন? ক্রিক রো-তে কোন ডিঙি ভেঙেছিল? হেদুয়া এবং এন্টালির নামের কারণ কী? কলকাতার বিভিন্ন এলাকার নামের সঙ্গে তাদের নামকরণের বিচিত্র কারণ খুঁজতে গেলেই আমরা অনেক অজানা গল্প জানতে পারি।

কলকাতার প্রথম কালো জমিদার নামে পরিচিত ছিলেন গোবিন্দরাম মিত্র। ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। গোবিন্দরাম জমিদারি থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। তাঁর কঠোর মনোভাবের কথা সেই সময়ের মানুষের মুখে মুখে ঘুরত। দোষীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য তিনি বিভিন্ন অদ্ভুত এবং নৃশংস পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। এই ধূর্ত জমিদারকে ব্রিটিশরা সমীহ করত, কারণ তাঁর বিরুদ্ধে কাজে অসৎ উপায় অবলম্বন করার অভিযোগ উঠলেও নিজের বুদ্ধিমত্তার জোরে গোবিন্দরাম কোনও শাস্তি পাননি। গোবিন্দরামের সমসাময়িক ছিলেন ব্যবসায়ী উমিচাঁদ। তিনি প্রধানত নুন এবং অফিমের ব্যবসা করতেন। ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে ব্রিটিশদের সাহায্য করার কারণে তাঁর ধনসম্পত্তি ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। যদিও তিনি পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের দ্বারাই প্রতারিত হয়েছিলেন। গোবিন্দরাম এবং উমিচাঁদের একই জায়গায় দু'টি বাগান ছিল। সেই বিশাল এলাকা ঘিরে থাকা বাগানদু'টি থেকেই এলাকার নাম হয়ে যায় জোড়াবাগান।

ব্রিটিশ শাসনকাল এবং তার পূর্বে কলকাতায় হুগলি নদী থেকে বহু খাল কেটে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এই খালগুলিতে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরণের নৌকো এবং জাহাজ চলাচল করত। সেইরকম একটি বড় খালের একটা ঘাটের পাশে বালি জমা হয়েছিল। বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায় যে, বড় নৌকো এবং ছোট জাহাজ সেই ঘাটে নোঙর করত। ঘাটের পাশে বালির কারণেই এই এলাকার নাম প্রথমে হয় বেলিয়াঘাটা। পরবর্তীকালে মানুষের মুখে মুখে বেলিয়াঘাটার নাম পরিবর্তিত হয়ে বেলেঘাটা নামের প্রচলন শুরু হয়। এই খাল যে এলাকার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হতো, তারই একটা অংশের বর্তমান নাম ক্রিক রো। ক্রিক রো-এর পুরনো নাম ছিল ডিঙাভাঙা। কলকাতায় আছড়ে পড়া এক ঘূর্ণিঝড়ে এই এলাকায় একটা নৌকা ডুবে গিয়েছিল। তাই মানুষের মুখে মুখে এই এলাকার নাম হয়েছিল ডিঙাভাঙা। সেই খাল আজ চোখে দেখা না গেলেও তার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন এলাকার নামের পিছনে তার অবদান তাকে ইতিহাসের কিছু ঘোলাটে পাতায় স্থান দিয়েছে।

আরও পড়ুন: হাতিবাগানে কার হাতি ছিল, উল্টোডাঙা কেন উল্টো? কলকাতার এইসব অঞ্চলের নাম যেভাবে এসেছে

