শুকোচ্ছে ফুসফুস, আয়ু কমছে কলকাতার! অতিবৃষ্টিতে জল জমা নিয়ে ভয়াবহ তথ্য
Kolkata Water Logging: কলকাতার বহু অংশে, দক্ষিণ-উত্তর-মধ্য অংশেও এই জলাভূমি বুজিয়ে অট্টালিকা নির্মাণের কথা প্রকাশ্যে এসেছে। যা উত্তর ২৪ পরগনার রাজারহাটের বিস্তীর্ণ অংশেও প্রকাশিত হয়েছে বারবার।
“প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি।
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের অঙ্গীকার সফল হয়নি! আমরাও অপারগ বারবার। এই পৃথিবী শিশুর বাসযোগ্য ঠিক কতটা হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশের মধ্যেই অনুরণিত হয়েছে পৃথিবীর সব জঞ্জালের এক হয়ে থাকার কথা। ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা! পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে রোজ। প্রত্যেক মুহূর্তে শেষ হচ্ছে গাছ। বাসা হারাচ্ছে পাখি। জল ফুরনোর কালো ঘরে খাবি খাচ্ছে জলজরা। আর আমরা অর্থাৎ মানুষরা? শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে পলিথিন এবং অপরিমিত অট্টালিকার আবহে শেষ করছি নিজেদেরই! অর্থাৎ নিজের পায়ে কি কুড়ুল মারছি নিজেরাই! এক একটি শহরকে কি হারিয়ে যেতে সাহায্য করছি আমরাই!
ফের শোনা যাচ্ছে বিপদে পড়েছে কলকাতা! সুন্দরী তিলোত্তমার আকাশে ঘনিয়ে আসছে ভয়ের মেঘ! তার নাকি ফুরোচ্ছে দিন! ক্রমে ক্রমে কমছে আয়ু! নষ্ট হচ্ছে ফুসফুস! ঘুণ ধরছে শরীরে! আর কলকাতার এই ঘোর বিপদের আবহে ভয় ধরিয়েছে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা। কেন? গত মাসেই বন্যায় বিপর্যস্ত হয়েছে বেঙ্গালুরু। বলা হচ্ছে, ওই শহর গত একশো বছরে এই রকম ভয়াবহ বন্যা দেখেনি। লক্ষাধিক মানুষের ক্ষতি হয়েছে। ভেঙেছে ঘর। ক্ষতি হয়েছে আসবাবের। গত মে মাসেই বন্যায় ডুবেছে অসম। গুয়াহাটি-সহ একাধিক এলাকা গিয়েছে জলের তলায়। বলা হচ্ছে, এমন জোরদার বন্যার কথা নাকি গত ৫০ বছরেও আঁচ করতে পারেনি অসম। অগাস্টে বন্যায় ডুবেছে পাকিস্তান। হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে এই বন্যায়। বৃষ্টি, বাঁধ ভাঙার কবলে শেষ হয়েছে পাকিস্তানের একাধিক এলাকা। বন্যার কবলিত হয়েছে চিনও। অনেকেই বলছেন, বর্ষাকালে নদীবাঁধ ভাঙে অনেক জায়গায়, সেই কারণে বন্যার ইতিহাস পরিলক্ষিত হয় বারবার। প্লাবিত হয় এলাকার পর এলাকা।
যদিও তথ্য বলছে অন্য কথা। এই বন্যা আর নদীর বাঁধ ভাঙার ঘটনা, অতিবৃষ্টির সঙ্গে উঠে আসছে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। কী বলা হচ্ছে ওই তথ্যে? ইউনাইটেড ইন সায়েন্সের পক্ষে ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২-এ প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হচ্ছে, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং প্রত্যেক বছর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য এই অবস্থা। শহরগুলোতে অতিবৃষ্টি হচ্ছে, যার ফলে বন্যায় ডুবছে শহর।
গত মে মাসে অসমের বন্যা নিয়ে উঠে এসেছে একটি বিস্ফোরক তথ্য। বলা হচ্ছে, একে একে প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি জলাভূমির আয়তন কমছে। যেখানে একাধিক বিল বা জলাভূমি বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। আয়তন কমেছে ‘ডিপোর বিলে’র মতো জলাভূমির। একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হচ্ছে; ১৯৯২ থেকে ২০১৯- এই ২৭ বছরের গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অসমের খামরঙা বিলের আয়তন কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। অসমের আদমশুমারি বিভাগের কর্তা জয়ন্ত গোস্বামী এবং তাঁর দলের তরফে গবেষণায় উঠে আসে যে, নগরায়ন, নির্মাণের ফলে ক্রমেই কমেছে এই জলাভূমির আয়তন। রামসার কভেনশনের রিপোর্ট বলছে, অসমের ডিপোর বিলে জলধারণ ক্ষমতা কমেছে। ঠিক এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে কলকাতার মতো শহরের অবস্থাও প্রায় একই। কলকাতার একাধিক বেঁচে থাকা জলাশয়ের আয়তনও কমেছে।
আরও পড়ুন- হাথরাস থেকে লখিমপুর- আইনের জটে কেন আজও আটকে দলিত ধর্ষণের মামলা?
