চিনে খাবারের স্বর্গরাজ্য, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে কলকাতার এই এলাকা
নুডল স্যুপ, রাইস পুডিং, ওয়ান্টন, পর্ক সসেজ। এসব যখন আপনার হাতের নাগালে- তখন যে কোনও খাদ্য-বেরসিকেরও জিভে জল আসতে বাধ্য। টেরিটিবাজারের চিনে জলখাবার গোটা কলকাতার মানুষের কাছেই পরিচিত। ভোরবেলা পৌঁছে গেলে সেখানে মিলবে এলাকার বাসিন্দাদের ঘরে তৈরি মোমো, নুডলস, মাংস থেকে শুরু করে নানা ধরনের খাবার। চিনের সঙ্গে সীমান্তে ঝগড়া চললেও, এদের খাবারের প্রতিপত্তিকে কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় কী! আর কলকাতার ভোজন-আমুদেরা তো এই জায়গার প্রেমে পড়ে রয়েছেনই।
মধ্য কলকাতার টেরিটিবাজার ‘পুরনো চায়না টাউন’ নামেও পরিচিত। ‘ওয়ার্ল্ড মনুমেন্টস ওয়াচ লিস্ট ২০২২’-এ বিশ্বের ২৫টি ঐতিহ্যবাহী জায়গার একটি তালিকা তৈরি হয়েছে। তাতেই উঠে এসেছে এই অঞ্চলের নাম।
কলকাতার মানুষ ভোজনবিলাসী। আর তা শুধু আজ থেকে নয়, আগাগোড়াই এই শহরের মানুষ ভাল-মন্দ খাবার খেতে ভালবাসে। আর এই খাওয়াদাওয়া যদি হয় সকালের জলখাবারে, তা হলে তো আর কোনও কথাই নেই। কলকাতায় একদিন আপনি ভোরবেলা জলখাবারে খাঁটি চিনে খাবার দিয়ে পেটপুজো করতে পৌঁছে যেতেই পারেন এই শহরের টেরিটিবাজার অঞ্চলে।
আরও পড়ুন: গরমের শুরুতেই হাসফাঁস! উইকেন্ডে জিরিয়ে নেওয়ার পাঁচ সেরা জায়গা
সকাল সকাল যদি আপনার ডেস্টিনেশন হয় টেরিটিবাজার, কীভাবে যাবেন?
টেরিটিবাজারের অবস্থান লালবাজারের কাছে। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের পাশে ছাতাওয়ালা গলিতে এই চিনে জলখাবারের বাজার বসে প্রত্যেক দিন ভোরে। আপনি পোদ্দার কোর্ট এলাকা থেকে আসতে পারেন, অথবা বড়বাজারের সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশন থেকে মাত্র ৫ মিনিট হেঁটেই এখানে পৌঁছে যেতে পারেন।
দেরি করলেই মিস!