উত্তর কলকাতার একটি পরিচিত জায়গার নাম হেদুয়া। এই নামের কারণ হিসেবে রয়েছে শুধু জনশ্রুতি। কথিত রয়েছে যে, এই এলাকার একটা বড় হ্রদ থেকেই এটি নিজের নাম পেয়েছে। সাধারণ মানুষের উচ্চারণের ভুলের কারণেই 'হ্রদ' শব্দটি বদলে হেদুয়া হয়ে যায়। একইভাবে এন্টালি নামের পিছনে রয়েছে দু'টি জনশ্রুতি। কলকাতা শহর যে এক সময় জঙ্গলাকীর্ণ ছিল, সেই কথা বহু মানুষ জানে। প্রথম জনশ্রুতি অনুসারে মধ্য কলকাতার একটি এলাকায় হেতাল গাছের জঙ্গল ছিল। যদিও বর্তমানে হেঁতাল গাছের কথা বললে মানুষের প্রথমেই সুন্দরবনের কথাই মনে পড়বে, কিন্তু তিনশো বছর আগে যেই এলাকায় স্বয়ং বাঘমামা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতেন, সেখানে যে হেঁতাল গাছের জঙ্গল থাকতেই পারে, সেই কথা বলা বাহুল্য। হেঁতাল গাছে পরিপূর্ণ এলাকার নাম লোকমুখে প্রথমে হয় হেঁতালি এবং পরবর্তীকালে মানুষের উচ্চারণের কারণেই এই এলাকা নাম হয় এন্টালি। দ্বিতীয় জনশ্রুতি অনুসারে, এই এলাকায় একটি বাজারের নাম ছিল এনায়েত আলি বাজার। সেই বাজার বর্তমানেও রয়েছে। সেই বাজারের নাম থেকেই এলাকার নাম হয়ে যায় এন্টালি।

কলকাতার বিভিন্ন এলাকা শুধুমাত্র মানুষের নাম এবং কাজ থেকেই তাদের নাম পায়নি। দু'টি বন্য জন্তুর নাম থেকে উত্তর কলকাতার দু'টি এলাকা তাদের নাম পেয়েছে। ব্রিটিশদের বাঘ শিকারের জন্য পছন্দের এলাকার নাম হয়ে যায় বাগমারী। কথিত আছে যে, এই এলাকায় একটি বাঘ আহত হয়েছিল অথবা শিকারির গুলিতে মারা গিয়েছিল। তাই এই এলাকার নাম প্রথমে হয় বাঘমারী এবং ক্রমে লোকমুখে সেই নাম হয়ে যায় বাগমারী। যদিও এই নামের পিছনে কোনও অকাট্য সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না। উত্তর কলকাতায় একটি জঙ্গল এবং বাগানে প্রচুর বাদুড় থাকত। এই প্রচুর পরিমাণ বাদুড় থাকার কারণে লোকমুখে এই এলাকার নাম হয়ে যায় বাদুড়বাগান। ঠিক একইভাবে প্রচুর পরিমাণে হালসি গাছের জঙ্গলে পরিপূর্ণ এলাকার নাম হয়ে যায় হালসিবাগান। বর্তমানে বাগমারীতে বাঘ নেই, হালসিবাগানে গাছের বদলে হয়েছে কংক্রিটের জঙ্গল। বাদুড়বাগানে হয়তো দল বেঁধে বাদুড় থাকে না। এলাকা গুলোর নামের কারণ হারিয়ে গিয়ে শুধু নাম রয়ে গিয়েছে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম উঠলে কলকাতার জোড়াসাঁকো এবং পাথুরিয়াঘাটার নাম উঠে আসে। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির কাছেই একটি খালের ওপরে থাকা দুটো সাঁকো থেকেই জোড়াসাঁকো এলাকা তার নাম পেয়েছিল। যদিও বর্তমানে সেই খাল এবং সাঁকোর অস্তিত্ব নেই। একইভাবে হুগলি নদীর ধারে পাথরের বাঁধানো ঘাট থেকেই পরবর্তীকালে এলাকার নাম হয় পাথুরিয়াঘাটা।

কলকাতার ইতিহাস বড়ই বিচিত্র। তার বিভিন্ন এলাকার নামের ক্ষেত্রেও সেই বৈচিত্র্যের দেখা পাওয়া যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কলকাতার ইতিহাস সঠিকভাবে নথিবদ্ধ না করার ফলে এই অজানা তথ্য আমাদের অগোচরে থেকে যায়। সেই তথ্য অনুসন্ধানের চেষ্টা না করলে ইতিহাসের এই পাতাগুলি হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে।

More Articles