কলকাতা হাইকোর্টে ২০১৯-এর একটি মামলার প্রেক্ষিতে জানা যায়, মূলত পূর্ব কলকাতার একাধিক জায়গায় জলাভূমি ভরাট হয়েছে বারবার। যদিও প্রায় একই বিষয়ে বারবার সরব হয়েছেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। জলাভূমি ভরাটের ঘটনায়, ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র। এছাড়া কলকাতার বহু অংশে, দক্ষিণ-উত্তর-মধ্য অংশেও এই জলাভূমি বুজিয়ে অট্টালিকা নির্মাণের কথা প্রকাশ্যে এসেছে। যা উত্তর ২৪ পরগনার রাজারহাটের বিস্তীর্ণ অংশেও প্রকাশিত হয়েছে বারবার। সেখানেও উঠেছে একই অভিযোগ। এখানেই ‘ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্টাডি অব ক্লাইমেট চেঞ্জেস’, বম্বে-র তরফে একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। টুইটারকে ব্যবহার করে বলা হয়, বন্যা বা জল জমা এলাকার ছবি দিতে। যা তাজ্জব করে পরিবেশবিদদের। দেখা যায়, দেশজুড়ে একাধিক জায়গায় অল্প বৃষ্টিতেও জল জমছে। আবার অতিবৃষ্টিতে সেই সমস্ত এলাকায় বন্যা হচ্ছে। যার মধ্যে কলকাতার ছবি ছিল প্রথম সারিতে অর্থাৎ জল জমার ইতিহাস কলকাতার থাকলেও তা যে খুব শীঘ্রই ভয়ঙ্কর অবস্থায় পৌঁছচ্ছে সেই ইঙ্গিত পাওয়া যায় ওই রিপোর্টে।
কেন এই অবস্থা হয় কলকাতার? উত্তর দিয়েছেন পরিবেশবিদ মোহিত রায়। তিনি ইনস্ক্রিপ্টকে জানান, “এই বন্যা কবলিত হওয়ার কারণ হিসেবে এই মুহূর্তে বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাবই সব, একথা আমি বলছি না। কলকাতায় ভয়ঙ্কর বন্যার ইতিহাস ১৯৭৮ সাল থেকেই আছে। কিন্তু এই অযাচিত বন্যার কারণ অবশ্যই পরিবেশের অবনমন। দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ন। নির্মাণে পরিকল্পনার অভাব। জল নিকাশিতে দুর্বল পরিকল্পনা। যা বন্যা যেমন বাড়াবে তেমনই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রেও ক্ষতি করে বিপদ বাড়াবে। কলকাতার ক্ষেত্রেও তাই। তবে কলকাতার জন্য যে ভয়ঙ্কর আশঙ্কা রয়েছে, তা বলার সময় আসেনি।”
আরও পড়ুন- অর্থনীতির মরা গাঙে বান আনছে দুর্গাপুজো, ছোট ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি ফুটবে?
সাম্প্রতিক সময়ের একাধিক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে বন্যা আর শহরের গতিপথে সংঘর্ষ হয়েছে বারবার। মুহূর্তেই তলিয়েছে একের পর এলাকা। এর কারণ কী, এই বিষয়ে উল্লিখিত আলোচনার পাশাপাশি যা বলছেন পরিবেশবিদরা;
পরিকল্পনা ছাড়া যেখানে সেখানে নগরায়ন। পাশাপাশি জলাভূমি ভরাট। নিকাশির অনুন্নতি যে কারণে, বৃষ্টির জল ধারণ ক্ষমতা কমছে। একের পর এক জলাভূমির শূন্যতায় বাধা প্রাপ্ত হচ্ছে জল যাওয়ার গতিপথ। নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন প্রশাসনের একটা বড় অংশ।
এর সঙ্গেই কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে নদীর নাব্যতা হ্রাস। পলি জমা। জল ধরে রাখার ক্ষেত্রে নদীর ভূমিকা অন্যতম। সেখানে দাঁড়িয়ে হুগলি নদী-সহ একাধিক নদীতে নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। পলি জমছে। যা দূষণের ফলেই হচ্ছে বলে দাবি। এর ফলে বাড়ছে বন্যার প্রকোপ।
অতিবৃষ্টি আর জল ধারকের অন্যতম আধার সমুদ্রের জলসীমা বাড়ছে। যার কারণ হিসেবে উঠে আসছে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবও।
মানুষের দ্বারা পরিবেশের ক্ষতি অর্থাৎ অতিরিক্ত পলিথিনের ব্যবহার জল নিকাশীর ক্ষেত্রে বাধা হচ্ছে বলেও দাবি করা হয়। যা এই সমস্ত শহরে আকস্মিক বন্যার অন্যতম কারণ।
ঠিক এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই প্রশ্ন উঠছে আসলে কি সব জেনেও সর্বনাশের দিকে কলকাতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি আমরা! নাকি সচেতন নাগরিক হিসেবে বারবার দায়িত্ব পালনের ঘাটতি আর প্রশাসনিক অবহেলায় অচিরেই শেষ হচ্ছে সবটা! প্রশ্ন উঠছে কিন্তু উত্তরও তো রয়েছে সকলের কাছেই!