ভোর ৫টার মধ্যেই প্রাতঃরাশের জন্য এই বাজারে পৌঁছে যেতে হবে। না হলে মুখরোচক অনেক খাবারই বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যেতে পারে। এখানে পাওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার হল নানা কিসিমের মোমো। চিকেন মোমো, ফিশ মোমো, পর্ক মোমো, চিকেন তাই পাও, শুমাই, সসেজ, প্রন ওয়েফার, হট স্যুপ নুডুলস, স্টেমড বাওজি বান, চিকেন রোল সসেজ, স্টাফড বান, শুয়োরের মাংসের রোল, ওয়ান্টন ইত্যাদি।
বাজারটির নামকরণ করা হয়েছে ভেনিসের একজন ইতালীয় অভিবাসী এডওয়ার্ড টিরেত্তার নামে। তিনি আঠারো শতকের শেষের দিকে এই এলাকার একজন জমি জরিপকারী এবং অনেক জমির মালিক ছিলেন।
১৭৮০ সাল নাগাদ কলকাতায় বসতি স্থাপন করার পর চিনদেশীয় মানুষজন পোশাক, চিকিৎসার পাশাপাশি কলকাতা শহরের রন্ধনশিল্পকেও প্রভাবিত করেছে। এঁদের সংস্পর্শে এসেই পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত একটি ধারার খাবারের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় হয়। এখনও যদি আপনি যথাযথ চিনে খাবারের স্বাদ নিতে চান, তবে আপনাকে অবশ্যই কলকাতার নিজস্ব মিনি চায়নাটাউন হিসাবে খ্যাত টেরিটিবাজার পরিদর্শন করতে হবে। এই জায়গাটি শুধুমাত্র কিছু ভাল চিনে খাবার পরিবেশন করে না। এমনকী, স্থানীয় চিনা অভিবাসী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যও রক্ষা করে।
‘ওয়ার্ল্ড মনুমেন্টস ফান্ড’ (ডব্লিইউএমএফ) বিশ্বের ২৫টি ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকা প্রকাশ করে। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ যেসব স্থানের রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন, যত্নের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে যেসব জায়গা, তেমনই কিছু জায়গার তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেই তালিকাতেই ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বের প্রথম ২৫টি স্থানের মধ্যে রয়েছে টেরিটিবাজারের নাম। এই এলাকাকে ভারতের প্রথম চায়নাটাউন হিসাবে উল্লেখও করা হয়েছে সেখানে। এই ডব্লিউএমএফ হল আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরের একটি সংস্থা। তাদের দফতর রয়েছে ব্রিটেন, ভারত, কম্বোডিয়া, পেরু, স্পেন, পর্তুগালের মতো কিছু দেশেও। এই তালিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য হিসাবে তারা জানিয়েছে, ইতিহাস সংরক্ষণ করতে বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা এবং ব্যক্তিকে উৎসাহ দিতে চায় তারা। সেজন্যই তৈরি হয় এমন তালিকা।
গোটা শহরের বেশিরভাগ এলাকাই যখন ঘুমঘুম চোখে আচ্ছন্ন, তখন এই একটা পাড়ায় ঢুকলেই সমস্ত ভ্রম দূর হয়ে যায়। নানারকম চিনা খাবারের ডালা সাজিয়ে বসে থাকে এই জায়গা। কোথাও টগবগিয়ে ফুটছে স্যুপ, তো কোথাও মোমো থেকে উঠছে ধোঁয়া। চিনা পরিবারের সদস্যরা নিজেদের হাতে তৈরি খাবার নিয়ে বসেন ওই এলাকায়। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, যে কোনও মরশুম নির্বিশেষে আজও তাঁরা হাতে তৈরি খাবার নিয়ে বসেন পথের ধারে। মোমো, সুপ, ডাম্পলিং, ওয়ানটন, সসেজের গন্ধে ভরপুর থাকে গোটা চত্বর। ভোর ছ’টা-সাড়ে ছ’টা থেকেই রমরমিয়ে শুরু হয়ে যায় কেনাকাটা। আর ঘড়ির কাঁটা আটটার ঘরে পৌঁছনোর আগেই প্রায় সব শেষ!
আলোচনার টেবিলে বারবার বসেছে ভারত-চিন। কোনও লাভ হয়নি। লাল ফৌজ ও ভারতীয় সেনা বারবার সীমান্তে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে থেকেছে পরস্পরের দিকে। তা সত্ত্বেও এই শহর বিভিন্ন সংস্কৃতিকে ঠাঁই দিয়েছে। তাই তো সিটি অফ জয় কলকাতা। আর এই শহরের বুকেই রয়েছে এক টুকরো চিন। কলকাতার এই চিনা পাড়া যেন বাংলার মিশ্র সংস্কৃতির এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ইন্দো-চিন যুদ্ধের পর কাজের খোঁজে ভারতে চলে আসে ভারত-চিন সীমান্তে বসবাসকারী অনেক চিনা পরিবার। তাও প্রায় কয়েক হাজার। তাদেরই মধ্যে এখনও টিকে রয়েছে কিছু পরিবার। তাদের হাত ধরে এই শহরে ঠাঁই করে নিয়েছে চিনা খাদ্য-সংস্কৃতি।