১ পয়সা ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কেঁপেছিল কলকাতা, ট্রামের মতোই ম্রিয়মাণ বাম আন্দোলন?
Kolkata Tram Fare Hike Protest: ১৯৫৩ সালে বিধান চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার সিদ্ধান্ত নিল ১ জুলাই থেকে ট্রামের দ্বিতীয় শ্রেণির ভাড়া এক পয়সা বাড়ানো হবে।
কলকাতার স্বাদ কেমন? শহরের আবার স্বাদ হয় নাকি! ভাঙা পাঁচিল, হিলতোলা জুতোর মতো বেখাপ্পা বাড়ি, পচা নালি, এঁদো গলি, মুটে-মজুরদের তেল চিটচিটে গা, কর্পোরেট স্যুটকেসের নব্য তালার মধ্যে কী স্বাদ থাকতে পারে একটা শহরের? কলকাতার স্বাদ জানে কলকাতার সড়ক, কলকাতার তালা ঝোলানো সমস্ত প্রাচীন পার্টি অফিস, ইতিহাস মনে রাখা সমস্ত পুস্তিকা জানে কলকাতা আসলে ঝাঁঝালো, কলকাতার জিভে বিদ্যুৎ লাগে। রাজধানীর রাজনীতিই শহরের সবচেয়ে মিঠে স্বাদ, সবচেয়ে তিক্তও। যে রাজনীতি হালফিলের সুবেশ-কর্পোরেট যুবা, তার কোনও সম্পর্ক নেই শহরের শিকড়ের সঙ্গে। সে এই কসমোপলিটনের পণ্যশিশু মাত্র। যে রাজনীতির ঝাঁঝ কলকাতাকে কাঁপিয়ে দিতে পারত, পেরেওছিল, তার ঘ্রাণ ক্ষয়িষ্ণু। "জান কবুল আর মান কবুলে"-র আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করত কলকাতার রাজনীতি। তখনও মানুষ সর্বংসহা হয়ে ওঠেনি, তখনও বিরোধী দল এত ম্রিয়মাণ নয়। তখনও কলকাতার ছত্রে ছত্রে ঝাঁঝ, আন্দোলনের তীব্র স্বাদ। কলকাতার 'এক পয়সার লড়াই' পশ্চিমবঙ্গকে ঝাঁকুনি দিয়ে তুলে এনেছিল হকের লড়াইয়ে নামতে। কলকাতার ট্রামের ১৫০ বছর ফিকে হয়ে যায়, যদি না বাম আন্দোলনের সেই তুমুল দিনগুলিকে মনে রাখা যায়।
কলকাতা ট্রামকে ধরে রাখতে পারবে না স্বাভাবিক ব্যাপার। কলিকাতা মোটেও নড়িতে নড়িতে চলে না, এখন দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া সে যারপরনাই ক্লান্ত। ক্লান্তি কর্পোরেটের স্বাস্থ্যের পক্ষে যেহেতু মন্দ তাই ধীরগতির ট্রামকে আলতো করে সাইড করে দেওয়া যায়, তাতে সরকার বা জনতা কারওই এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয় না। সপ্তাহান্তে ট্রামবাজি চলতে পারে ঈষৎ, তবে ভরপুর কাজের দিনে ভিড় শহরে এমন শ্লথ যানকে মোটেও সওয়া যায় না। এখন জলের তলায় মেট্রোর দিন, মাথার উপর উড়ালপুলের রাত। ট্যাক্সি রাজি না হলেও পরোয়া নেই, হাজারো অ্যাপে চালক ছিপ ফেলে আছেন যোগ্য যাত্রী গাঁথবেন বলে। গলদঘর্ম নাগরিক বেশি টাকা দিয়ে আরাম কিনতে স্বচ্ছন্দ। এসবের মাঝে ট্রাম এক নিরীহ ইতিহাস মাত্র। ধূসর পাতা উল্টে দেখার লোক কম, যদি কেউ উল্টে ফেলেন তাহলেই রাজনীতি, ট্রাম, ঐতিহ্য মিলেমিশে এক অস্থির অবয়ব জেগে ওঠে। সে কেবলই তাড়িয়ে নিয়ে যায় কলকাতার আন্দোলনের দিনগুলিতে, কলকাতার বিরোধী স্বরের ঝাঁঝের দিনগুলিতে। ট্রামভাড়া মাত্র এক পয়সা বাড়ানোকে রুখে দিতে যে প্রতিবাদ দেখেছিল কলকাতা, পশ্চিমবাংলা- সেই বিরোধিতার আঁচও এখন সম্ভবত হেরিটেজ!
আরও পড়ুন- শেষ মুহূর্তে চেয়েছিলেন একটু কমলালেবু, জীবনানন্দের মৃত্যুর পর পুড়ে যায় ‘ঘাতক’ ট্রামটিও
কলকাতায় ট্রাম এসেছিল দেড়শো বছর আগে, ১৮৭৩ সাল, ২৪ ফেব্রুয়ারি। শিয়ালদহ ও আর্মেনিয়ান ঘাটের মধ্যে ২.৪ কিলোমিটার পথে কলকাতায় প্রথম ট্রাম চলে। যদিও সঠিক পরিচালনার অভাবে সেই বছরেরই ২০ নভেম্বর ট্রাম পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়। এর ঠিক ৭ বছর পরে, ১৮৮০ সালে লন্ডনে ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি লিমিটেড গঠিত হয়। কোম্পানির দায়িত্বে কলকাতায় ঘোড়ায় টানা ট্রামের মিটারগেজ লাইন বসল। দু'বছরের মাথাতেই, ১৮৮২ সালে পরীক্ষামূলকভাবে স্টিম ইঞ্জিন চালু হলো ট্রামে। ১৯০০ সালে ট্রামলাইনে বিদ্যুৎ জুড়ল। ১৯২০ সালের পর থেকে ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি শ্রমিক আন্দোলনগুলির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ওই বছরই এই সংস্থার প্রথম শ্রমিক সংগঠন ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন গঠিত হয়। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা, স্বামী বিবেকানন্দের ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। ১৯২৭ সালে এই সংগঠনের নাম বদলে হলো ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়কাল জুড়ে, বাম-প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠনগুলি ইংরেজদের বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলনে নামে।
ততদিনে কলকাতার ট্রাম পরিষেবার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে হাওড়ার ট্রাম পরিষেবা। সস্তা পরিবহন মাধ্যম হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ট্রাম। মূলত ছাত্রছাত্রী এবং সাধারণ কর্মজীবী মানুষদের নিত্য যাতায়াতের ভরসাযোগ্য মাধ্যম ছিল কলকাতার ট্রাম। ইংরেজদের হিসেব মতো, ট্রামের প্রথম ক্লাসে গরিবগুর্বোদের ঠাঁই নেই, তারা দ্বিতীয় শ্রেণির যাত্রী। ভারত তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে। ওপার বাংলা থেকে মানুষ শরণার্থী হয়ে এসেছেন এই দেশে, খাবার নেই, চাকরি নেই, মাছির মতো মানুষ মরে গিয়েছে দাঙ্গায়, অনাহারে। এরই মধ্যে ১৯৫৩ সালে বিধান চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার সিদ্ধান্ত নিল ১ জুলাই থেকে ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি লিমিটেডের (তখনও ব্রিটিশ সংস্থাই চালাত ট্রাম) ট্রামের দ্বিতীয় শ্রেণির ভাড়া এক পয়সা বাড়ানো হবে। সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিরোধীদের আন্দোলন যে কতখানি তীব্র হতে পারে, তার নজির দেখল গোটা বাংলা।
ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে মাঠে নামল কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া। কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে যোগ দেয় প্রজা সোশালিস্ট পার্টি, ফরওয়ার্ড ব্লক, সোশালিস্ট ইউনিটি সেন্টার। গড়ে ওঠে ট্রাম ও বাসভাড়া বৃদ্ধি প্রতিরোধ কমিটি, যার সভাপতি হন সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সম্পাদক নির্বাচিত হন হেমন্ত কুমার বসু। ২৭ জুন এই কমিটির তরফে এক বিবৃতিতে জনগণের কাছে আবেদন জানানো হয়, সরকার যাই বলুক না কেন, ১ জুলাই থেকে যেন কেউই বর্ধিত ট্রাম ভাড়া না দেন। বিরোধী বামেদের কথা মতোই যাত্রীরা ১ জুলাই ট্রামে চেপেও পুরনো ভাড়া ধরালেন। একদিকে সরকারের নির্দেশ নয়া ভাড়া নেওয়ার, অন্যদিকে যাত্রীদের চূড়ান্ত প্রতিরোধ। বিনা ভাড়াতেই ট্রামে সওয়ার হলেন যাত্রীরা। পরপর দু'দিন এই অবস্থা চলল। বেগতিক দেখে বর্ধিত ট্রাম ভাড়া আদায়ের লক্ষ্যে ৩ জুলাই রাস্তায় নামল বিশাল পুলিশ বাহিনী। ট্রামে উঠে যাত্রীদের উপর জোরজুলুম, হাতাহাতি, এমনকী লাঠিচার্জ ও গ্রেফতারিও চলল। মারমুখী পুলিশকে ঠেকাতে ট্রামে ঢিল ছুঁড়ল জনতা। কয়েক জায়গায় ট্রামে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো বিরোধীদের তরফে, ব্যারিকেড পড়ল রাস্তায়। প্রতিরোধ কমিটির নেতৃত্বে সামনের সারিতে তখন জ্যোতি বসু, সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায়। পিকেটিংয়ের জন্য জ্যোতি বসু, গণেশ ঘোষ এবং সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায় সহ ৬০০ জনকে গ্রেফতার করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। প্রতিবাদে ৪ জুলাই হরতালের ডাক দেয় প্রতিরোধ কমিটি। দোকান, বাজার, বেসরকারি গাড়ি, বাস সমস্ত স্তব্ধ, দমদমে ট্রেন অবরোধ! পুলিশ জনতার যুদ্ধে পুলিশের গুলিতে এক মহিলা মারা যান, গুরুতর আহত হন কয়েকজন।
কংগ্রেস সরকার তখনও এক পয়সা ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তে অচল। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিতে ভাড়া বাড়ানোই তখন সরকারের হাতিয়ার। সেই বছরই, মানে ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের ডান চোখের অপারেশন হওয়ার কথা ছিল ভিয়েনায়। বামেদের এই আন্দোলন কোন পথে যেতে পারে আঁচ করে যাওয়ার আগে, তাঁর অনুপস্থিতিতে কী কী করতে হবে সেসবই মন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন এবং কালীপদ মুখোপাধ্যায়কে বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছিলেন। সবে প্রথম বিধানসভা নির্বাচনের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। তারই মাঝে এই ভাড়াবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত আর তার বিরুদ্ধে কলকাতা কাঁপানো আন্দোলন, বিরোধী নেতাদের গ্রেফতারি। হাল ছেড়ে দিয়ে, ভারপ্রাপ্ত মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন বিধান চন্দ্রকে ফোন করে বললেন, "ফিরে আসুন। সামাল দেওয়া যাচ্ছে না"। ফিরেছিলেন বিধান রায়, অপারেশন না করিয়েই।
এরই মাঝে, ৫ জুলাই আসানসোলের বার্নপুরে ইন্ডিয়ান স্টিল কোম্পানির বিক্ষোভরত শ্রমিকদের উপরে গুলি চালায় পুলিশ, পাঁচজন শ্রমিকের প্রাণ যায়। ট্রামের ভাড়া বৃদ্ধির আন্দোলনের মাঝেই শ্রমিক শ্রেণিকে আরও ক্ষেপিয়ে তোলে এই ঘটনা। শ্রমিক সংগঠনও আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হয়ে যায়। ৬ জুলাই থেকে প্রতিরোধ কমিটি ট্রাম বয়কটের ডাক দেয়। ৭ জুলাই ট্রাম কোম্পানির সদর দপ্তর ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপক বিক্ষোভে উত্তাল। ৯ জুলাই রাইটার্স বিল্ডিংয়ের দিকে ছাত্রছাত্রীদের মিছিল যেতেই ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ। ব্যারিকেড ভেঙে এগনোর চেষ্টা করলে লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া- কিছুই বাদ দেয় না পুলিশ। কলকাতা শহরে তখন থমথমে ১৪৪ ধারা জারি। ১৫ জুলাই সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হলো বিরোধীদের তরফে। কংগ্রেস সরকারের পদত্যাগ ও পুনর্নিবাচনের দাবি ওঠে বামেদের তরফে। শুধু কলকাতা নয়, আশেপাশের শহরতলিকেও অচল করে দিয়েছিল সেই ধর্মঘট! ছাত্র-যুবদের ভূমিকা ছিল তীব্রতম। যাদবপুরে ট্রেন অবরোধকারীদের উপর পুলিশ গুলি চালায়। মারা যান সন্ন্যাসী সর্দার। ১৫ থেকে ১৮ জুলাই কলকাতা তখন আন্দোলনের ঝাঁঝে লাল! ১৬ জুলাই শহরে মিলিটারি নামায় কংগ্রেস সরকার। প্রায় ৪,০০০ মানুষকে আটক করা হলো সেই রাতে। বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ যায় ১৮ বছর বয়সী এক ছাত্রের। ১৭ জুলাই ট্রাম কোম্পানির কর্মচারীদের সংগঠন, ট্রাম মজদুর পঞ্চায়েত যোগ দেয় প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে।
আরও পড়ুন- মৃত্যুপথযাত্রী ট্রাম, ১৪৯ বছর বাঙালির ওঠাপড়া ভাঙাগড়ার সাক্ষী যে যান
আন্দোলনের চাপে ১৮ জুলাই কংগ্রেস সরকার ট্রামভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব ট্রাইব্যুনালে পাঠায়। সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত পুরনো ভাড়াই বহাল থাকে। কিন্তু প্রতিরোধ কমিটি জমি ছেড়ে নড়ে না। ভাড়া বৃদ্ধি রদ করা, আটক বন্দিদের মুক্তি, নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে ২২ জুলাই ময়দানে জনসভার ডাক দেয় কমিটি। সেই সমাবেশেও উপস্থিত হাজার হাজার মানুষের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে। জনতার ক্ষোভকেই বাতাস দেয় পুলিশ। সরকার বিপদ বুঝে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করে নেয়। প্রতিরোধ কমিটির ৫ জন নেতাকে মুক্তি দিয়ে কমিটির সঙ্গে আলোচনাতেও বসতে বাধ্য হয় সরকার। সদ্য জামিনে ছাড়া পাওয়া জ্যোতি বসু এবং প্রতিরোধ কমিটির নেতারা পুরনো ভাড়া চালু করার আহ্বান জানান। দাবি মেনে না নিলে জ্যোতি বসু ট্রাম বয়কট আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা করেন। সেদিন বিকালেই ফের জ্যোতি বসু এবং প্রতিরোধ কমিটির বেশ কয়েকজন কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। অবস্থার অবনতি দেখে মেঘনাদ সাহা থেকে শুরু করে হীরেন মুখোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে সমাধানে উদ্যোগী হতে আহ্বান জানান। ৩১ জুলাই ট্রাম ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ২ অগাস্ট বিধান চন্দ্র রায়ের সঙ্গে প্রতিরোধ কমিটির আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে জ্যোতি বসু সহ প্রায় সব বন্দিকেই মুক্তি দেওয়া হয়। নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি সাংবাদিকদের উপর হামলার বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। পুরনো তিন পয়সার ভাড়া নিয়েই চলতে থাকে কলকাতার ট্রাম।
এক পয়সার ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির বাঁক বদলে দেয়। কলকাতা ক্রমেই ফসকে যেতে শুরু করে কংগ্রেসের হাত থেকে। বামপন্থী রাজনীতির ভিত মজবুত হতে থাকে রাজধানীতে। এর পর ১৯৬৭ সালে ব্রিটিশ কোম্পানিকে সরিয়ে ট্রাম কোম্পানির জাতীয়করণ করা হয়। তখনই দেখা যায়, ট্রাম একমাত্র টিকে রয়েছে কলকাতায়। ট্রামকে কলকাতা শহরে বাতিল ঘোষণার ধুয়ো ওঠে তখনই। প্রফুল্ল চন্দ্র সেন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে হাওড়া থেকে প্রথম ট্রাম তুলে দেন। জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন আবার ট্রাম পরিষেবা বৃদ্ধি পেয়ে একেবারে কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে জোকা অবধি ছড়িয়ে পড়ে।
পরবর্তীকালে সুভাষ চক্রবর্তী পরিবহনমন্ত্রী থাকাকালীন টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর জমি বেসরকারিকরণের কথা শোনা যায়। সেই সময় বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিবাদে নেমেছিলেন। আজ, তৃণমূল সরকার জানিয়েছে, কলকাতার অভয়ারণ্যে এসব শম্বুকসম ট্রাম বাহুল্য। ১৫০ বছরে একটা আস্ত পরিবহণ মাধ্যমকে মৃত্যুর তোফা দিচ্ছে সরকার। ২০১১ সালে যেখানে কলকাতা শহরে ট্রামরুট ছিল ৩৭ টি, ২০১৩ সালে কমে হয় ২৭, ২০১৮ সালে ৮, আর এখন ২! ঐতিহ্যের কী চমৎকার সমাপতন। শুধু রুট নয়, বিনিয়োগের খতিয়ান জানলেও অবাক হতে হয়। ২০১১ সালে ৫.৫ কোটি টাকা থেকে ২০২২ সালে ট্রাম উন্নয়নে বিনিয়োগ এসে দাঁড়িয়েছে শূন্যে। আর কলকাতার সেই ঝাঁঝ? বিরোধী রাজনৈতিক দলের জান কবুলের গান? কলকাতার বিভিন্ন ট্রাম ডিপোতে বিক্ষোভ, পুরনো সমস্ত ট্রামরুট চালুর দাবি, টালিগঞ্জ, কালীঘাট, বেলগাছিয়া, গ্যালিফ স্ট্রিট, খিদিরপুর— ৫টি ট্রাম ডিপোর প্রায় ৩৫০ কাঠা জমি বিক্রির ২৩০ কোটি টাকা কোথায় গেল তা নিয়ে প্রশ্ন, আগামী দিনে আরও বৃহৎ আন্দোলনে শামিল হওয়ার ডাক- সবই উঠেছে। সকলেই জানেন, দাবি ওঠে। দাবি আদায় হবে কি, দাবি ছিনিয়ে নেওয়ার তীব্র আকুতিতে কি নড়ে উঠবে বাংলার রাজনীতি? ট্রাম আসলে মরা মাছের চোখের মতো, সেখানে তির তাক করে জয়ের গরিমা নেই। দেড়শো বছরে আস্ত একটা কলকাতা তাই দাঁড়িয়ে দেখছে, ম্রিয়মাণ যুবাটির আরও কিছু মরা হলো কিনা।